উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও ভেঙে ফেলা হয়েছে খামারবাড়ির সেই ঐতিহ্যবাহী কৃষি গবেষণা ল্যাবরেটরি ভবনটি। অভিযোগ আছে, আদালতের নিষেধাজ্ঞার খবরে তাড়াহুড়ো করে ভবনটি আরও দ্রুত গতিতে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
রাজধানীর ফার্মগেটের খামারবাড়িতে কৃষি গবেষণার স্মৃতি জড়িত ল্যাবরেটরি ভবনসহ ওই এলাকার ঐতিহ্যবহনকারী যে কোনও ভবন ভাঙায় বুধবার (১ নভেম্বর) নিষেধাজ্ঞা জারি করেন হাইকোর্ট। এর আগে গত ২৮ অক্টোবর এ বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে রিট করা হলে আদালত মৌখিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাঙার কাজ স্থগিত রাখতে বলেন। কিন্তু এরপরই ভাঙার কাজ আরও গতিশীল হয় বলে দাবি করেন রিট আবেদনকারী আইনজীবী।
আর কর্মরত শ্রমিকরা বলছেন, গত শুক্র-শনিবারেই (২৭-২৮ অক্টোবর) ভবনের বেশিরভাগ ভাঙার কাজ শেষ হয়েছে।
যদিও ভাঙার কাজ শেষ হওয়ার পর রিট হওয়ায় কিছুই করার ছিল না বলে জানিয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব। আর রিটকারী আইনজীবী পাল্টা বলছেন, ‘রিট হয়েছে বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর)। আদেশ না আসা পর্যন্ত তাদের থেমে থাকার কথা জানাতে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকে জানানো হয়েছিল। অজ্ঞাত কোনও কারণে রিটের পর ভাঙার গতি বেড়ে যায়।’
হাইকোর্টের আদেশে ভবন ভাঙায় নিষেধাজ্ঞা জারির পাশাপাশি কৃষি গবেষণার স্মৃতি জড়িত ল্যাবরেটরি ভবন ভাঙা কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। একইসঙ্গে ভাঙা ভবনটি পুনর্নির্মাণ করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না এবং ঐতিহ্যবহনকারী ভবনের তালিকা প্রণয়ন করে, তা সংরক্ষেণের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়।
কিন্তু মন্ত্রণালয়ের দাবি, রিট হওয়ার আগেই ভবন ভাঙা সম্পন্ন হওয়ায় তাদের কিছুই করার নেই। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভবনটি ভাঙা শেষ হয়েছে। আমরা সব ফরমালিটিজ অনুসরণ করে ভবনটি ভেঙেছি। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিয়েই ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে ভবনটি ভাঙা হয়েছে। ভাঙার পরে রিট হলে তো আমরা কিছু করতে পারি না। দেখি, হাইকোর্ট কী বলেন।’
রিটকারী আইনজীবী আশিক আল জলিল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আবেদনে ভবনটিকে আগের অবস্থায় কেন নেওয়া হবে না, সেটার উল্লেখ ছিল। অন্যান্য দেশে ঐতিহ্য নিয়ে আন্দোলনের ইতিহাস বলছে, কর্তৃপক্ষ কিছু ভেঙে ফেললে ওই ইটের ওপর ইট দিয়ে আগের নকশায় পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। খামারবাড়িতে আরও দুটো এতিহ্যবাহী বিল্ডিং আছে। ওই দুটোর বিষয়েও আবেদনে বলা আছে।’
রিট পরে করা হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষের দাবির বিষয়ে তাকে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ভবন ভাঙার প্রতিবেদন দেখে আদালত মৌখিক আদেশ দিয়ে বলেছিলেন, আদেশের আগে যেন না ভাঙা হয়। সেসময় ২০ শতাংশ ভাঙা হয়েছিল। আদালতের আদেশ জানাতে যোগাযোগ করাও হয়েছিল অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে। কিন্তু পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে।’
এর ফলে আদালত অবমাননা হয়েছে কিনা প্রশ্নে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সে বিষয়ে এখনও ভাবছি না। কিন্তু পরের শুনানিতে এসব আসবে। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে যোগযোগ করা হয়েছিল কিনা, হলে কেন এত দ্রুততার সঙ্গে ভাঙা হলো এই বিষয়গুলোও আসবে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আদালত আমার আইন কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, আদেশ না হওয়া পর্যন্ত যেন ভবনটি ভাঙা না হয়, সেটি ইনফর্ম করতে। তাদের কথা হচ্ছে, এর আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভবনটি ধাক্কা দিলে ভেঙে যাবে, এরকম অবস্থা ছিল।’ আদালতের নির্দেশ মতো আদেশের আগে পর্যন্ত না ভাঙার বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তাদের ইনফর্ম করা হয়েছিল।’
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘এতিহ্যকে রক্ষা করতে হয়-এটা বলতে হবে কেন। তারপরও যখন ভেঙে ফেলতে দেখা গেলো, আমরা প্রতিবাদ করলাম। কিন্তু এতে করে যেন ভাঙার গতি বেড়ে গেল।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের কৃষি গবেষণার প্রথম ল্যাবরেটরি এই ভবনটি। ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিলো কারা খতিয়ে দেখা দরকার।’
শুরু থেকে এ ভবনটি ভাঙার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই ধরনের স্থাপনাগুলো দেশকে চিনতে পরবর্তী প্রজন্মকে সহায়তা করে। এসব দেখে দেখেই তারা জানবে কিভাবে একটি জাতি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে এবং প্রক্রিয়াটি কেমন ছিল। এখনতো ভেঙে ফেলাই হয়েছে। পাশের ভবনগুলো রক্ষা করা জরুরি। আর যেটি ভাঙা হয়েছে, সেটা নিয়েও পরিকল্পনা করা যেতে পারে। এধরনের স্থাপত্যগুলো সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, এ জাতি দেউলিয়া জাতি নয়।’
ছবি: নাসিরুল ইসলাম ও সাজ্জাদ হোসেইন