X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুদের মেরুদণ্ডের ব্যথার কারণ স্কুলব্যাগ!

জাকিয়া আহমেদ
১৬ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:৫৩আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০১৭, ২০:৫৭

 

ভারী স্কুলব্যাগ কাঁধে শিশুরা (ছবি- সংগৃহীত)

‘স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারী, আমরা কী আর বইতে পারি, এও কি একটা শাস্তি নয়। কষ্ট, কষ্ট হয়। আমার কষ্ট বুঝতে চাও, দোহাই পড়ার চাপ কমাও -কষ্ট হয়, কষ্ট হয়।’  শিল্পী কবির সুমনের একটি গানের কথা এগুলো। তবে এ গানটি কেবল গানই নয়,এ  কথাগুলো সত্যি হয়ে এসেছে বর্তমান প্রজন্মের শিশুদের ক্ষেত্রেও।

বই-খাতার চাপে শিশুদের স্কুলব্যাগ দিনকে দিন ভারী হচ্ছে। ভারী ব্যাগ নিয়ে শিশুরা নুয়ে পড়ছে। বাঁকা হয়ে যাচ্ছে তাদের পিঠ। স্কুলব্যাগ নিয়ে সরকারি, বেসরকারি, বাংলা ও ইংলিশ মিডিয়াম- এই তিন মাধ্যমের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা সবাই জানালেন, ভারী ব্যাগের কারণে শিশুরা নানা ধরনের জটিলতায় ভুগছে। আর চিকিৎসকরা বলছেন,কেবল তাৎক্ষণিকভাবে শারীরিক অসুবিধাই নয়,স্কুলের ভারী ব্যাগ সারাজীবনের জন্য শারীরিকভাবে অসুস্থ করছে শিশুদের। ভারী স্কুলব্যাগের কারণে শিশুদের ব্যাক পেইন ও মেরুদণ্ডের ব্যথায় ভোগার আশঙ্কা বাড়ছে।

এদিকে,বাংলাদেশে ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর শিশুর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহন না করার নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। কিন্তু সেই নির্দেশনার পরও শিশুদের ভারী ব্যাগের ওজন কমতে দেখা যায়নি। বরং ব্যাগের ওজন বেড়েই চলেছে।

জানা যায়, চলতি বছর ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্য সরকার শিশুদের ব্যাগের ওজন বিষয়ে একটি নির্দেশনা দিয়েছে।ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টু পর্যন্ত শিশুদের ব্যাগের ওজন হবে এক দশমিক পাঁচ কেজি, ক্লাস থ্রি থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত এই ওজন হবে দুই দশমিক তিন কেজি, ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত হবে চার কেজি, ক্লাস এইট থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত হবে চার দশমিক পাঁচ কেজি এবং ক্লাস টেইন এর শিক্ষার্থীদের ব্যাগের এর ওজন হবে পাঁচ কেজি।

রাজধানীর ফার্মগেটে অবস্থিত একটি সরকারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জারার মা জান্নাতুল ফেরদৌসী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলা, ইংরেজি, অংক, সমাজ, বিজ্ঞান, ধর্ম -এই ছয়টি বই,সঙ্গে ছয়টি খাতা।এর সঙ্গে যোগ হয় পানির পট, আর টিফিন বক্স। এসব মিলে পিঠের ভারী ব্যাগটি  তখন শিশুর শরীরের ওজনের চেয়েও বেশি মনে হয়।’ স্কুল ব্যাগের প্রভাব সম্পর্কে তিনি জানান, ‘আমার মেয়েটি ফার্মগেট ওভার ব্রিজ যখন পার হয়, তখন ব্যাগের ভারে সে কুঁজো হয়ে যায়। পিঠটা বাঁকা হয়ে যায়। ব্রিজের মাঝপথেই থেমে বলে, ‘আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। একটু জিরিয়ে নেই।’ আর রাতের বেলায় তার একটাই আব্দার থাকে, ‘মা, পিঠে আর ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দাও। পিঠে মালিশ করে দাও। ’

জান্নাতুল ফেরদৌসী বলেন, ‘কোনও বাচ্চা যদি অ্যাসেম্বলির ঠিক আগ মুহূর্তে স্কুলে পৌঁছায়, তখন সেই ভারী স্কুল ব্যাগ নিয়েই তাকে অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়াতে হয়। এমনকি দুই-তিন তলা সিঁড়ি ভেঙে ক্লাসে যেতে হয়। এত ভারী ব্যাগের কারণে শিশুদের শারীরিকভাবে সারাজীবনের জন্য আমরা বোঝা করে দিচ্ছি। গাদা গাদা বইয়ের এই সংস্কৃতি থেকে শিশুদের রেহাই দেওয়া উচিত।’

অপরদিকে, রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অবস্থিত একটি বেসরকারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সানিলার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার বইয়ের সংখ্যা মোট ১২টি। এর মধ্যে রয়েছে- বাংলা, ইংরেজি, অংক, সমাজ, বিজ্ঞান, ধর্ম, অ্যাকটিভ ইংরেজি দু’টি, আনন্দ পাঠ একটি, অংক শেখার বই একটি, ইংলিশ অক্সফোর্ড রিডিং সার্কেল, ইংলিশ হ্যান্ড রাইটিং বই। এরসঙ্গে বাংলা, ইংরেজি, অংক, ধর্ম, সমাজ ও বিজ্ঞান বিষয়ের জন্য দুটি করে খাতা রয়েছে। অর্থাৎ বই ও খাতা মিলে মোট ২৪টি। প্রতিদিন ২৪টি বই-খাতা বহন করতে না হলেও সানিলাকে প্রায় প্রতিদিনই অর্ধেকের বেশি বই খাতা বহন করতে হয়। সানিলার মা শিপ্রা জাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৯ বছর বয়সী একটি শিশুর পক্ষে এই বইখাতার ওজন বহন করা কী করে সম্ভব। আমার মেয়ের ওজনের চেয়ে তার ব্যাগের ওজন বেশি। আর বই খাতার সঙ্গে তো ব্যাগে আরও থাকে পানির পট এবং টিফিন বক্স।’ সানিলা বাংলা ট্রিবিউনকে বলে, ‘আমার ব্যাগ নিতে ইচ্ছে করে না। পিঠ ব্যথা হয়ে যায়।’

ধানমন্ডি সাত নম্বর সড়কে অবস্থিত একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থী পারিসার বয়স ৯ বছর। প্রতিদিন তার সাতটি করে ক্লাস হয়। সাত ক্লাসের জন্য প্রতিদিন ব্যাগে করে তাকে সাতটি বই ও সাতটি খাতা নিতে হয়। সঙ্গে ব্যাগে থাকে ডায়েরি, পানির পট এবং টিফিন বক্স। পারিসার মা শাহিন আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শরীরের চেয়ে ভারী বলে আমি মেয়েকে ব্যাগ বহন করতে দেই না। আমার মা কিংবা ভাই প্রতিদিন  তাকে স্কুলে আনা- নেওয়ার কাজ করে। চলতি বছর থেকে তার ক্লাস গ্রাউন্ড ফ্লোরে হওয়াতে কষ্ট কিছুটা কম হলেও, গত কয়েক বছর ভারী ব্যাগ নিয়েই তাকে স্কুলের ওপরের ফ্লোরে উঠতে হয়েছে। সেই কষ্টটা একটু কমেছে। তবে নয় বছর বয়সেই মেয়ের ব্যাক পেইন শুরু হয়েছে, যেটা সারাজীবনই হয়তো তাকে বয়ে বেড়াতে হবে।’

ভারী ব্যাগের কারণে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের ব্যাক পেইন বা মেরুদণ্ডের ব্যথায় ভোগার আশঙ্কা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কত শতাংশ শিশু স্কুলের ভারী ব্যাগের কারণে ব্যাক পেইনে ভুগছে, সে বিষয়ে কোনও জরিপ না থাকলেও, এ নিয়ে কাজ হচ্ছে বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মশিউর রহমান খসরু। তিনি জানান, ‘তার দুটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ বিষয়ে একটি গবেষণা করছেন। যদিও এখনও এ কাজ শেষ করতে পারেননি। তবে আগামী দুই থেকে তিন মাসের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ এ গবেষণাটি তারা শেষ করবেন এবং ফলাফল জানাবেন।

প্রতিদিনই দুই থেকে তিন জন করে শিশু ঘাড় এবং পিঠের ব্যথা নিয়ে তার কাছে আসে জানিয়ে ডা. মশিউর রহমান খসরু বলেন, ‘প্রতিমাসে আমার কাছেই গড়ে আসছে ৫০ থেকে ৬০ জন শিশু।  অন্যান্য যারা চিকিৎসক রয়েছেন, তাদের কাছেও প্রতিদিনই শিশুরা আসছে বলে আমরা জানি।’

ভারী স্কুল ব্যাগ বহনের কারণে তাদের পিঠে ও ঘাড়ে চাপ পড়ছে জানিয়ে ডা. খসরু বলেন, ‘এভাবে শিশুরা যদি ছোটবেলা থেকেই ভার বহন করে, তাহলে তাদের বাঁকা হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।  তাদের ‘অস্থি-মাসলে’ যে ‘স্ট্রেনথ’ তার থাকার কথা, সেটা কমে যায় একেবারেই।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ কে এম সালেক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশু রোগীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিনই হাসপাতাল ও চেম্বারে এ ধরনের শিশুরা আসছে ঘাড় এবং পিঠের ব্যথা নিয়ে।’  ভারী ব্যাগ কেবল শিশুদের শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এসব শিশুরা স্কুল ব্যাগের বিষয়ে কথা বলতে ভয় পায়। তারা যখন তাদের সমস্যার কথা বলে, তখন  তাদের চোখে ভয় দেখি। আর এত ছোট বয়স থেকেই যদি এসব শিশু পিঠের এবং ঘাড়ের ব্যথায় ভুগতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে এদের ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে যাবে। এটা কতখানি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তা নিয়ে আমি শঙ্কিত। একটি সুস্থ ভবিষ্যত প্রজন্ম যদি আমরা পেতে চাই, তাহলে ভারী স্কুল ব্যাগ থেকে শিশুদের নিস্তার দিতে হবে। নয়তো আজকে যারা ভারী ব্যাগ নিয়ে পড়াশোনা করছে, তাদের শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষ বলতে পারবো না।’

জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভারী ব্যাগ কেবল শারীরিকভাবেই না মানসিকভাবেও চাপে ফেলছে শিশুদের। শিশুরা শ্রেণিভেদে ২০ থেকে ২৫ কেজি ওজন বয়ে বেড়াচ্ছে, যেখানে পাঁচ বছরের একটি ছেলেশিশুর জন্য আদর্শ ওজন হচ্ছে ১৮ দশমিক ৭ কেজি। আর মেয়েশিশুর জন্য ১৭ দশমিক ৭ কেজি। এই হিসেবে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন হওয়ার কথা খুব বেশি হলে দুই কেজি।’

কেবল ঘাড় এবং  পিঠই নয়, শিশুদের হাঁটুর ওপরও চাপ পড়ে জানিয়ে ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, ‘যেহেতু পুরো শরীরের ভার পায়ের ওপর পরে, তাই হাঁটুর ওপর চাপ পরে বেশি।যেটা তাকে সারাজীবন হাঁটুর সমস্যায় ভোগাবে। আর ঘাড় ও পিঠের ব্যথাতো রয়েছেই। এসব সমস্যা যদি ছোটবেলা থেকেই একজন মানুষকে ফেস করতে হয়, তাহলে সারাজীবন তার এ থেকে রেহাই হয় না, এগুলো সারাজীবন ভুগে যেতে হয়।’ একটি সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পেতে আমাদেরকে শিশুদের ওপর থেকে বই-খাতার ভার কমাতে হবে। তাদের মানসিক এবং শারীরিকভাবে বেড়ে উঠতে দিতে হবে। তাহলেই আমরা সুস্থ ভবিষ্যৎ পাবো বলে জানান ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার।

 

 

 

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী