X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

লিবিয়ায় অপহৃত শতাধিক বাংলাদেশি, টাকা দিয়েও মিলছে না মুক্তি

রাফসান জানি
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:২৮আপডেট : ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:২৮

অপহরণ ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় লিবিয়ায় পাড়ি জমানো শতাধিক বাংলাদেশি অপহৃত হয়ে আছেন। লিবিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদেরই একটি চক্র তাদের অপহরণ করেছে। দেশে থাকা অপহরণের শিকার এই প্রবাসীদের স্বজনদের কাছ থেকে তারা মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করছে কোটি কোটি টাকা। একবার মুক্তিপণ নিয়ে যে ছেড়ে দিচ্ছে, তাও নয়। বরং মুক্তিপণ পাওয়ার পর আবার নতুন করে টাকা দাবি করছে তারা। একই সঙ্গে চলে নির্যাতন। দিনের পর দিন অপহরণকারীদের মু্ক্তিপণের পরিমাণ বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে নির্যাতন। ফলে অপহৃতরা আদৌ ছাড়া পাবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তাদের স্বজনরা।

বাংলাদেশের পুলিশ বলছে, লিবিয়ায় অপহরণে শিকার বাংলাদেশি ১০০ থেকে ১২০ জন। তারা লিবিয়ার বিভিন্নস্থানে একটি চক্র দ্বারা অপহৃত হয়েছেন। এই অপহরণকারী চক্রের সদস্য ২০ থেকে ২৫ জন। তাদের প্রত্যেকেই বাংলাদেশি। এই চক্রের মূল হোতার নাম বাকির মিয়া বলে জানিয়েছে পুলিশ। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছে জাকির হোসেন, কবির হোসেন, হুমায়ুন কবিরসহ আরও কয়েকজন।

তারা লিবিয়া যাওয়া শ্রমিকদের টার্গেট করে ইতালিসহ অন্যান্য উন্নত দেশে যাওয়ার লোভ দেখায়। কেউ তাতে রাজি হলে তাদের প্রথমে গোপন স্থানে নিয়ে যায় ওই চক্রটি। সেখানে নেওয়ার পর টাকা, পাসপোর্টসহ সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়। পরে মুক্তিপণের দাবিতে আটকে রেখে নির্যাতন চালায় অপহরণকারীরা।

এরপর এই নির্যাতনের ছবি ও ভিডিও মোবাইল ফোনে ধারণ করে পাঠানো হয় আটকে রাখা ব্যক্তিদের বাংলাদেশে থাকা স্বজনদের কাছে, দাবি করা হয় মুক্তিপণ। সন্তান বা স্বামীর ওপর নির্যাতনের দৃশ্য দেখে অপহরণকারীদের দাবিমতো টাকা দিতে বাধ্য হন ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা। এই টাকা লেনদেন হয় বিকাশে মাধ্যমে। ভুক্তভোগী পরিবার বিকাশে টাকা পাঠান আর বিকাশ এজেন্টেদের কাছ থেকে সেই টাকা গ্রহণ করেন অপহরণকারীদের স্ত্রীরা। যা পরে দেশে থাকা অন্য অপহরণকারীদের পরিবারের কাছে বিকাশের মাধ্যমে পাঠানো হয়।

চলতি বছরের ২১ জুলাই লিবিয়ায় অপহৃত হন নওগাঁর রায়পুরার আইয়ুব আলী (২৫) ও পত্নীতলার মো. রুবেল (২৮)। তাদের অপহরণের বিষয়টি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা মেট্রোকে অবহিত করেন আইয়ুব আলীর বাবা তছলিম প্রামাণিক ও রুবেলের বড় ভাই মো. রব্বানী। অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নামে সংস্থাটি। এরপর গত ৭ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জের ভৈরবপুর, নরসিংদীর রায়পুরার মাহমুদাবাদ পাগলা বাজার ও জংলী শিবপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিকাশ এজেন্টসহ ছয়জনকে আটক করে পিবিআই। আটকদের মধ্যে অপহরণকারীদের দুই স্ত্রীও রয়েছে।

আটকরা হলো- মো. কামাল উদ্দিন, নাজনীন বেগম, আবু কাশেম, বেবী আক্তার, মামুন মিয়া ও মো. নূরুল হক। 

পিবিআই ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘উন্নত রাষ্ট্রে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে লিবিয়ায় ১০০ থেকে ১২০ জনকে অপহরণ করে আটক রাখা হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে গড়ে পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়েছে অপহরণকারীরা। যাতে মোট টাকার অংশ দাঁড়ায় পাঁচ কোটি টাকারও বেশি। এই অপহরণকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ২০-২৫ জন। তাদের প্রত্যেকেই বাংলাদেশি। এখনও এর সঙ্গে লিবিয়ার স্থানীয় কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।’

বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, ‘বাকির মিয়া হচ্ছে এই চক্রের গডফাদার। প্রায় চার বছর ধরে তারা এ অপহরণ বাণিজ্য করে আসছে। অপহরণের পর দেশে থাকা অপহরণকারীদের স্ত্রীরা বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে ভোক্তভোগী পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করে। যা পরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরও ২০-২৫ জনের কাছে পাঠানো হয়। এগুলোর সব প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এই চক্রের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন জড়িত। কিছু বিকাশ এজেন্টও তাদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। দেখা গেছে, একদিনে ৫-১০ লাখ টাকা লেনদেন করেছে এসব এজেন্ট। সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত।’

দেশে থাকা সাহায্যকারী ও লিবিয়ায় থাকা অপহরণকারীদের নাম ঠিকানা নিজেদের কাছে রয়েছে বলে জানান আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ‘দেশে এবং লিবিয়ায় বসে যারা এ কাজ করছে তাদের নাম-পরিচয় আমরা পেয়েছি। দেশে থাকা জড়িতদের গ্রেফতারে সারাদেশে আমাদের অভিযান চলছে। লিবিয়ায় যারা আছে, তাদের বিষয়টি সেখানকার পুলিশ প্রশাসনকে ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে। এছাড়া, লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে সেখানকার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে অপহৃতদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।’

মুক্তিপণ দেওয়ার পরও থামছে না নির্যাতন

মুক্তিপণের টাকা দেওয়ার পরও মুক্তি পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। গত রবিবার পিবিআই ঢাকা মেট্রোর কার্যালয়ে কথা হয় দুই ভিকটিমের পরিবারের সঙ্গে।

নওগাঁর রায়নগর থানার বাসিন্দা তছলিম প্রামাণিক জানান, তার ছেলে আইয়ুব আলী ২০১২ সালে লিবিয়ায় যান। সেখানে সে একটি পেট্রল পাম্পে চাকরি শুরু করার পর তাদের পরিবার ভালোই চলছিল। চলতি বছরের ২১ জুলাই আইয়ুব আলীর মোবাইল ফোনে জানান, বাংলাদেশি কয়েকজন তাকে অপহরণ করেছে। তার সঙ্গে থাকা টাকা, মোবাইল ফোন, পাসপোর্ট নিয়ে গেছে। তাকে অজ্ঞাতস্থানে আটক রেখে মুক্তিপণ দাবি করে বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন করছে।

পরে নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করে পাঠানো হয় পরিবারের কাছে। ভিডিও পাঠিয়ে অপহরণকারীরা পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। ছেলেকে নির্যাতনের দৃশ্য দেখে থেকে অপহরণকারীদের দেওয়া বিভিন্ন বিকাশ নাম্বারে তিন লাখ পনেরো হাজার টাকা পাঠান তছলিম প্রামাণিক। কিন্তু এরপরও অপহরণকারীরা আইয়ুবকে ছেড়ে না দিয়ে একইভাবে আরও ৫ লাখ টাকা দাবি করে নির্যাতনের ভিডিও পাঠায়।

পিবিআই কার্যালয়ে থাকাকালীনই লিবিয়া থেকে ফোন আসে তছলিম প্রামাণিকের মোবাইল ফোনে। পুলিশ কর্মকর্তা ও উপস্থিত সাংবাদিকের সামনে লাউড স্পিকারে কথা বলেন তিনি। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে তার ছেলে আইয়ুব আলী বলছিলেন, ‘আমারে বাঁচাও। টাকা না দিলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ ছেলের এই কথা শোনার পর অচেতন হয়ে পড়েন তার ৫২ বছর বয়সী বাবা।

একই রকম তথ্য জানান নওগাঁর পত্নীতলার মো. রব্বানী (৩০)। তিনি বলেন, তার ছোট ভাই মো. রুবেল ২০১৩ সালে লিবিয়া গিয়ে টাইলস মিস্ত্রি হিসেবে কাজ শুরু করে। চলতি বছরের ২১ জুলাই রুবেল তার ফোন নাম্বার থেকে কল দিয়ে জানায়, তাকে অপহরণ করে সঙ্গে থাকা টাকা, মোবাইল ফোন, পাসপোর্ট নিয়ে গেছে অপহরণকারীরা। অজ্ঞাতস্থানে আটক রেখে মুক্তিপণ হিসেবে ১০ লাখ টাকা দাবি করে বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন করছে তারা। পরে নির্যাতনের দৃশ্য  ভিডিও করে পাঠিয়ে বিভিন্ন বিকাশ নাম্বারে পাঁচ লাখ টাকা পাঠাতে বলে অপহরণকারীরা।

পরে রব্বানী নওগাঁ ও ঢাকার বিভিন্ন বিকাশের দোকান থেকে অপহরণকারীদের দেওয়া নাম্বারে দুই লাখ পঞ্চান্ন হাজার টাকা পাঠান। এই টাকা দেওয়ার পর আরও পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে অপহরণকারীরা।

এই দুই ভুক্তভোগী পরিবারের দুই সদস্য পুলিশ ও সরকারের কাছে আকুতি জানান, তারা যেন তাদের স্বজনসহ সব অপহৃতকে ফিরিয়ে আনেন।

 

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শিশু হাসপাতালে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না: ফায়ার সার্ভিস
শিশু হাসপাতালে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না: ফায়ার সার্ভিস
ভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
বায়ার্নের নজরে থাকা নাগেলসমানের সঙ্গে জার্মানির নতুন চুক্তি
বায়ার্নের নজরে থাকা নাগেলসমানের সঙ্গে জার্মানির নতুন চুক্তি
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!