X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তামনির সাফল্যে সাহসী তাসনিয়া আর মুসকান

জাকিয়া আহমেদ
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৮:০২আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৯:১৪

হাসপাতালে জেবা তাসনিয়া (বাঁয়ে) ও মুসকান সোমা (ডানে) কবি মোস্তফা আনোয়ারের ‘বৈশাখের রুদ্র জামা’ কবিতাটি যখন তাসনিয়া আবৃত্তি করছিল, তখন ওয়ার্ডের নারী-পুরুষ- শিশু সবাই ভিড় করে তার বিছানার পাশে। তাদের অনেকেই কবিতা বোঝে না। কিন্তু তারা হয়তো এটা বুঝতে পেরেছিল যে, তাসনিয়া কিছু একটা বলছে- যেটা স্বাভাবিক বলা না। তারা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল তাসনিয়ার কবিতা। আবৃত্তি শেষ হলে যখন তাসনিয়ার বাবার চোখ ছলছল করছে, তখন তারা- কেউ রোগী কেউবা আবার রোগীর স্বজন হয়েও ব্যথা ভুলে হাততালি দিচ্ছে। আর তাসনিয়া কবিতা শেষ করে মুখে একরাশ হাসি নিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে।

২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের ছয়তলায় অবস্থিত শিশু ওয়ার্ডে গেলে দেখা মেলে তাসনিয়ার।

তাসনিয়ার বাবা হাসান হাফিজুর রহমান সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার আতরজান মহিলা কলেজের লাইব্রেরিয়ান। তার এক ছেলে আর এক মেয়ে।  মেয়েটি বড়, নাম জেবা তাসনিয়া। সবাই তাকে তাসনিয়া নামেই ডাকে।

দেখা গেল,তাসনিয়ার মুখের বাম পাশ ফুলে আছে। এ কারণে তার বাম চোখটি ছোট হয়ে আছে। কিন্তু বাবা হাসান হাফিজুর রহমান বললেন, ‘তাসনিয়ার এই অবস্থার জন্য অনেক কথা শুনতে হয়েছে তাদের। পাড়া-প্রতিবেশি,আত্মীয়-স্বজন সবাই বলছে, নিশ্চয়ই বাবা-মায়ের কোনও কৃতকর্মের জন্য মেয়ের এ অবস্থা।’ তবে দমে যাননি বাবা হাফিজুর রহমান।

চাচি ও বাবার সঙ্গে তাসনিয়া

তার ভাষায়, ‘কোনও কিছুই আমাকে দমাতে পারেনি। পরোয়া করিনি কোনও কথার। বরং এসবের বদলে আমি আমার মেয়েকে স্কুলের পাশাপাশি নাচ-গান-কবিতা-আবৃত্তি-ছবি আঁকা শিখিয়েছি, যেন সে মানুষের সঙ্গে আরও বেশি করে মিশতে পারে। তার চেহারার জন্য যেন কোনও ধরনের হীনমন্যতায় না ভোগে। সারাক্ষণ ওকে আমি সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত রেখেছি।’

বাবার দেখানো পথে হেঁটেছে তাসনিয়া। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া তাসনিয়া ক্লাসসহ সব কিছুতেই প্রথম হয়ে এসেছে। তাসনিয়া বলে, ‘বাবাই আমাকে সব জায়গায় নিয়ে যেত। বাবার হাত ধরেই পথটা চলেছি।’

জন্ম থেকেই তাসনিয়ার মুখের এ সমস্যা ছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখের ফোলা ভাবটা আরও বেড়েছে। চার বছর বয়সে বাবা তাকে নিয়ে যান ভারতের ভেলরের সিএমসি হাসপাতালে। কিন্তু ভেলরের চিকিৎসকরা তাসনিয়াকে ‘রিফিউজ’করেন। তারা বলেন, ‘ওর যে ব্লিডিং হবে- সেটা সে নিতে পারবে না।’

তারপরও থেমে থাকেননি তাসনিয়ার বাবা হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অনেকেই বলেছেন, ভারতের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ভালো, সেই চিকিৎসা করাতে। ২০১০ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি তিনমাস পর পর কলকাতার প্রশান্ত ব্যানার্জির কাছে হোমিও চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু তাতেও কোনও উন্নতি হয়নি দেখে সরে আসি।’

দাদির সঙ্গে মুসকান

হাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘চলতি বছর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে জাতীয় পর্যায়ে আবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করে সারাদেশের মধ্যে তৃতীয় হয় তাসনিয়া। পুরস্কার নেয় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের হাত থেকে। তখনই তাসনিয়াকে দেখে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান মন্ত্রী। তার সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাসনিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে খোঁজ নেবেন বলে জানান। এরপর গত রোজার ভেতরে  সংস্কৃতি মন্ত্রী আমাকে ফোন দেন এবং জানান যে, তাসনিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে বার্ন ইউনিটের ডা. সামন্ত  লাল সেনের সঙ্গে তিনি (আসাদুজ্জামান নূর) কথা বলেছেন। তিনি  আমাদের ঢাকায় আসতে বলেন। তারপর আমরা ঢাকায় আসি। সেন স্যারের সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাসনিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করে নেন ৫ আগস্ট। ’

ঈদের আগে ২৩ দিন থাকার পর আবার চলতি মাসের ১১ সেপ্টেম্বর তাসনিয়াকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন বাবা হাফিজুর রহমান।

চিকিৎসকরা তাসনিয়াকে নিয়ে কী বলেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাসনিয়ার বিষয়টি খুব রিস্কি। তড়িঘড়ি করা যাবে না। অনেক চিন্তা-ভাবনার বিষয় রয়েছে। তবে মুক্তামনি, তোফা-তহুরা, আর আবুল বাজানদারকে দেখে আমি খুব আশাবাদী যে, আমার মেয়েটাও সুস্থ হয়ে যাবে। সুস্থ করে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবো।’

তাসনিয়ার রোগটি ‘নিউরোফাইব্রোমা বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেন, ‘অপারেশন করতে হবে। তবে কয়েকটি ধাপে সেটি করতে হবে।’

তাসনিয়ার রোগটিকে ‘ক্রিটিক্যাল’না হলেও ‘কম্প্লিকেটেড’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘কম্প্লিকেটেড’ হলেও আমরা অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করছি, ভালো কিছুই করতে পারবো আমরা।’

মুক্তামনি

মুসকান সোমা

শিশু ওয়ার্ডেই হাড় ছাড়া হাত নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে আট বছরের মুসকান সোমা। তার ডান হাতের কেবল একটি আঙ্গুল ছাড়া বাকি আঙ্গুলগুলো জোড়া লাগানো। পুরো হাতে অসংখ্য ছোট ছোট টিউমার। হাতটি ফুলে আছে, ওজনও অনেক। হাতটি সবসময় গরম থাকে। মুসকান  নিজে  তার হাত তুলতে পারে না। কারও সাহায্য ছাড়া সে চলতে পারে না। বাম হাতে সব কাজ করতে হয় তাকে। মুসকানের দাদি হালিমা খাতুন রয়েছেন নাতনির সঙ্গে। বাবা সৌদি প্রবাসী। আর মা পারিবারিক কারণে মুসকান এবং ছোট ছেলেকে রেখে বাবার বাড়িতে রয়েছেন। এর আগে রাজধানীতে আরেকটি হাসপাতালে মুসকানের দু’টি অস্ত্রোপচার হলেও আর্থিক সংকটের কারণে গত কয়েক বছর ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেনি এই দরিদ্র পরিবারটি। দাদি হালিমা খাতুন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলেন, ‘মুক্তামনির খবর টিভিতে দেখে এই হাসপাতালে আসছি। যদি এই মাইয়াটারও কিছু একটা হয়। আল্লাহর নামে নাতনিরে লইয়া বাড়ি থাইকা বাইর হইছি। যদি আল্লাহ সহায় হন, তাহলে ভালো কইরা বাড়ি লইয়া যামু। আরতো কোনও কূল কিনারা নাই।’

ডা. সামন্ত লাল সেন মুসকানের বিষয়ে বলেন, ‘মুসকানের রোগটি ভাসকিউলার মেলফরমেশন ।’ পরীক্ষা চলছে, মুসকানেরও  অস্ত্রোপচার হবে বলে জানান তিনি।

মুসকান সোমা ভর্তি আছে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. লুৎফর কাদের লেনিনের অধীনে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা ওর জন্ম থেকেই ছিল। আগে ছোট ছিল, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিউমারগুলোও বড় হয়েছে। ওর হাতটি ডেভেলপ হয়নি। তবে অস্ত্রোপচারের পর ওই হাত দিয়ে সে যে খুব বেশি কাজ করতে পারবে, বিষয়টি তা নয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অস্ত্রোপচারের পর তার স্কিন ড্রাফট করার চেষ্টা করবো।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো, হাত যেন ফেলে দেওয়া না লাগে। যেন তার বিউটি নষ্ট না হয়। বাঁ হাত দিয়ে এখন যেভাবে তাকে কাজ করতে হচ্ছে, সেভাবেই কাজ করতে হবে। তবে অপারেশনের পর ডান হাতটা হয়তো তাকে কিছুটা সাপোর্ট দেবে।’

আগামী রবি বা সোমবার মুসকানের জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হবে উল্লেখ করে তিনি জানান, ওর পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন  হয়েছে। সেগুলো বার্ন ইউনিট থেকে বিনামূল্যে করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: 
চিকিৎসার বিল দিতে না পারায় নবজাতকসহ মা হাসপাতালে আটক!

/এমএইচ/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইনজুরিতে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচে খেলা হচ্ছে না মেসির  
ইনজুরিতে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচে খেলা হচ্ছে না মেসির  
এবার রাজশাহীর আম গাছে প্রচুর মুকুল, স্বপ্ন বুনছেন চাষিরা
এবার রাজশাহীর আম গাছে প্রচুর মুকুল, স্বপ্ন বুনছেন চাষিরা
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ মার্চ, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ মার্চ, ২০২৪)
চীনে ৯ বছরে প্রথমবারের মতো বিয়ের সংখ্যা বেড়েছে
চীনে ৯ বছরে প্রথমবারের মতো বিয়ের সংখ্যা বেড়েছে
সর্বাধিক পঠিত
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
শ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে ওয়ানডে সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ
তৃতীয় ওয়ানডেশ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে ওয়ানডে সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ
পদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
একীভূত হলো দুই ব্যাংকপদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার