X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্যাতিত শিশুদের নিপীড়ক হওয়ার প্রবণতা বেশি

জাকিয়া আহমেদ
০২ অক্টোবর ২০১৭, ২২:২৯আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০১৭, ২৩:২৮

শিশু নির্যাতন ছয় বছরের শিশু রাফিদ (ছদ্মনাম), বনানীতে বাসা। বাবা-মা দুজনেই ব্যস্ত। রাফিদ থাকতো বাসায় গৃহপরিচারিকার কাছে। কিন্তু একটা সময়ে তার মধ্যে প্যানিক ডিজঅর্ডার তৈরি হয়, স্কুলে যেতে চায় না, মা-বাবা অফিসে যাওয়ার সময় তাদের আঁকড়ে ধরে থাকে, ছাড়তে চায় না। এমনকি সে নিজ বাসাতেও থাকতে চাইতো না, এর চেয়ে নানাবাড়িতে থাকলে সাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। পরে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে জানা যায়,ছেলেটিকে গৃহপরিচারিকা যৌন নির্যাতন করতো। অনেক চিকিৎসার পর শিশুটি সুস্থ হয়ে ওঠে।

সমাজে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, শুধু মেয়েশিশুরাই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, প্রতি চারজন মেয়েশিশুর মধ্যে একজন এবং প্রতি ছয়টি ছেলেশিশুর মধ্যে একজন যৌন হয়রানির শিকার হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,শৈশবে নিপীড়নের শিকার শিশুর বড় হয়ে নিপীড়ক হওয়ার আশঙ্কা থাকে।  

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সায়েম (ছদ্মনাম)। সে কারও সঙ্গে কথা বলে না, মেশে না, নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকে, খারাপ আচরণ করে সবার সঙ্গে। মা তাকে নিয়ে যান চিকিৎসকের কাছে। মা জানান, ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও তাকে এখনও তার বাবা মারধর করেন, ছেলে বাইরে গেলে তার কম্পিউটার চেক করেন, বিছানা চেক করেন।এমনকি নিজের পছন্দের খাবারও ছেলেকে খেতে বাধ্য করেন। মা চিকিৎসককে বলেন, আমি এসব মেনে নিয়েছিলাম, কিন্তু ছেলে তো অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মাসখানেক আগের এই ঘটনা জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু কিশোর ও পারিবারিক বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে শোনা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের শহরাঞ্চলের ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৮২ শতাংশের বেশি শিশু মানসিক আগ্রাসন কিংবা শারীরিক শাস্তির মুখোমুখি হয় বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে। শহরাঞ্চলে শিশুদের অবস্থা নিয়ে পরিচালিত এই জরিপে তাদের ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় বলে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে, সম্প্রতি বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, বাবা-মায়ের হাতে শিশু নির্যাতনের হার বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘দেশে ২০১৫ সালের চেয়ে ২০১৬ সালে শিশুমৃত্যুর হার কম ছিল। তবে এ সময়ে বাবা-মায়ের হাতে শিশু মৃত্যু বেড়েছে।’

অপরদিকে, গত বছর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল শিশু নির্যাতন বন্ধে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানকে স্মারকলিপি দেয়। পরে প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে শিশু নির্যাতন বন্ধে স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের সময়ই তাদের শিক্ষার্থীদের না মারার শপথ গ্রহণ করানো হবে বলে জানিয়েছিলেন মন্ত্রী। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক স্কুলের অফিসের সামনে এ সম্পর্কিত হাইকোর্টের নির্দেশনা টাঙিয়ে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ কিন্তু তারপরও বন্ধ হয়নি ঘরে এবং বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের শারীরিক নির্যাতন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণে দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আর এসব নির্যাতনের কারণে শিশুরা হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে,তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে, জীবন সম্পর্কে তৈরি হচ্ছে নেতিবাচক ধারণা। তার মধ্যে সারাজীবনই এর প্রভাব থেকে যায়। শিশু তার শৈশবে যে ধরনের আচরণের শিকার হয়, বড় হয়ে সে সেটাই অন্যের ওপর দেখাতে চায়, শৈশবের নিপীড়নের শিকার শিশু বড় হয়ে নিজেও একজন নিপীড়ক হয়ে ওঠে।  

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু কিশোর ও পারিবারিক বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশুদের ওপর যেকোনও ধরনের মানসিক-শারীরিক বা সেক্সুয়াল নির্যাতন হলে এর তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে-সে আতঙ্কিত হতে পারে, তীব্র মানসিক চাপ বোধ করতে পারে, তার কনভারশন ডিজঅর্ডার হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া, সামাজিক দক্ষতা কমে যাওয়া, ব্যক্তিগত-পারিবারিক ও কর্মজীবন–এগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে।’

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন,‘সাধারণ ধারণা রয়েছে, কেবল মেয়েশিশুরাই যৌন হয়রানির শিকার হয়। কিন্তু আর্ন্তজাতিক গবেষণা বলছে, প্রতি চারজন মেয়েশিশুর মধ্যে একজন এবং প্রতি ছয়টি ছেলেশিশুর মধ্যে একজন যৌন হয়রানির শিকার হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি, নারীদের কাছে শিশু নিরাপদ। মেয়েরা নির্যাতনকারী হতে পারে এটা আমাদের সাধারণ চিন্তায় আসে না, কিন্তু নারীরাও অনেক সময় শিশুদের শারীরিক এবং যৌন নির্যাতন করতে পারে। এরকম কেস আমরা অহরহ পেয়ে থাকি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলেন,‘শিশুরা বানিয়ে কথা বলে–এটা আমাদের বেসিক ধারণা। কিন্তু শিশুটি কিছু বলামাত্র তা আমলে নিতে হবে।শিশুর কথাও যে শোনা-বোঝা দরকার, এটা আমাদের দেশের বাবা-মায়েরা ভাবেন না। শিশুর মনোজগত বলে যে কিছু একটা আছে সেটা আমাদের ধারণাতে নেই। আর তখনই শিশুরা ভালনারেবল হয়ে ওঠে।’

তিনি বলেন, ‘শিশু যখন শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় তখন সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, হয়ে ওঠে অপরাধী। কেউবা বেছে নেয় আত্মহননের পথ। তাই পরিবার বা পরিবারের বাইরে তার বন্ধু থাকতে হবে। নয়তো শিশু একা এক ধরনের মনোজগৎ তৈরি করে, যেখানে বিষন্নতা,অপরাধ করার প্রবণতা। টেকনো হিউম্যান হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

বিদ্যালয়ে এবং বাবা-মায়ের শিশুদের শারীরিক নির্যাতন একেবারেই উচিত নয় মন্তব্য করেন রাশেদা রওনক খান বলেন, ‘শারীরিক নির্যাতন করে শিশুকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে  ভেঙে দেওয়া হয়। শ্রেণিকক্ষে যখন একটি শিশুকে সবার সামনে শারীরিকভাবে আঘাত করা হচ্ছে কিংবা খারাপ কথা বলা হচ্ছে তখন সে অপমানিত হয়, শ্রেণি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরবর্তীতে সে নিজের ভেতরে এগুলো ধারণ করে।’

বর্তমান সময়ে শিশু নির্যাতনের ধরন বদলে যাচ্ছে উল্লেখ করে রাশেদা রওনাক খান বলেন,‘শিশু নির্যাতন বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে একটি অসুস্থ জাতি পেতে যাচ্ছি আমরা।’

 

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ