X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
জামিন নিয়ে লাপাত্তা

দিল্লিতে গ্রেফতার ব্রিটিশ জঙ্গি সামিউন ঢাকায় আইএস যোদ্ধা সংগ্রহ করতো

নুরুজ্জামান লাবু
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:৩৪আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:৫৩

সামিউন রহমান- ঢাকায় গ্রেফতারের পর (বাঁয়ে), দিল্লিতে গ্রেফতারের পর (ডানে) বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ জঙ্গি সামিউন রহমান ওরফে ইবনে হামদুন ঢাকা থেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার পাসপোর্ট জব্দ করে রাখলেও অবৈধভাবে সে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গত রবিবার (১৭ সেপ্টেম্বর)  দিল্লির বিশেষ পুলিশের একটি দল তাকে গ্রেফতার করেছে।

ভারতে সামিউন নিজেকে সুমন হক বলে পরিচয় দিয়েছিল।পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সে নিজের আসল পরিচয় সম্পর্কে খুলে বলে।এরপর দিল্লি পুলিশ ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে গ্রেফতার হওয়া একজন বৃটিশ জঙ্গি, যার বিরুদ্ধে আইএস, নুসরা ফ্রন্ট ও আল-কায়েদার জন্য সদস্য সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে, সে কিভাবে জামিন পেলো? আর কিভাবেই বা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করলো?

এ বিষয়ে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, অন্যান্য জঙ্গির ক্ষেত্রে যেমন জামিন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট পক্ষ তাদেরকে (সিটিটিসি) জানায়, কিন্তু সামিউন রহমানের জামিন বা কারামুক্তির ক্ষেত্রে তাদের কোনও তথ্য জানানো হয়নি।

সিটিটিসি ইউনিটের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘এভাবে দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে গেলে, জঙ্গি প্রতিরোধ করা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। জামিনের পর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর কথা, কিন্তু সামিউনের ক্ষেত্রে বিষয়টি জানানো হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হলে, সামিউনকে নজরদারির মধ্যে রাখা সম্ভব হতো।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে সামিউন রহমানকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। সেসময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমান সিরিয়া ফ্রন্টে সশস্ত্র জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনা করতে আইএস ও নুসরা ব্রিগেডের জন্য মুজাহিদ সংগ্রহ করতে বাংলাদেশে এসেছিল। আল-কায়েদা নেতা আইমান আল  জাওয়াহারী ঘোষিত একিউআইএস বা আল-কায়েদা অব ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট -এর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে জঙ্গি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যও ছিল তার।তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন বলছে,দেশে কোন আইএস জঙ্গি বা তাদের কোন নেটওয়ার্ক নেই।

সিটিটিসি সূত্র জানায়, সামিউনকে গ্রেফতারের আগে ওই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সেগুনবাগিচা ও ইস্কাটন এলাকা থেকে আসিফ আদনান ও ফজলে এলাহী নামে দুই তরুণকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পরে গ্রেফতার করা হয় এই ব্রিটিশ জঙ্গি সামিউন রহমানকে। আসিফ আদনান ও ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে যে মামলা (নং ৫২, তারিখ ২৪/৯/২০১৪) দায়ের করা হয়, ওই মামলাতেই গ্রেফতার দেখানো হয় সামিউনকে। মাস কয়েক আগে ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আসলাম আলী শেখ তিন জনকেই অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট প্রদান করেন। সিটিটিসি’র অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সামিউনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট জঙ্গি তৎপরতার প্রমাণ পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেফতারের কিছুদিন পর উচ্চ আদালত থেকে একে একে জামিনে ছাড়া পায় আসিফ আদনান ও ফজলে এলাহী। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিল মাসে উচ্চ আদালত থেকেই জামিনে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যায় সামিউন রহমান। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরপরই আত্মগোপনে চলে যায় এবং  জুলাই মাসে বৃহত্তর সিলেটের সীমান্ত পথে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে। এরপর ভারতের মনিপুরে চলে যায়। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর বিহারের কিশানগঞ্জে গিয়ে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে সামিউন রহমান।

 দিল্লিতে গ্রেফতারের পর সামিউন রহমান গত রবিবার দিল্লির ভিকাস মার্গ রোড থেকে সামিউন রহমানকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, বিহারের কিশানগঞ্জ এলাকায় সুমন হক নামে ভোটার আইডি নিয়েছিল সে। বিহারের কিশানগঞ্জ এবং হাজারীবাগ এলাকার বিভিন্ন মাদ্রাসায় সে অবস্থান করেছে। সেখানকার তরুণ-যুবকদের সে জঙ্গি দলে ভেড়ানোর চেষ্টাও করছিল। ভারতীয় পুলিশের বরাত দিয়ে টাইম অব ইন্ডিয়া বলছে, সামিউন রহমান ভারতে রোহিঙ্গা মুসলিমদের জঙ্গি দলে ভেড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছিল।

ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সামিউন জানিয়েছিল, সে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সিরিয়ায় গিয়ে নুসরা ফ্রন্টের হয়ে জিহাদে অংশ নিয়েছিল। জিহাদে অংশ নিতে  এক ব্রিটিশ বন্ধুসহ সেসময় তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় যায় সামিউন। পরবর্তীতে পিস টিভির উপস্থাপক অ্যানথনির ফেসবুক ফ্যান পেজের সূত্র ধরে বাংলাদেশ থেকে জিহাদে অংশ নিতে ইচ্ছুক তরুণদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক থেকে ঢাকায় আসে সে। বাংলাদেশে আসার পর হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ থানার গোপলার বাজারের ফোটারচরে গ্রামের বাড়িতে যায়। গ্রামের বাড়িতে বসেই সে মোবাইল ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু করে।

সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা জানান, সামিউন রহমান ঢাকায় এসে জেএমবি’র সেই সময়কার একটি অংশের আমির তাসনিম ওরফে নাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাসনিমের মাধ্যমে মাসুম বিল্লাহ, মাহমুদ ইবনে বাশার ও ফুয়াদ হাসানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এছাড়া, সেসময়কার আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অন্যতম সদস্য সেকান্দার আলী নকির মাধ্যমে এবিটি সদস্য নাঈম আলী ও আলী আহমেদের সঙ্গেও পরিচয় হয়।

এছাড়া  অনলাইনের মাধ্যমে পরিচয়ের পর সামিউন একাধিকবার বৈঠক করে আসিফ আদনান ও তানজিলের সঙ্গে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সেসময় সামিউনের সব বাংলাদেশি সহযোগীকে গ্রেফতার করে। যদিও একমাত্র তাসনিম বাদে সবাই জামিন নিয়ে বর্তমানে বাইরে রয়েছে। যোগাযোগ করা হলে ব্রিটিশ জঙ্গি সামিউন রহমানের গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জের ইউপি সদস্য আব্দুল আজিজ  বলেছেন, ‘গ্রামে আব্দুল মুইয়ীদ নামে সামিউনের একমাত্র চাচাতো ভাই রয়েছে। বাকি সদস্যরা সবাই লন্ডনে। ২০১৪ সালে গ্রেফতারের পর সামিনউনকে আর গ্রামে কখনও দেখা যায়নি।’ জামিনে বেড়িয়ে সে আর গ্রামে আসেনি বলেও জানান ইউপি সদস্য আব্দুল আজিজ।

সিটিটিসি সূত্র জানায়, সামিউন রহমান একটি ব্রিটিশ জিহাদি গ্রুপের সদস্য ছিল। এছাড়া মরক্কোর জিহাদি গ্রুপ, সিরিয়ার নুসরা ব্রিগেডের শীর্ষ নেতা ও আফগানিস্তানের আসাদ নামে একজন শীর্ষ জঙ্গি নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। গ্রেফতারের পর তার মোবাইল ফোন সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করে এমন কিছু ভিডিও উদ্ধার করা হয়, যাতে সামিউন রহমান নিজে একে ৪৭ নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এমন ছবি রয়েছে।

কিভাবে ছাড়া পাচ্ছে দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা?

বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে এমন কিছু দুর্ধর্ষ জঙ্গি জামিনে মুক্তি পেয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে আত্মগোপনে থেকে আবারও জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গত ঈদ-উল-ফিতরের আগে তিন দিনে অন্তত ২০ জঙ্গি জামিনে মুক্তি পাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। এবার এমন একজন দুর্ধর্ষ জঙ্গির জামিনে বের হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে, যে অবৈধভাবে পালিয়ে ভারতে গিয়ে জঙ্গি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সামিউন রহমানের মতো বেশিরভাগ জঙ্গিই উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কেন তাদের জামিন ঠেকানো যাচ্ছে না? জানাতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, ‘জঙ্গিদের পুলিশ রিপোর্ট বা এফআইআর  যদি শক্ত না হয়, বা সেখানে যদি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকে যে, সে কিভাবে জঙ্গি কার্যক্রম করেছে, বা সে কোন পর্যায়ের জঙ্গি, এসব স্পষ্ট করে উল্লেখ করা না থাকলে জামিন পেয়ে থাকে।’ এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের কোনও গাফিলতি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের সবাই খুব কনসাস। আমাদের গাফিলতিতে কারও জামিন পাওয়ার সুযোগ নেই।’

আরও পড়ুন:

শ্যালকসহ ৪ মে থেকে নিখোঁজ ছিল জঙ্গি মেহেদী (ভিডিও)

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
টানেলে অপারেশনাল কাজে গেলে টোল দিতে হবে না জরুরি যানবাহনকে
টানেলে অপারেশনাল কাজে গেলে টোল দিতে হবে না জরুরি যানবাহনকে
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি, সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি, সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী