X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

সপ্তাহে ১৫ কেজি স্বর্ণ আনতো তিন ভাইয়ের সিন্ডিকেট

নুরুজ্জামান লাবু
২৬ অক্টোবর ২০১৭, ২২:০৫আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০১৭, ২৩:১৬

স্বর্ণের বার

মাসুদ করিম রানা, ফারুক আহম্মেদ ও রহমত বারী, আপন তিন ভাই তারা। মাসুদ এক সময় দুবাইয়ে থাকতো। সেখান থেকেই স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাত মেলায় সে। দেশে ফিরে এসে দুই ভাইকে নিয়ে নিজেই গড়ে তোলে স্বর্ণ চোরাচালানের সিন্ডিকেট। গত তিন বছর ধরে অবৈধভাবে  স্বর্ণ আনছে এই সিন্ডিকেট।  দুই-তিনটি স্বর্ণের চালানে সপ্তাহে গড়ে ১৫ কেজি স্বর্ণ আনতো তারা। এসব স্বর্ণের কিছু অংশ বিক্রি করতো দেশীয় বাজারে। বাকিটা পাঠিয়ে দেওয়া হতো প্রতিবেশী দেশ ভারতে।

তিন ভাইয়ের এই চক্রের দুই সহযোগীসহ এক ভাইকে গ্রেফতারের পর বেড়িয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। বিমান বাংলাদেশ ও বেসরকারি এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রু, কর্মী ও বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ কেউ যুক্ত এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা কিভাবে এবং কার মাধ্যমে বিমানবন্দর থেকে চোরাচালানের স্বর্ণ বাইরে নিয়ে আসতো তা জানিয়েছে।

গত মঙ্গলবার রাতে ৯ কেজি ওজনের ৮০টি স্বর্ণের বারসহ তিন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলো- ফারুক আহম্মেদ, মীর হোসেন ও শাহীন। অবৈধ স্বর্ণ বহনের অভিযোগে তাদের কাছ থেকে একটি প্রাইভেট কারও (ঢাকা মেট্রো গ-২২-১৪৪৯) জব্দ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) তাদের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় ডিবির এসআই নূর আলম সিদ্দিক বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। একই দিনে তাদের আদালতে হাজির করে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) শেখ নাজমুল হোসেন বলেন, ‘এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। অনেকদিন ধরে তারা এ কাজ করে আসলেও এবারই প্রথম ধরা পড়েছে। এই স্বর্ণ চোরাকারবারী সিন্ডিকেটে আরও অনেকেই জড়িত। আমরা তাদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।’

ডিবি সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার ব্যক্তিরা জানিয়েছে, তারা এর আগে গত ২২ অক্টোবর ৪৫ পিস ও ২১ অক্টোবর ৬০ পিস স্বর্ণের বার নিয়ে আসে।  চক্রটি প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনটি স্বর্ণের চালান নিয়ে আসে। প্রতি চালানে ৪৫ থেকে ১০০ পিস স্বর্ণের বার আনতো। দুবাই ছাড়াও মাসকট, জেদ্দা ও কুয়লালামপুর থেকে নিয়মিত স্বর্ণ আনতো। বাংলাদেশ বিমান ও রিজেন্ট এয়ার লাইন্সসহ অন্যান্য এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটেও তারা স্বর্ণের বার আনতো।

জিজ্ঞাসাবাদে তিন ভাইয়ের মধ্যে গ্রেফতার হওয়া ফারুক আহম্মেদ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তার ভাই মাসুদ করিম রানা আন্তর্জাতিক চোরাকারবারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। দুবাই, জেদ্দা বা কুয়ালালামপুর থেকে স্বর্ণের বার আনার সময় ওই দেশের সিন্ডিকেট সদস্যরা বিমান পর্যন্ত স্বর্ণের বারগুলো পৌঁছে দেয়। একজন এয়ারহোস্টেস কৌশলে তা কোনও একটি সিটের নিচে রাখে। ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছার পর ক্যাটারিং সার্ভিস ও ক্লিনিং সার্ভিসের নির্দিষ্ট লোককে সিট নম্বরটি বলে দেওয়া হয়। তারা ময়লার বা ক্যাটারিং সার্ভিসের ট্রাকে করে স্বর্ণের বারগুলো আট  নম্বর হ্যাঙ্গার দিয়ে বাইরে বের করে আনে। সেখান থেকে হাত বদল হয়ে স্বর্ণের বার চলে যায় নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে।

তিন ভাইয়ের চক্রের সঙ্গে আরও যারা জড়িত

তিন ভাইয়ের এই স্বর্ণ চোরাকারবারী সিন্ডিকেটের সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স,রিজেন্ট এয়ারসহ আরও কয়েকটি এয়ারলাইন্সের কর্মী ও এয়ার হোস্টেসরা একাজে জড়িত। তাদের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ বিমানের এয়ারক্রাফট সুপার হিসেবে কর্মরত মুরাদ, মানিক ও আজাদ। রিজেন্ট এয়ারলাইন্সের এয়ারহোস্টেস মিশু, তাঁতী বাজারের দুই স্বর্ণ ব্যবসায়ী লালশ্যাম ও বিজয়, ১৮/ডি আশকোনার বাসিন্দা রেজা, আজমীর, দিনেশ ওরফে দিনাজ, রিয়াজ, আমজাদ, রফিক ও মফিজ।

ডিবি সূত্র জানায়, স্বর্ণ চোরাচালান এই চক্রের তিন ভাইয়ের বাবার নাম সেকেন্দার আলী। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং থানাধীন ধর্মনগর এলাকায়। ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ‘জি’ ব্লকের ২১ নম্বর সড়কের ৮২০ নম্বর বাসায় থাকে তারা।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বিমানবন্দর জোনাল টিমের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মহররম আলী বলেন, ‘এই চক্রের সঙ্গে আরও অনেকেই জড়িত রয়েছে। সবার বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে। প্রত্যেকের পরিচয় শনাক্তের পর তাদের আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।

চোরকারবারীদের যোগাযোগ সিক্রেট অ্যাপসে

জঙ্গিদের মতো এখন চোরাকারবারীরাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে সিক্রেট অ্যাপসের মাধ্যমে পারস্পারিক যোগাযোগ করছে। মঙ্গলবার গ্রেফতার হওয়া তিন স্বর্ণ চোরাকারবারীর কাছ থেকে যে তিনটি মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে, সেসব মোবাইলে কোনও কল রেকর্ড নেই। মোবাইলগুলো দিয়ে কেবল সিক্রেট অ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়। চোরাকারবারীরা এক্ষেত্রে  ‘উই চ্যাট’ নামে একটি অ্যাপস ব্যবহার করেছে। ডিবি’র একজন কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিতে চোরাকারবারীরা এখন সতর্কতা অবলম্বন করছে। একারণেই মোবাইল ফোন বাদ দিয়ে তারা চোরাকারবারের বিষয়ে সিক্রেট অ্যাপসের মাধ্যমে আলোচনা  করছে।

বিমান ও রিজেন্ট এয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি

স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করছেন এমন পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের ক্ষেত্রে এখানকার কিছু  অসাধু লোকজনের পাশাপাশি বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের এয়ার হোস্টেস ও কর্মীরা জড়িত থাকে। কারণ, বিমানবন্দর এবং এয়ারলাইন্সের কর্মীদের সহায়তা ছাড়া কোনোভাবেই অবৈধ স্বর্ণের চালান বাইরে বের করে আনা সম্ভব নয়। এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে বিমান বাংলাদেশ ও রিজেন্ট এয়ারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সবচেয়ে বেশি।

ডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, বিমানের এয়ারহোস্টেস থেকে শুরু করে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংসহ বিভিন্ন শাখার অনেক কর্মীই স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। বেসরকারি এয়ারলাইন্সের ক্ষেত্রে রিজেন্ট এয়ারের মাধ্যমে বেশি চোরাচালানের স্বর্ণ আনা-নেওয়া করা হয় বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন: 

গাড়ি তল্লাশি করে ৯ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দুই চিকিৎসকের ওপর হামলার প্রতিবাদে হাসপাতালে কর্মবিরতির ঘোষণা
দুই চিকিৎসকের ওপর হামলার প্রতিবাদে হাসপাতালে কর্মবিরতির ঘোষণা
১৯টি সামরিক সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ, ২৭টি নিয়ে আলোচনা চলছে
১৯টি সামরিক সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ, ২৭টি নিয়ে আলোচনা চলছে
সালাউদ্দিনের ছেলের অভিষেকের দিনে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
সালাউদ্দিনের ছেলের অভিষেকের দিনে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
বৈধপথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধপথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার