X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ময়নাতদন্ত ও সুরতহালে যেভাবে নষ্ট হয় মামলা

আমানুর রহমান রনি
২২ আগস্ট ২০১৭, ১০:২১আপডেট : ২২ আগস্ট ২০১৭, ১৮:২৫

 

ময়নাতদন্ত

যেকোনও হত্যা মামলায় ময়নাতদন্ত রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ।এটি যথাযথ না হলে একটি হত্যা মামলা প্রমাণ করা যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি অপরাধীদের ছাড়া পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। একইভাবে তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদন বা অভিযোগপত্রও মামলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই অভিযোগপত্রের ওপর ভিত্তি করেই মামলার বিচারকাজ পরিচালিত হয়। কিন্তু, অতীতে অনেক মামলায় ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তার দেওয়া অভিযোগপত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব রিপোর্টের কারণে মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অনেক রায়ের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। এ বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন আদালত।

গত ৬ আগস্ট বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের রায় ঘোষণার সময় হাইকোর্টের বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর বেঞ্চ মরদেহের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী পুলিশ সদস্য ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। কারণ, বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজের সঙ্গে সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের কোনও মিল ছিল না।

বিশ্বজিতের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন সূত্রাপুর থানার এসআই জাহিদুর রহমান। তার দায়িত্বে অবহেলা ছিল কিনা- তা খতিয়ে দেখতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজি) নির্দেশ দেন আদালত। একইসঙ্গে ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কিনা- তাও খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্যসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে ফলোআপ করতে আইনজীবী মনজিল মোরসেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ভিডিও ফুটেজ ও সাক্ষীদের বর্ণনা অনুসারে বিশ্বজিতের শরীরে রড, লাঠি ও ধারালো অস্ত্রের একাধিক আঘাতের কথা থাকলেও মামলায় দাখিল করা সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে এত আঘাতের তথ্য ছিল না। তাই বিষয়টিতে দায়িত্বে অবহেলা ছিল কিনা- তা খতিয়ে দেখতে বলেছেন আদালত। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের এমন প্রতিবেদনের সমালোচনাও করেন আদালত। ওই মামলায় হাইকোর্ট দুজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন।বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আরও চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং দুজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ হত্যা মামলা নিয়ে নিহতের পরিবার ও ভক্তদের অভিযোগ রয়েছে। দু’বার সালমান শাহর মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। প্রতিবারই আত্মহত্যার কথা বলা হয়েছে। তবে তার পরিবার দাবি করেছে এটি হত্যা। এমনকি আদালতে এক আসামির স্বীকারোক্তিও রয়েছে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে। এই মামলায় ময়নাতদন্ত রিপোর্টও প্রশ্নবিদ্ধ।

এসব চাঞ্চল্যকর মামলা ছাড়াও বিভিন্ন হত্যা মামলায় ময়নাতদন্তের রিপোর্ট নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। সময়মতো ময়নাতদন্ত রিপোর্ট না পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন অনেক পুলিশ তদন্ত কর্মকর্তা।

গত ১৩ মার্চ নবাবগঞ্জে ভক্ত সরকার (২৩) নামে এক যুবক খুন হন। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি নবাবগঞ্জ থানার এসআই অখিল সরকার তদন্ত করছেন। হত্যাকাণ্ডের ছয়মাসেও ভক্তের লাশের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাননি তিনি। প্রতি সপ্তাহে মিডফোর্ট হাসপাতালে খোঁজ নিচ্ছেন। কী কারণে রিপোর্ট দিতে দেরি হচ্ছে সেই উত্তরও চাইতে পারছেন না তিনি। ইতোমধ্যে এক আসামি আদালতে হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দিও দিয়েছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলেই এই মামলার চার্জশিট দিতে পারেন তিনি।

এ বিষয়ে জানার জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের অধ্যাপক বেলায়েত হোসেন সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

মামলার বাদী সুশান্ত সরকার অভিযোগ করে বলেন, ‘ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেতেই যদি একবছর লাগে, তারপর তদন্ত করতে আরও সময় লাগবে। এরপর চার্জশিট দেবে পুলিশ। তারপর সাক্ষী-শুনানি, এতকিছু করতে কত সময় লাগবে তার কোনও সীমা নেই। তাহলে মামলার বিচার হবে কবে?’

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক একটি মামলা শেষ করে দিতে পারেন। কারণ এজাহার, সুরতহাল, চার্জশিট ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের দেওয়া প্রতিবেদনগুলো যদি একই ধরনের তথ্য না থাকে, অথবা অমিল থাকে তাহলে সেই মামলায় আসামিরা শাস্তি পায় না।

এ বিষয়ে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটি হত্যা সংঘটিত হওয়ার পর সেখানে প্রথমেই পুলিশ যায়। পুলিশ কর্মকর্তা গিয়েই লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। লাশটির শরীরে কেমন আঘাত, কোথায় আঘাত, চোখ, মুখ, নাক, চুল, মলদ্বার, লিঙ্গ– এসবের অবস্থা তিনি যা দেখবেন, সেভাবেই বর্ণনা করবেন। এমনকি ক্ষত বা আঘাত মেপে তাও লিখবেন। ক্রাইমসিন আলামত সংগ্রহ করার পর সেই লাশ ময়নাতদন্তের জন্য যেকোনও অনুমোদিত হাসপাতলে পাঠাবেন। হাসপাতালের নির্ধারিত চিকিৎসক লাশ গ্রহণের সময় একটি বর্ণনা পুলিশের কাছ থেকে বুঝে নেবেন। এরপর তিনি ময়নাতদন্ত করবেন। ভিসেরা সংগ্রহ করবেন। যেসব লাশের শরীরে দৃশ্যমান আঘাত থাকে সেগুলোর বিষয় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন চিকিৎসক। কিন্তু আঘাতের চিহ্ন নেই, এমন লাশের মৃত্যুর কারণ জানতে আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। তবে সেগুলো পেতেও বেশি দেরি হওয়ার কথা নয়।’

উদাহরণ দিয়ে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘এজাহারে একটি হত্যা মামলায় যদি দু’টি ছুরিকাঘাতের কথা উল্লেখ থাকে, সুরতহালেও তা-ই লিখতে হবে। কিন্তু ময়নাতদন্তে যদি রিপোর্ট আসে যে,তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। তখন ওই মামলা প্রমাণের জন্য গলার ছাপ নিতে হবে। ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। তারপর জানা যাবে কে বা কারা হত্যা করেছে। এভাবেই মূলত প্রতিটি রিপোর্ট মামলায় প্রভাব ফেলে।’

এই আইনজীবী বলেন, ‘মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ময়নাতদন্তের বিষয়ে আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। বিচারপ্রার্থীদের ন্যায্য বিচারের জন্য এই রিপোর্টগুলো গুরুত্বপূর্ণ।’

 

/এআরআর/এসএনএইচ/এএম/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঢামেকে কারাবন্দি হাজতির মৃত্যু
ঢামেকে কারাবন্দি হাজতির মৃত্যু
ফটোগ্রাফারদের ওপর খেপলেন নোরা ফাতেহি!
ফটোগ্রাফারদের ওপর খেপলেন নোরা ফাতেহি!
রানা প্লাজায় নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ
রানা প্লাজায় নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে ৫
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে ৫
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…