X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বহিষ্কৃত মেজর জিয়াকে ধরা পুলিশের জন্য কতটা চ্যালেঞ্জের

নুরুজ্জামান লাবু
১৬ নভেম্বর ২০১৭, ১২:৩২আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৭, ২১:৫০

বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় দুটি জঙ্গি সংঠনের একটি আনসার আল ইসলাম, যার শীর্ষ নেতা বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হককে ধরতে পারা পুলিশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেজর জিয়ার নেতৃত্বেই এখন আনসার আল ইসলাম সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আনসার আল ইসলাম এবং মেজর জিয়াই বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এজন্য জিয়াকে ধরা তাদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর ২০১১ সালের ডিসেম্বরে জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করার পর থেকেই সে পলাতক রয়েছে। প্রথম দিকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে তার যোগসূত্রের কথা বলা হলেও বর্তমানে সে আরেক নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ নেতা। নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর সংগঠনটি আনসার আল ইসলাম নামে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার অনুসারী এই সংগঠনটির বেশির ভাগ সদস্যই উচ্চশিক্ষিত এবং তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষভাবে দক্ষ। ফলে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

জঙ্গিবাদ দমনে গঠিত পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট- কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে যে দুটি জঙ্গি গোষ্ঠী বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তার একটি আইএস  অনুসারী নিও জেএমবি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে আনসার আল ইসলাম এমন পদ্ধতিতে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে, যাতে এই সংগঠনের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে আনা অনেকটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ হিসেবে তারা আনসার ইসলামের শীর্ষ নেতা বা সামরিক কমান্ডার জিয়ার ধূর্ত কিছু কৌশলের কথা বলছেন। কর্মকর্তাদের ভাষ্য, জিয়া একসময় সেনাবাহিনীর চৌকস একজন কর্মকর্তা ছিল। সামরিক প্রশিক্ষণ এবং নিত্য-নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে সে অনেক বেশি দক্ষ। নিজের দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগ করে সে তার সদস্যদেরও অনেক বেশি দক্ষ করার চেষ্টা করছে।

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তা এডিসি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, যিনি দীর্ঘ দিন ধরে জিয়া এবং আনসার আল ইসলাম বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখছেন। বিভিন্ন সময়ে আলাপচারিতায় তিনি এই প্রতিবেদককে বলেছেন, জিয়া অনেক বেশি ধূর্ত প্রকৃতির। সে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলে অনেক ভেবেচিন্তে। নিজের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করার পরই কেবল সে সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বা কারও আস্তানায় যায়।

সিটিটিসি’র এই কর্মকর্তা বলেন,‘জিয়া তার সংগঠনে অসংখ্য স্লিপার সেল গঠন করেছে। যারা ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে কাজ করে থাকে। একারণে কোনও একজন সদস্যকে গ্রেফতার করা গেলেও তার কাছ থেকে অন্যদের সম্পর্কে বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। এই কৌশলের মাধ্যমেই আনসার আল ইসলাম নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।’

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, যুক্ত হওয়ার পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামকে আরও বেশি সুসংগঠিত করেছে মেজর জিয়া। তাকে ধরতে গত বছরের ২ আগস্ট ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। আর এ বছর জিয়ার নেতৃত্বাধীন আনসার আল ইসলামকে নিষিদ্ধও ঘোষণা করা হয়েছে। মেজর জিয়া তার নিজের সামরিক প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে সদস্যদের ‘গেরিলা যোদ্ধা’ হিসেবে প্রস্তুত করছে। যাদের মূল লক্ষ্য হলো ‘টার্গেট কিলিং’, যা এই সংগঠনটি শুরু করেছিল চার বছর আগে ২০১৩ সালে ।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এই সংগঠনের টার্গেট গ্রুপ হলো ব্লগার, নাস্তিক, সেক্যুলার, রাজনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। এ পর্যন্ত তাদের এই টার্গেট ঠিক থাকলেও ভবিষ্যতে তারা আরও বেশি ধ্বংসাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পুলিশ কর্মকর্তাদের এ কথার যৌক্তিক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া আনসার আল  ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য আবু সিদ্দিক সোহেলের ভাষ্যে। সে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যায় অংশগ্রহণের কথা জানিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে সোহেল বলেছে, ‘...২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে সে (বহিষ্কৃত মেজর জিয়া) মেসেজ এর মাধ্যমে আমাকে বেসিক দাওরা কোর্স করার নির্দেশ দেয়। সেই মাসেই তার নির্দেশ মতো আমি একদিন হাজী ক্যাম্পের সামনে গেলে আবীর ভাই আমাকে রিসিভ করে দক্ষিণখানের একটি বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে আমি, সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, তালহা, হাবিব ওরফে মাসরুর দাওরা ট্রেনিং করি। ট্রেনিং করায় বড় ভাই মেজর জিয়া এবং আবীর ভাই। ট্রেনিংয়ের বিষয়বস্তু ছিল গেরিলা যুদ্ধের কৌশল, বাসা ভাড়া নেবার কৌশল, বাসায় বসবাসের নিয়ম, নিরাপত্তা কৌশল, কম্পিউটার চালনাসহ এলমি শিক্ষা।’

আনসার আল ইসলাম গত এক বছর ধরে আনসার আল  ইসলামের কার্যক্রম অনুসরণ করা সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা বলেন, তারা আনসার আল ইসলাম সদস্যদের ঢাকার অভিজাত এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর স্থানে রেকি করারও কিছু কিছু তথ্য পেয়েছেন। তবে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন সদস্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ এবং সংগঠিত হওয়ার দিকেই তাদের মনোযোগ বেশি। নিও জেএমবি’র গুলশান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে গ্রেফতার সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।

সিটিটিসি’র ওই কর্মকর্তা বলেছেন, আনসার আল  ইসলাম এমনভাবে সংগঠিত হচ্ছে যে, একেকজন সদস্য বা একেকটি স্লিপার সেল ধরে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একটি সেল ধ্বংস করলে বা আইনের আওতায় আনা হলেও আরও নতুন নতুন সেল তৈরি হচ্ছে। এজন্য এদের ‘মাথা’ অর্থাৎ মেজর জিয়াকে ধরাটাই মূল চ্যালেঞ্জ। জিয়াসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আইনের আওতায় আনতে পারলে স্লিপার সেলগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলছেন, আনসার আল  ইসলামের শীর্ষ নেতাদের ধরতে পারলে তারা একদিকে যেমন ওপর থেকে কোনও নির্দেশনা পাবে না, অন্যদিকে নিজেদের সাংগঠনিক কৌশল অনুযায়ী অন্য সেলগুলো সম্পর্কে জানা না থাকায়, সহজেই পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে না।

জিয়ার প্রশিক্ষণের কৌশলগুলো আসলে কী?

আনসার আল  ইসলামের গ্রেফতার হওয়া সদস্যরা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, তাদের সংগঠনে প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে মেজর জিয়া নিজেই সব প্রশিক্ষণে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। গেরিলা যুদ্ধের কৌশলের ওপর প্রশিক্ষণ বলতে স্লিপার সেল পদ্ধতিতে ইন্টেল গ্রুপ ও আসকারী গ্রুপের হামলা পদ্ধতি এবং অস্ত্র-চাপাতি চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ইন্টেল গ্রুপের কাজই হলো- কেবল টার্গেটেড ব্যক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেওয়া। আর আসকারী গ্রুপ সাধারণত অংশ নেয় সরাসরি কিলিং মিশনে। এসময় ইন্টেল গ্রুপ সাপোর্টিং গ্রুপ হিসেবেও কাজ করে।

সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া আবু সিদ্দিক সোহেল ও শাওন নামে আনসার আল ইসলামের মধ্যম সারির দু’জন সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা বলেন, নিও জেএমবি’র সাংগঠনিক কার্যক্রমের ঠিক উল্টো পদ্ধতি গ্রহণ করছে আনসার আল ইসলাম। বাসা ভাড়া নেওয়ার কৌশল হিসেবে সদস্যদের সব স্বাভাবিক নিয়ম অনুসরণ করতে বলা হয়, যাতে কোনোভাবেই বাড়িওয়ালা সন্দেহ না করেন। এমনকি বাসায় বসবাসের নিয়ম হিসেবে বাড়িওয়ালার সঙ্গে সুসম্পর্ক, বিভিন্ন সাফল্যের খবরের অজুহাতে মাসে একবার বাড়িওয়ালার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রয়োজনে বাড়িওয়ালার বাসায় মিষ্টি পাঠিয়ে সুসম্পর্ক নিশ্চিত করতেও বলা হয় সদস্যদের।

সিটিটিসি’র আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক কৌশলগুলো জেনে তারাও অবাক হয়েছেন। প্রশিক্ষণের সময় বলে দেওয়া হয়, তাদের সদস্যরা কখনও একসঙ্গে দু’জন অবস্থান করবে না। এমন ধরনের মেস বা বাসায় অবস্থান করবে, যেখানে বাকিরা সবাই সাধারণ। ঘরের বাইরে বের হওয়ার সময় ব্যাগে স্কুল বা কলেজের বইপত্র রাখতে হবে। যাতে সহজেই কেউ সন্দেহ করতে না পারে। কেবল সিক্রেট অ্যাপস বা প্রটেক্টেড টেক্সট নামে নিজেদের গ্রুপ মেসেজিংয়ে তথ্য আদান-প্রদান করতে হবে। সিটিটিসি’র ওই কর্মকর্তা জানান, সদস্যদের আপাতত কথিত হিজরত করতেও নিষেধ করা হচ্ছে। নতুন সদস্যদের প্রত্যেককেই নিজ বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ঠিক রাখারও পরামর্শ দেওয়া হয়, যাতে পরিবারের সদস্যরাও কোনোভাবে সন্দেহ না করে।

সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া আবু সোহেল সিদ্দিক পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, তাদের ‘বড় ভাই’ মেজর জিয়া সংগঠনের সব সদস্যের সঙ্গে সিক্রেট অ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকে। এমনকি প্রত্যেক সদস্যকে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেই অ্যাপসে হাজিরা দিতে হয়। এতে কারও ব্যত্যয় হলে প্রথমেই ধরে নেওয়া হয়- আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ধরে থাকতে পারে। তখন প্রাথমিকভাবে তার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে ইন্টেল গ্রুপ গোপনে তার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে থাকে। শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরই আবার তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হয়। তাদের বড় ভাই জিয়াও প্রতিটি মুভমেন্টের আগে নিরাপত্তার বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই কোথাও যাতায়াত করে থাকে।

আরও পড়ুন:
ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে বিব্রত আওয়ামী লীগ

/এপিএইচ/আপ-এসএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো