X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের নয়, ‘অপপ্রচারকারীদের’ খুঁজছে ঢাবি প্রশাসন

রশিদ আল রুহানী ও রাফসান জানি
২২ অক্টোবর ২০১৭, ২৩:৩৭আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০১৭, ০২:০৯

ঢাবি ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন (বাঁয়ে) ও ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পরীক্ষা শুরুর আট ঘণ্টা আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের(ঢাবি) ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও বিষয়টি অস্বীকার করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাদের দাবি, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। একটি অশুভ চক্র প্রশ্নফাঁসের অপপ্রচার চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টা করছি। প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের পরিবর্তে তাই যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টা করছে, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসন।
এদিকে, ভর্তি পরিক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে শিক্ষার্থীদের কয়েকটি সংগঠনের নেতারা ফল বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হলেও এ নিয়ে রা কাড়ছেন না শিক্ষকরা। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
গত ২০ অক্টোবর সকাল ১০টায় ঢাবিতে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ‘ঘ’ ইউনিটের অধীনে প্রথম বর্ষ (স্নাতক) সম্মান শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা শুরু অন্তত আট ঘণ্টা আগে বাংলা ট্রিবিউন প্রতিবেদকের কাছে প্রশ্নপত্রের কপি আসে। ওই প্রশ্নপত্রেই ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও বরাবরই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি বলে দাবি করে আসছে ঢাবি প্রশাসন। উপরন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়ায় ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল স্থগিত ও পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে রবিবার (২২ অক্টোবর) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও উপাচর্যের কার্যালয়ে বিক্ষোভ করে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। তারা মিছিল নিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানের কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থান নেন। কিছু সময় পর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন নবনিযুক্ত প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী। কিন্তু তার সঙ্গে কথা না বলে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে চান আন্দোলনকারীরা। এরই মধ্যে উপাচার্যের কক্ষে প্রবেশ করেন ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান। সঙ্গে ছিলেন বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। পরে নিজ কক্ষ থেকে বের হয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন উপাচার্য।
এসময় উপাচার্য আন্দোলনকারীদের বলেন, ‘যে ফলাফল তৈরি হয়েছে, তাতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনও ইঙ্গিত দেখি না। আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করা হয়নি। এরা জালিয়াত চক্র, যারা ডিভাইস সরবরাহে জড়িত ছিল। তাদের সঙ্গে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি সম্পর্কিত নয়।’
তাহলে পরীক্ষা চলাকালে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে আটক শিক্ষার্থীরা ডিভাইস দিয়ে কী করছিল, এমন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, ‘ওরা বাইরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল। এছাড়া এটা দিয়ে কী কাজ করা হয়, আমি তো সেটা ব্যবহার করে দেখিনি।’
কোনও হার্ড এভিডেন্স না থাকায় পরীক্ষা বাতিল করা সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি করেন উপাচার্য। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা তাৎক্ষণিক বাতিল করতাম। কিন্তু আমি শুক্রবার পৌনে ২টার সময় জানতে পেরেছি, প্রশ্নপত্র নাকি ফাঁস হয়েছে। সারাদিন ক্যাম্পাসে ঘুরলাম, পরীক্ষা কেন্দ্রে গেলাম; কোথাও কোনও অভিযোগ পেলাম না। প্রায় এক লাখ ছেলে পরীক্ষা দিলো, কেউ কিছু বললো না। আর একটি অশুভ চক্র এই তথ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চাচ্ছে। আমার কাছে হার্ড এভিডেন্স থাকলে আমি পরীক্ষা বাতিল করতাম। পরীক্ষা শুরুর আধাঘণ্টা আগেও হলেও পরীক্ষা বাতিল করতাম।’
পরীক্ষা বাতিল না কারণ হিসেবে সাইবার বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘পরীক্ষা বাতিল না করার কারণ আছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। রাত ২টা ৫৫ মিনিট বা ৩টা ১৯ মিনিটের সময় প্রশ্নের ইমেজ ফাঁস হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের কাছে জানতে চাইলাম, এটা কিভাবে সম্ভব? তারা বললেন, প্রযুক্তির অপব্যবহার করে এটা করা সম্ভব। তখন আমরা দেখলাম, লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে খেলা করার অধিকার উপাচার্যের নাই। কোনও হার্ড এভিডেন্স ছাড়া পরীক্ষা বাতিল করার কোনও অধিকার আমাদের নেই। গোয়েন্দারা আমাদের জানিয়েছে, এই প্রশ্নপত্র আগে ফাঁস হয়নি। যে ছবি দেখানো হচ্ছে, তা পরীক্ষা হল থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। এর প্রভাব পরীক্ষার্থীদের ওপর পড়েনি। প্রায় এক লাখ পরীক্ষার্থীর জীবন নিয়ে তো আমরা খেলতে পারি না।’
অপপ্রচারকারী অশুভ চক্রকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হবে উল্লেখ করে ভিসি আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম টিমের সঙ্গে কথা বলেছি। কিছু কিছু ক্লু পাচ্ছি। কারা এই অশুভ চক্র, কারা এই প্রশ্নের ছবি প্রকাশ করলো— তা দেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির বাইরে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও তদন্ত করছে। আমরা কাউকে ছাড় দেবো না।’
পরে আন্দোলনকারীদের ফল স্থগিতের দাবি উপেক্ষা করেই ‘ঘ’ ইউনিটের ফল প্রকাশ করা হয়। এসময় সাংবাদিকরা উপাচার্যকে বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে। তদন্তে এটি প্রমাণিত হলে কি পরীক্ষা বাতিল করবেন?’
প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে উপাচার্য বলেন, ‘কিছু কিছু তথ্য পাচ্ছি। অশুভ শক্তি ছাত্রদের উসকে দিচ্ছে। তারা জাতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চাচ্ছে। তাদের আমরা খুঁজে বের করছি। প্রশ্নপত্র আগে ফাঁস হয়নি। প্রশ্ন পরীক্ষা শুরুর পর, অর্থাৎ সকাল ১০টার পরে প্রশ্ন আউট হয়েছে।’
ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হয়েছে— এমন অপপ্রচার যারা চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান উপাচার্য। এ বিষয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। কোনও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি— এই মর্মে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটি ইনচার্জ কামরুল আহসান সাধারণ ডায়েরি করেছেন। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় কোনও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। একটি চক্র প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে— এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
প্রশ্নফাঁস ইস্যুতে শিক্ষার্থীরা সরব হলেও নিরব শিক্ষকরা
প্রশ্নফাঁসের তথ্যপ্রমাণসহ গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরও শিক্ষক নেতারা তা নিয়ে টুঁ শব্দ করছেন না বলে অসন্তোষ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যেকোনও অন্যায় হলে তারা রাস্তায় নামেন। যৌক্তিক আন্দোলনে শিক্ষার্থীরাও সমর্থন দেয়। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের মত ন্যাক্কারজনক ঘটনায় শিক্ষক নেতারা নিরব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক উম্মে হাবিবা বেনজির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। শিক্ষকদেরও জড়িত থাকার সম্ভবনা রয়েছে। ঠিকমতো তদন্ত করলে তা হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে। এছাড়া তাদের চুপচাপ থাকার আর কী কারণ থাকতে পারে? অন্তত শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি আসা উচিত ছিল। কিন্তু তারা নিরব।’
এ বিষয়ে শিক্ষক নেতাদের অবস্থান জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেহেতু উপাচার্য ও ডিন একটি অবস্থান জানিয়েছেন, সেখানে আমাদের আলাদা করে কিছু বলার নেই। তাছাড়া আজ (রবিবার) ফল দিয়েছে, তারা ফলাফল অ্যানালাইসি করেছে। প্রশ্নফাঁস হলে ফলাফলে যেমন প্রভাব থাকার কথা, তেমন দেখা যায়নি বলেই আমি জেনেছি।’
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক রহমত উল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ও তার তদন্ত নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। এটা শিক্ষক সমিতির কনসার্ন নয়। এটা অভিযোগকারী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যাপার। অভিযোগ এলে প্রশাসনই তা খতিয়ে দেখবে।’
তবে বিচ্ছিন্নভাবে দুয়েকজন শিক্ষকও প্রশ্নফাঁস নিয়ে কথা বলছেন। ঢাবি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদুল হক তার নিজের ফেসবুক ওয়ালে এই ঘটনার সঠিক তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমার দাবি, কোন উৎস থেকে রাতের বেলা এই মেইল সাংবাদিকদের কাছে গেল, তা বের করতে হবে। প্রয়োজনে বিটিআরসির (টেলিকম নিয়ন্ত্রণ সংস্থা) সাহায্য নিয়ে মেইল অ্যাড্রেসের পেছনে কারা রয়েছে, তা খুঁজে বের করে দোষীকে শাস্তি দিতে হবে। প্রশ্নফাঁসের কবলে পড়ে সব পাবলিক পরীক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলো এসবের ঊর্ধ্বে ছিল। তাও নষ্ট হবার জোগাড়। এটা হতে দেওয়া যাবে না।’
আরও পড়ুন-
প্রশ্নপত্র ফাঁস: ঢাবির ‘ঘ’ ইউনিটে ফের পরীক্ষা চান ভর্তিচ্ছুরা

/টিআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা