X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতু খুলে দেবে স্বপ্নের দুয়ার

গোলাম মওলা
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৮:৩৮আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৮:৩৮

পদ্মা সেতু (ছবি: শরীয়তপুর প্রতিনিধি)

স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান। এই সেতুর প্রথম স্প্যান ইতোমধ্যে বসানো হয়েছে। মূলত স্প্যানই হচ্ছে একটা সেতুর সেই দৃশ্যমান অংশ যার ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করে। এ কারণে এই স্প্যান বসানো বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বলা যায়,এর মাধ্যমে এই সেতুর ভবিষ্যত নিয়ে যত সংশয় ছিল তা প্রাথমিকভাবে দূর হয়েছে।অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, পদ্মা বহুমুখী সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতি চেহারা বদলে দেবে। শুধু তাই নয়, এই সেতুকে কেন্দ্র করে সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে যাবে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড.এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই সেতুর কাজ শেষ হলে রাজধানীর সঙ্গে দেশেরর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে যাবে।এ কারণে, অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। যমুনা সেতু হওয়ার পর ওই অঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষদের আর্থিক উন্নতি হয়েছে। একইভাবে পদ্মা সেতুর হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দরিদ্র মানুষদেরও ভাগ্য বদলে যাবে। এর ফলে মোংলা বন্দরে গতি আসবে। বন্দরের অবকাঠামো বাড়বে।

তিনি উল্লেখ করেন, একটি স্প্যান বসানো হলেও এখনও অনেক কাজ বাকি আছে। কাজেই এটা যথাসময়ে শেষ হবে কিনা সেটা নিয়ে সংশয় আছেই। যেহেতু এটা প্রেসটিজিয়াস ও চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্ট, সেহেতু এটা সময়মতো শেষ করা জরুরি।এছাড়া যে কোনও প্রজেক্টের সময় বাড়লে খরচ বেড়ে যায়,আর এর চাপ পড়ে ভোক্তার ওপর।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, স্বপ্নের এই সেতুর নির্মাণ শেষ হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থনীতির পুনর্জাগরণ ঘটবে। যমুনা নদীর ওপর করা বঙ্গবন্ধু সেতুকে উদাহরণ দেখিয়ে তিনি বলেন,‘যমুনার ওপর ওই সেতু হওয়ার কারণে উত্তরবঙ্গের মঙ্গা বিদায় নিয়েছে। ওই অঞ্চলে শিল্প-বাণিজ্যের গতি বেড়েছে। একইভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেও দারিদ্র্য কমে আসবে। পদ্মা সেতুর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ওই অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবেন। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র মানুষদের জীবনমান গতিশীল হবে।এই সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ইতোমধ্যে এই সেতুকে মাথায় রেখে মানুষ নানা ধরনের ব্যবসা- বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছেন। সামনে আরও নদী-বন্দর,সমুদ্র-বন্দর চালু হতে যাচ্ছে। মোংলা বন্দরেরও প্রসার ঘটছে। ইকোনমিক জোনও হচ্ছে। সব মিলিয়ে  ওই এলাকায় একটা অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিস্ফোরণ ঘটবে বলে তিনি মনে করেন।

পদ্মা সেতু (ছবি: শরীয়তপুর প্রতিনিধি)

সাবেক এই গভর্নর বলেন, এই সেতুর প্রভাবে এক থেকে দুই শতাংশ পর্যন্ত জিডিপিতে যোগ হতে পারে। এর বাইরে এই সেতুর ফলে মানুষের ভেতরে স্বস্তি আসবে।পর্যটন খাত উন্নত হবে।বৈদেশিক বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটবে।শুধু তাই নয়,এই সেতু আমাদের আস্থার প্রতীক হবে। কারণ,এই সেতুটি আমরা নিজেদের অর্থে তৈরি করছি। এছাড়া পদ্মা সেতু এই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল―সেই চ্যালেঞ্জ তারা মোকাবিলা করতে সক্ষম হতে যাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কৃষি-শিল্প-শিক্ষা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড.মুস্তাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,প্রথম স্প্যান উঠছে এটা খুবই আশাব্যঞ্জক কথা। দৃশ্যমান হলো। এতোদিন নদী শাসন, মাটির নিচে কাজ হয়েছে। এখন দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। তিনিও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সেতুর পর এই সেতু হবে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যবসা, বাণিজ্য,শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু বড় ভূমিকা রাখবে। এই সেতু চালু হলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বাজারজাতকরণ, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, জিডিপির প্রবৃদ্ধি, সব দিকে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর ফলে জিডিপিতেও অংশ বাড়বে।’ 

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা ছিল এই সেতুর ফলে সেটাও দূর হবে। তবে সেতুর কাজ সাশ্রয়ীভাবে সুশাসনের সঙ্গে সময়মতো শেষ করা গেলে অর্থনীতিতে আরও সুফল পাওয়া যেত। তিনি উল্লেখ করেন, নিজেদের অর্থে এই সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে এমনিতেই খরচ বেড়েছে। এখন সাশ্রয়ীভাবে সুশাসনের সঙ্গে করতে পারলে সেতু দিয়ে চলাচল করা যানবাহনে টোল যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে।তা না হলে পরবর্তীতে টোল বেশি পড়বে। এক্ষেত্রে ভোক্তার ওপর গিয়ে চাপ পড়বে।

অর্থনীতিবিদদের ধারণা, স্বপ্নের এই সেতুর প্রভাবে গতি বাড়বে মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে। এছাড়া সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে রাজধানী এবং বন্দরনগরে চট্টগ্রামের। যার ফলে পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।  

পদ্মা সেতু (ছবি: শরীয়তপুর প্রতিনিধি)

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু তৈরির পর উত্তর অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল।ওই অঞ্চলে মঙ্গা বিদায় নিয়েছে।একইভাবে পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ওই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের দুয়ার খুলে যাবে। কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশের দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য বাড়বে। তিনি বলেন,এই সেতু হলে সেখান কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক উন্নতি হবে। তবে এই সেতু হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য অবকাঠামোরও উন্নয়ন হতে হবে। চট্টগ্রামের সঙ্গে এই সেতুর সংযোগ করতে পারলে আরও বিশাল উন্নতি হবে। তিনি বলেন, এই সেতুর কারণে জাতীয় অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বলেছেন,এই সেতুর সঙ্গে বদলে যাবে দেশের অবকাঠামো, কৃষি, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ প্রযুক্তির ধারারও। একই সঙ্গে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, স্বপ্নের এই সেতু নিয়ে আমাদের বড় প্রত্যাশা, সেটা এখন পূরণ হতে চলেছে। সেতুতে একটি স্প্যান বসানো হয়েছে। এতে কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভেতরে আশার সঞ্চার হয়নি, পুরো দেশবাসীর মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। তিনি বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে সমস্যা এতদিন ছিলো, এই সেতু তৈরি হলে সেটা দূর হয়ে যাবে। এছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থনীতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে গতি পাবে। এই সেতুর সঙ্গে যদি দেশের সব সড়কের সংযোগ ঘটে, পাশাপাশি রেলপথ যুক্ত হয়, তাহলে তা দক্ষিণাঞ্চলকে ব্যাপকভাবে উপকৃত করবে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর সড়ক ও রেলপথ এই দুইয়ের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, রফতানি বাড়াতে সহায়তা করবে। পাশপাশি দেশের ভেতরে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আরও বাড়বে। ভবিষ্যতে এই সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারবে। ফলে আগামীতে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, সেতু চালু হলে অন্যান্য দেশ আমাদের বন্দরের ব্যবহার বাড়াতে চাইবে। এতে দেশে নতুন করে রাজস্ব বাড়বে। পাশাপাশি পণ্য চলাচলের মাধ্যমে আমাদের নতুন কর্মসংস্থান হবে। অঞ্চলিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও বাড়বে। সার্বিকভাবে জিডিপিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি উল্লেখ করেন, যেহেতু দক্ষিণাঞ্চল সমুদ্রের কাছাকাছি,সেখানে নতুন সমুদ্র বন্দরও হতে যাচ্ছে। আবার পুরনো বন্দরও সেখানে রয়েছে। নতুন করে দক্ষিণাঞ্চল কেন্দ্রিক গ্যাস,বিদ্যুতের কার্যক্রম এগুচ্ছে। বিনিয়োগকারীরাও ওই অঞ্চলে নতুন করে বিনিয়োগ করার জন্য জমি কেনা শুরু করেছেন।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আগে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সরাসরি নির্দেশনায় বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ হয়েছে। কিন্তু এবার দেশীয় নির্দেশনায় আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর সহায়তায় এই কাজটা হচ্ছে। এই সেতুর বাস্তবে রূপ নিয়ে দেশের ভেতরে বড় অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নতুন ধরনের সক্ষমতা তৈরি করবে। ফলে আগামীতে দেশীয় নির্দেশনায় আরও বড় অবকাঠামো তৈরি করতে সহায়ক হবে।

 

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
সর্বাধিক পঠিত
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান