X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিভাগীয় দ্বন্দ্বেই ঢাবির তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে লেখা চুরির অভিযোগ!

রশিদ আল রুহানী
০৭ অক্টোবর ২০১৭, ২২:৫৩আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০১৭, ২৩:০৩

 

ঢাবির সহকারী অধ্যাপক বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, নুসরাত জাহান ও রুহুল আমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সামিয়া রহমান ও মাহফুজুল হক মারজান ছাড়া আরও তিন শিক্ষকের  বিরুদ্ধে লেখা চুরির অভিযোগ ওঠায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর (বুধবার) তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অভিযুক্ত ওই তিন শিক্ষক হলেন,  ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুহুল আমিন, নুসরাত জাহান ও বদরুজ্জামান ভূঁইয়া। পদোন্নতি ঠেকানোসহ বিভাগীয় দ্বন্দ্বের জেরে এই অভিযোগ আনা হয়েছে বলে দাবি করেন এই তিন শিক্ষক।

ঢাবির প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. আফজাল হোসেন ওই বিভাগের শিক্ষক রুহুল আমিন ও নুসরাত জাহানের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে লেখা চুরির অভিযোগ করেন। এর ঠিক দু’দিন পর (২০ সেপ্টেম্বর) বিভাগের সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ভাইভা দেন ওই তিন শিক্ষক। এদিনই বিভাগীয় শিক্ষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তিন জন ভাইভায় অংশ নিলেও পদোন্নতির জন্য সিলেকশন বোর্ড কেবল বদরুজ্জামান ভুঁইয়াকে সিলেক্ট করেছে। পদোন্নতির জন্য সুপারিশবঞ্চিত হওয়ার পেছনে লেখা চুরির অভিযোগকে দায়ী করেছেন রুহুল আমিন ও নুসরাত জাহান। পরে ২১ সেপ্টেম্বর বদরুজ্জামান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধেও পিএইচডি গবেষণায় লেখা চুরির অভিযোগ করেন শিক্ষক নুসরাত জাহান।

এই বিষয়ে অভিযোগকারী শিক্ষক আফজাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রুহুল আমিন ও নুসরাত জাহান স্বামী-স্ত্রী। এই দুই শিক্ষক বিভিন্ন লেখা থেকে অংশবিশেষ চুরি করে মোট ৪টি নিবন্ধ লিখেছেন। ওই নিবন্ধগুলো তারা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে ছেপেছেন।  চোখের সামনে এত বড় অন্যায় সহ্য করা সম্ভব নয়। তাই নিয়ম মেনেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছি।’ তবে কোন কোন নিবন্ধ থেকে এই দুই শিক্ষক লেখা চুরি করেছেন, সে বিষয়ে তিনি কোনও সুস্পষ্ট তথ্য দেননি।

ডমেস্টিক ট্যুরিস্ট মাইন্ডসেট রেসপন্সেবল ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট: এ কেইস স্ট্যাডি অন কক্সবাজার, বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিবন্ধের একপৃষ্ঠা

বদরুজ্জামানের বিরুদ্ধে নুসরাত জাহানের অভিযোগের বিষয়ে আফজাল হোসেন বলেন, ‘তারা হয়েতো ভেবেছিলেন, লেখা চুরির অভিযোগের কারণে তাদের পদোন্নতি আটকে গেছে। বদরুজ্জামান পদোন্নতি পেতে পারেন,  আশঙ্কা থেকে তারা বদরুজ্জামানের বিরুদ্ধেও লেখা চুরির অভিযোগ এনেছেন।’ 

আফজাল হোসেনের অভিযোগ, ‘‘নুসরাত জাহান ও রুহুল আমিনের লেখা ‘সাস্টেইনেবল ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইমপেরিক্যাল স্ট্যাডি অন সিলেট’ নিবন্ধের ৩৯ শতাংশ, রুহুল আমিন ও বিপ্লব রায়ের লেখা ‘ফ্যাক্টরস ইনফ্লুয়েন্সিং ট্যুরিস্ট পারসেপশন টুওয়ার্ডস বাংলাদেশি ফুডস’ নিবন্ধের ৩৭ শতাংশে প্লেজারিজম রয়েছে।’’ তার অভিযোগ, ‘রুহুল আমিন ও নুসরাত জাহান একই বিষয় নিয়ে দু’টি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। একই বিষয়বস্তু নিয়ে এই দুই শিক্ষকের লেখা নিবন্ধ দু’টি হলো ‘ডমেস্টিক ট্যুরিস্ট মাইন্ডসেট রেসপন্সেবল ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট: এ কেইস স্ট্যাডি অন কক্সবাজার, বাংলাদেশ’ ও ‘বাংলাদেশি ট্যুরিস্ট এটিচিউট টুওয়ার্ডস দেয়ার ইকনোমি রেসপন্সিবিলিটি’। নিবন্ধ দু’টির  ৭৯ শতাংশই হুবহু একই। এই দু’টি লেখা বিদেশি জার্নালে প্রকাশ করেছেন।’

অভিযোগের বিষয়ে গত ২৯ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) বাংলা ট্রিবিউনকে শিক্ষক রুহুল আমিন বলেছিলেন, ‘আফজাল হোসেন আমাদের বিরুদ্ধে লেখা চুরির যে অভিযোগ করেছেন, তা ঠিক নয়। কারণ, আমি ও নুসরাত জাহান যত নিবন্ধ লিখেছি, সব নিবন্ধেই যথাযথভাবে সাইটেশন ও রেফারেন্স করা আছে। আমাদের লেখাগুলো পর্যালোচনা করলেও তাই পাবেন। কিভাবে একটি নিবন্ধ সাইটেশন করতে হয়, তা আমরা জানি। আমরা বিদেশ থেকে লেখাপড়া করে এসেছি।’

তাহলে কেন অভিযোগ করা হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে রুহুল আমিন বলেন, ‘এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমাদের ২০ সেপ্টেম্বর পদোন্নতির ভাইভা ছিল, সেই পদোন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করতেই আফজাল হোসেন এমন অভিযোগ করেছেন। এছাড়া আরও সমস্যা রয়েছে। ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে।  ওই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চেয়ারম্যানশিপ ছেড়ে দেন তিনি। ওই সময় আমরা তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলাম। কোনও অন্যায়ের সামনে মাথা নত করিনি। তখন তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলেন। ২০১৫ সালে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়েও নানা অপকর্মের দায়ে তার চাকরি চলে যায়। এসব কারণেই আমাদের ওপর তার ক্ষোভ। এছাড়া আমার স্ত্রী নুসরাত জাহান সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের পক্ষে থেকে সিনেট নির্বাচন করেছেন, তারও একটা প্রভাব এখানে থাকতে পারে।’

কিন্তু আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরপরই নুসরাত জাহান কেন বদরুজ্জামানের ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে  রুহুল আমিন বলেন, ‘মূলত বিভাগীয় শিক্ষক আফজাল হোসেন ও বদরুজ্জামানের সম্পর্ক খুবই ভালো। সেক্ষেত্রে এমন হতে পারে, বদরুজ্জামান নিজে অভিযোগটি না করে আফজাল হোসেনকে দিয়ে করিয়েছেন। এছাড়া সিলেকশনের দিনই একটি মাধ্যমে আমরা ধারণা পেয়েছিলাম, হয়ত বদরুজ্জামানকে সিলেকশন বোর্ড পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করেছে। তবে তা সত্যও হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে।’

শিক্ষক রুহুল আমিন আরও বলেন, ‘বদরুজ্জামানের অ্যাওয়ার্ডেড পিএইচডি থিসিসেরও কিছু জায়গায় লেখা চুরি করেছেন, এমন তথ্য আছে বলে দাবি করেছেন নুসরাত জাহান। ফলে, নুসরাত মনে করেছেন, বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো উচিত। তাই তিনি একজন সিনেটর হিসেবে থিসিসটি রিচেক করে দেখার জন্য বলেছেন।’

‘বাংলাদেশি ট্যুরিস্ট এটিচিউট টুওয়ার্ডস দেয়ার ইকনোমি রেসপন্সিবিলিটি’ শীর্ষক নিবন্ধের একপৃষ্ঠা

তবে কোন কোন নিবন্ধ থেকে বদরুজ্জামান লেখা চুরি করেছেন, সে বিষয়টি স্পষ্ট না করেই শিক্ষক নুসরাত জাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,  ‘মে মাসের দিকে আমার কাছে একটি চিঠি আসে। সেখানে বদরুজ্জামানের পিএইচডি থিসিসের কিছু অসঙ্গতির প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। সেটাই আমি হত ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আমি একজন সিনেটর হিসেবে দায়িত্বের জায়গা থেকে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে দেখবে।’

মে মাসে চিঠি এলো। এরপর ৩ মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেলো। এতদিন পর কেন অভিযোগ করলেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি প্রথমে এটা খুব একটা পাত্তা দেইনি। মনে হয়েছে যে, যা হওয়ার হয়েছে তার তো পিএইচডি অ্যাওয়ার্ডেডও হয়ে গেছে তখন। তাই ওটা নিয়ে তখন আর কিছু করিনি। কিন্তু এতদিন পর মনে হলো, সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন করা উচিত। এটা রীতিমতো অন্যায়। তাই আর চুপ করে থাকতে পারলাম না।’

এদিকে শিক্ষক বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমার বিভাগের একজন সিনিয়র শিক্ষক রুহুল আমিন ও নুসরাত জাহানের বিরুদ্ধে লেখা চুরির অভিযোগ করেছেন। আমি পিএইচডি করেছিলাম চার বছর আগে। শেষ করে সেই থিসিস অ্যাওয়ার্ডেড হয়েছে, তাও একবছর হলো। কোথাও কোনও সমস্যা থাকলে তো কর্তৃপক্ষ অ্যাওয়ার্ড দিতেন না। তবে যাই হোক, আমার আত্মবিশ্বাস রয়েছে,  থিসিসে কোথাও কোনও সমস্যা নেই।’ তিনি বলেন, ‘যেদিন ভাইভা হয়েছে, ঠিক তার পরদিন তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটা করেছেন। আমার ধারণা, সিলেকশন বোর্ড হয়তো প্রমোশনের জন্য আমার দিকেই পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছিল। এটা ঠেকানোর জন্যই তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন বলে আমার মনে হয়। এছাড়া আর কোনও কারণ নেই।’

উল্লেখ্য, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সামিয়া রহমান ও মাহফুজুল হক মারজান এবং ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের রুহুল আমিন, নুসরাত জাহান ও বদরুজ্জামান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধ লেখা চুরির অভিযোগ ওঠে। ওই অভিযোগ তদন্তের জন্য গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাসরিন আহমাদকে প্রধান করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট দু’টি কমিটি গঠন করে দেয় বিশ্বিবিদ্যালয় সিন্ডিকেট। কমিটিকে চার সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়।  

 

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা