X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ি-মহল্লার নিরাপত্তায় বয়স্ক সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ কতটা নিরাপদ?

রাফসান জানি
১৭ নভেম্বর ২০১৭, ২১:৫৪আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:৩০

 

প্রাইভেট সিকিউরিটি গার্ড বয়স বেশি, কোনও কাজ পাচ্ছেন না—এমন লোককে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বাড়ি-পাড়া-মহল্লার নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে। কোনও অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ না থাকলেও শুধু পূর্বপরিচয় থাকায় ও কম বেতন দিতে হয় বলেই তাদের নিয়োগ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। বাসাবাড়ির বাসিন্দাদের অভিযোগ, নিরাপত্তা দেওয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতা ও যথাযথ জ্ঞান না থাকায় দায়িত্ব পালনেও ব্যর্থ হচ্ছেন এসব বয়স্ক নিরাপত্তারক্ষী। এছাড়া প্রায়ই মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের হামলার শিকার হচ্ছেন তারা। তবে অভিজাত এলাকাগুলোয় বেসরকারি সিকিউরিটি প্রোভাইডার কোম্পানিগুলোর নিরাপত্তারক্ষী রয়েছে। যাদের বেশিরভাগই প্রশিক্ষিত। নিয়োগের পরও তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে চাকরিপ্রার্থীদের সঠিক পরিচয় বা ক্রিমিনাল রেকর্ড যাচাই না করেই নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে। ফলে যাচাই ছাড়া নিয়োগ পাওয়া নিরাপত্তারক্ষীরা পরবর্তী সময়ে চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধ করে পালিয়ে যাচ্ছে। নিয়োগের সময় পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা না থাকায় ও অতীত রেকর্ড যাচাই না করায় পরবর্তী সময়ে তাদের খুঁজে পেতে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। তবে, এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটি সার্ভিস কোম্পানিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের  সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম সরকার।

বাসাবাড়ির বাসিন্দারা বলছেন, নিরাপত্তা দেওয়ার মতো শারীরিক শক্তি বয়স্ক নিরাপত্তারক্ষীদের না থাকায় বিভিন্ন সময় তারা মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।

রাতে দায়িত্ব পালনের সময় গত ১৬ অক্টোবর রাজধানীর সেনপাড়া এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত হন নিরাপত্তারক্ষী জ্যাকব বাড়ৈ (৫৫)। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২১ অক্টোবর মারা যান তিনি।

মিরপুর থানা সূত্রে জানা গেছে, জ্যাকব বাড়ৈ মিরপুরের সেনপাড়া পর্বতার ৩২/৪ নম্বর বাড়িতে দুই বছর ধরে নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্বে ছিলেন। গত ১৬ অক্টোবর রাতে বাড়ির সামনে থেকে কয়েকজন ছিনতাইকারী তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। বাধা দিলে ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়।

দিলু রোডের একটি বাসায় নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্বে রয়েছেন আব্দুর রহমান। বয়স বেশি, ফলে পরিশ্রমের কোনও কাজ করতে পারেন না। তাই দিলু রোডে পরিচিত এক মালিকের বাড়িতে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ নিয়েছেন। ছয় মাস ধরে সেখানে কাজ করছেন তিনি। এর আগে রাজশাহীতে একটি দোকানে কাজ করতেন। এখন তার কাজ শুধু রাত জেগে পাহারা দেওয়া। সম্প্রতি তার সামনে থেকে এক ছিনতাইকারী পালিয়ে গেলেও তিনি ধরতে পারেননি।

দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন জানতে চাইলে আব্দুর রহমান বলেন, ‘ছয় মাস ধরে এখানে কাজ করছি। দুই বার ঝামেলা হয়েছে। একবার আমার সামনে ছিনতাই হয়েছে। আরেকবার আমি হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ায় বাসায় চোর ঢুকেছিল।’

বয়স বেশি হওয়ায় অন্য কাজ করতে না পেরে বনশ্রীতে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করছেন ৫৯ বছর বয়সী জলিল মিয়া (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘রাতে গার্ডের ডিউটি করি। আট ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। এখন অন্য কোনও কাজ করতে পারি না। এখানে কাজ পাইছি।’

বাড়িতে সিকিউরিটি গার্ড আছেন কিন্তু তিনি নিরাপত্তা দিতে সক্ষম কিনা, সেটা যাচাই করা কতটা জরুরি—এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোডের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমার বাড়িতে সিকিউরিটি গার্ড আছেন একজন। বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। কাজ তেমন কিছু না। বাসায় কেউ এলে বা বের হলে গেট খুলে দেওয়া। আর অপরিচিত কেউ এলে ফোন করে তথ্য নেওয়া। এই কাজের জন্য তাকে মাসে দেওয়া হয় সাত হাজার টাকা।’ তিনি বলেন, ‘এই কাজের জন্য অপেক্ষাকৃত কমবয়সী লোক পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের বেতন বেশি দিতে হয়। এছাড়া বয়স কম হলে অন্য কোথাও ভালো কাজের সুযোগ পেলে তারা এই চাকরি ছেড়ে চলে যান। বয়স একটু বেশি হলে তারা দীর্ঘদিন চাকরিতে থাকেন। এই কারণেই রিস্ক একটু থাকলেও বয়স্ক লোক বেছে নেওয়া হয়।’

বনশ্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. আবুল কালাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাতে কাজ করতে গিয়ে কিছু সমস্যা হয়। সেগুলো ম্যানেজ করা হয়। আমাদের ১১২জন সিকিউরিটি গার্ড রয়েছেন। তারা রাতে আট ঘণ্টা ডিউটি করেন।’

তবে নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বনশ্রী কল্যাণ সমিতির একজন কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমাদের যারা নিরাপত্তারক্ষী আছেন, সবাই যে এ কাজের জন্য ফিট, তা   নয়। এ কাজের জন্য খুব বেশি বেতনও দেওয়া হয় না। আবার সারা রাত ডিউটি করলে দিনে তেমন কোনও কাজ করা যায় না। ফলে যাদের অন্য কাজ করার সক্ষমতা রয়েছে, তারা কম বেতনে এ কাজে আসতে চান না। তখন বাধ্য হয়েই একটু বেশি বয়সী লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়।’

জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে পাড়া বা মহল্লায় নিয়োজিত নিরাপত্তারক্ষীদের কিভাবে কাজ করতে হবে, তা সাধারণত এ কাজে যারা আগে থেকেই আছেন, তারা বলে দেন। বাকি কাজটা নিজে নিজেই বুঝে নিয়ে করতে হয়। তবে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে বেশ কিছু বিষয়ে পাড়া-মহল্লার সিকিউরিটি গার্ডদের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে বলে জানান শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান। তিনি বলেন, ‘কিভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে, সে কৌশল আমাদের শেখানোর খুব বেশি একটা সুযোগ নেই। তবে সন্দেহজনক কিছু দেখলে সংশ্লিষ্ট থানায় সঙ্গে সঙ্গে জানানো, রাতে ডিউটি করার সময় বাকি যারা রয়েছে, তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কিভাবে কাজ করতে হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়।’

এদিকে যোগ্যতার বিচারে প্রাইভেট সিকিউরিটি গার্ড প্রোভাইডার কোম্পানিগুলো এগিয়ে থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে নিয়োগে অবহেলার অভিযোগ রয়েছে। নিরাপত্তারক্ষীদের অতীত রেকর্ড ও ঠিকানা যাচাই  ছাড়াই কিছু কিছু কোম্পানি নিয়োগ দিয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে এসব নিরাপত্তারক্ষী কোনও অপরাধে জড়িয়ে পড়লে তাদের খুঁজে পেতে যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা।

গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর গুলশান-১-এ জব্বার টাওয়ারে চারটি দোকানে চুরির ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে একটি মানি এক্সচেঞ্জারের দোকানের ভল্ট ভেঙে সাড়ে ৩৫ লাখ টাকা নিয়ে গেছে চোরেরা। এ ঘটনায় পর থেকে মার্কেটের নিরাপত্তারক্ষী আলম (৪০), জামাল (৪৫) ও রফিক (৪২) পলাতক।

চুরি যাওয়া মানি এক্সচেঞ্জের মালিক মো. লেলিন মুন্সী বলেন, ‘মার্কেটের সিসিটিভিতে দেখা গেছে পলাতক সিকিউরিটি গার্ডরা রাতে ডিউটিতে থাকা দুই সিকিউরিটি গার্ডকে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাইয়ে অচেতন করে। পরে চারটি দোকানে চুরি করে। পলাতক তিন সিকিউরিটি গার্ডকে ঘটনার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ‘ওয়ান সিকিউরিটি কোম্পানি’ থেকে জব্বার টাওয়ারে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।’

জব্বার টাওয়ারে চুরির পর তিন নিরাপত্তারক্ষী পলাতক থাকার ব্যাপারে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের সিনিয়র সহকারী কমিশনার গোলাম সাকলাইন। তিনি বলেন, ‘এই তিন সিকিউরিটি গার্ডদের কয়েকদিন আগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কোম্পানিতে তাদের নাম-ঠিকানা চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা সেটা দিতে পারেনি। তাদের কাছে পুরো তথ্য নেই। নিয়োগের সময় তারা যাচাই না করেই নিয়োগ দিয়েছে। আমরা পলাতক সিকিউরিটি গার্ডদের গ্রেফতারে চেষ্টা করছি।’

বাড়ি, এলাকা বা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগে অবশ্যই মালিকদের সতর্ক থাকতে হবে বলে মত দেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিজের বাসা বা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যাকে রাখা হবে, তাকে অবশ্যই সেই নিরাপত্তা রক্ষায় সক্ষম হতে হবে। যাকে-তাকে নিয়োগ দিলে নিজের সম্পদই অনিশ্চয়তায় থাকে। ফলে এ ব্যাপারে বাড়ির মালিক বা সমিতির দায়িত্বশীলদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে।’

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সিকিউরিটি সার্ভিস কোম্পানিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, সাত শতাধিক প্রাইভেট সিকিউরিটি গার্ড প্রোভাইডার কোম্পানি রয়েছে। এরমধ্যে ৪৫০টি কোম্পানি এই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম সরকার বলেন, ‘আমরা নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগের সময় যথেষ্ট যাচাই করে নিয়োগ দিয়ে থাকি। কেউ যদি না মানে, সে ব্যাপারে অভিযোগ পেলে আমরা তাদের নিয়ম অনুযায়ী চলার নির্দেশনা দিয়ে থাকি।’

কেমন সিকিউরিটি গার্ড বাসা, প্রতিষ্ঠান বা এলাকায় নিয়োগ দেওয়া হবে তা নির্ভর করে, ক্লায়েন্টটা কেমন সিকিউরিটি গার্ড চান, তার ওপর। তাদের চাহিদা অনুযায়ী সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দেওয়া হয় বলে জানান বাংলাদেশে সিকিউরিটি সার্ভিস কোম্পানিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মো. জয়নাল আবেদিন। তিনি বলেন, ‘সব নিরাপত্তারক্ষী যে প্রশিক্ষিত থাকে, এমন নয়। তবে ক্লায়েন্ট যেভাবে চান, আমরা সেভাবেই সিকিউরিটি গার্ড প্রোভাইড করে থাকি। একেকজনের একেক চাহিদা। কেউ চান অবসরপ্রাপ্ত কোনও বাহিনীর সদস্য, কেউ চান প্রশিক্ষিত, আবার কেউ চান প্রশিক্ষিত না হলেও চলবে। আমাদের সার্ভিস ক্লায়েন্দের চাহিদার ওপর নির্ভর করে।’

 

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
অ্যাটলেটিকোকে বিদায় করে ১১ বছর পর সেমিফাইনালে ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগঅ্যাটলেটিকোকে বিদায় করে ১১ বছর পর সেমিফাইনালে ডর্টমুন্ড
অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে বার্সাকে কাঁদিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি
চ্যাম্পিয়নস লিগঅবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে বার্সাকে কাঁদিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
সর্বাধিক পঠিত
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
চুরি ও ভেজাল প্রতিরোধে ট্যাংক লরিতে নতুন ব্যবস্থা আসছে
চুরি ও ভেজাল প্রতিরোধে ট্যাংক লরিতে নতুন ব্যবস্থা আসছে
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়