X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

নব্য জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ মাহফুজই নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য সাখাওয়াত

নুরুজ্জামান লাবু ও আতাউর রহমান জুয়েল
২৪ নভেম্বর ২০১৭, ২০:৩২আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০১৭, ১০:৪৪

সাখাওয়াত হোসেন ওরফে মাহফুজ বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে থাকা অবস্থাতেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া এম সাখাওয়াত হোসেনই ছিল নিও জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ মাহফুজ। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের কাছ থেকে মাহফুজের নাম জানতে পারে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসি। এরপর থেকে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে সিটিটিসি’র গোয়েন্দারা।

কিন্তু কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা সম্প্রতি জানতে পারেন সাখাওয়াত ওরফে মাহফুজ এ বছরের ২৯ মার্চ মৌলভীবাজারে নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানায় অপারেশন হিটব্যাকে নিহত হয়। ওই অভিযানে মাহফুজের সঙ্গে আরেক জঙ্গি নেতা লোকমান হোসেন ওরফে সোহেল তার স্ত্রী ও চার সন্তানসহ নিহত হয়। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে লোকমানের বড় মেয়েকে বিয়ে করেছিল এই সাখাওয়াত ওরফে মাহফুজ। মৃত্যুর আগে সে নব্য জেএমবির সামরিক কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করে আসছিল। বোমা তৈরিতেও বিশেষ পারদর্শী ছিল মাহফুজ। সিটিটিসি’র অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

সিটিটিসি’র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আহমেদুল ইসলাম জানান, সাখাওয়াত হোসেনই যে মাহফুজ সাংগঠনিক নামে আত্মগোপনে থেকে জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল- এ বিষয়ে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছি। সে আত্মগোপনে থেকে আরেক জঙ্গি নেতা ফারদিনের মাধ্যমে বোমা তৈরিতে দক্ষতা অর্জন করে। নাসিরপুরে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত মাহফুজ নিও জেএমবির সামরিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।

সিটিটিসি ও পারিবারিক সূত্র জানায়, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার জোড়বাড়িয়া মধ্যদক্ষিণ পাড়ার বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেনের বাবার নাম আবুল হোসেন। ১৯৮৪ সালে জন্ম নেওয়া সাখাওয়াত হোসেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় আল হেরা একাডেমি মাধ্যমিক স্কুল থেকে ২০০২ সালে এসএসসি পাশ করে। এরপর ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হলেও পাস করার আগেই ২০০৪ সালে সে নৌবাহিনীর চাকরিতে যোগ দেয়। নৌবাহিনীর সদস্য হিসেবে চট্টগ্রামে থাকা অবস্থাতেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে সাখাওয়াত ওরফে মাহফুজ।

সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা জানান, নিও জেএমবির আরেক শীর্ষ নেতা ফারদিনের হাত ধরে ২০১৪ সালের দিকে এই মাহফুজ জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হয়। ফারদিনের কাছেই বোমা তৈরির প্রশিক্ষণও নেয় সে। প্রথম দিকে তার দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলে নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করা। পরে ফারদিনের নির্দেশে ২০১৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঈসা খাঁ ঘাঁটির মসজিদে বোমা হামলার পরিকল্পনা করে। অবশ্য এর আগেই সে নৌবাহিনী থেকে ডেপুটেশনে র‌্যাব-১২ তে যোগদান করে। চট্টগ্রামে নৌঘাঁটির মসজিদে বোমা হামলার পরপরই গ্রেফতার জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে সাখাওয়াত ওরফে মাহফুজের নাম চলে আসে। একদিন আগে ছুটিতে যাওয়া সাখাওয়াত সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।

ওই মামলায় আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, হামলায় অংশ নেওয়া রমজান, মান্নান ও বাবুল পরিচয় গোপন করে এবং শিক্ষাগতযোগ্যতা কম দেখিয়ে সাখাওয়াতের মাধ্যমে চট্টগ্রামের বানৌজা শহীদ মোয়াজ্জেম ঘাঁটিতে ক্যান্টিন বয়, ব্যাটমান ও বলকিপার হিসেবে চাকরি নেয়। সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘নৌবাহিনীতে চাকরি নেওয়ার বিষয়টি জেএমবির সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত ছিল।’

সাখাওয়াতের স্ত্রী শারমিন আক্তার সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে গোয়েন্দাদের জানান, ২০১৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর ছুটিতে থাকাকালীন রাত ৯টার দিকে তার স্বামী সাখাওয়াতের মোবাইল ফোনে হঠাৎ একটি কল আসে। ফোন পেয়ে তাড়াহুড়ো করে সে খালি হাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। রাত ১২টার পর গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাবের পরিচয় দিয়ে ২০/২৫ জন লোক পুরোবাড়ি ঘিরে ফেলে সাখাওয়াতকে খুঁজতে থাকে। তাকে না পেয়ে কর্মকর্তারা বলেন, সাখাওয়াতকে সারেন্ডার করতে বলেন তবেই সে বেঁচে যাবে। কী কারণে তাকে খুঁজছে সে বিষয়ে তারা কিছুই জানাননি। ফিরে যাওয়ার আগে র‌্যাব সদস্যরা সাখাওয়াতের ল্যাপটপটি নিয়ে যান।

স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে জঙ্গি সাখাওয়াত ওরফে মাহফুজ

শারমিন আরও জানান, এরপর অনেকবার বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা সাখাওয়াতের সন্ধানে তাদের বাড়িতে এসেছে। তখন তিনি (শারমিন) জানতে পারেন যে, সাখাওয়াত কোনও একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।

দুই সন্তানের জননী শারমিন জানান, তারা সম্প্রতি মৌলভীবাজারের জঙ্গি আস্তানায় সাখাওয়াতের মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছেন।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলেছেন, বাসা থেকে পালিয়ে সাখাওয়াত ওরফে মাহফুজ মিরপুরের শাহআলীর একটি আস্তানায় উঠেছিল। সেসময় ওই আস্তানায় তার সঙ্গে ফারদিনসহ আরও কয়েকজনও ছিল। ওই বছরের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ শাহআলীর আস্তানায় অভিযান চালায়। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য ও বোমা তৈরির উপকরণসহ দ দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার দুই জঙ্গি জানায়, অভিযানের আগেই সাখাওয়াত ওরফে মাহফুজ ও ফারদিন ওই বাসা থেকে একে-২২ রাইফেল নিয়ে পালিয়ে যায়।

সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সাখাওয়াত ওরফে মাহফুজ মিরপুর থেকে পালিয়ে গাইবান্ধার আস্তানায় চলে যায়। সেখানে সে নব্য জেএমবির সদস্যদের প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করে। সেখানে তার ছদ্ম নাম ছিল ‘তাহুশ’। আসল পরিচয় গোপন করতে সবসময় মুখে রুমাল বেঁধে রাখতো সে।  উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় হামলায় অংশ নেওয়া বাইক হাসান, বদর মামা, রাহুলসহ আরও জঙ্গিরা সেসময় এই মাহফুজের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল।’

সিটিটিসি’র ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘গাইবান্ধায় থাকা অবস্থাতেই ফারদিনের মাধ্যমে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় মাহফুজের। সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাখাওয়াত ওরফে মাহফুজকে আবারও চট্টগ্রাম গিয়ে কাজ করতে বলা হয়। সে তখন লোকমান ওরফে সোহেলের সঙ্গে একত্রে কাজ করে। এরপর এ বছরের প্রথম দিকে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লোকমানের সঙ্গে সিলেট এলাকায় চলে যায়। এরমধ্যে লোকমানের বড় মেয়েকে বিয়েও করে মাহফুজ।’

সিটিটিসি সূত্র বলছে, গত বছরের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের অভিযানে তামিম চৌধুরীর মৃত্যুর পর মাঈনুল ওরফে মুসা নব্য জেএমবির আমির নির্বাচিত হয়। মুসা তখন সাখাওয়াত ওরফে মাহফুজকে সামরিক কমান্ডার হিসেবে ঘোষণা দেয়। সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেটের আতিয়া মহলের বাইরে বোমা হামলায় র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধানসহ যে সাত জন মারা যান, সেই হামলায় এই মাহফুজও অংশ নিয়েছিল।

ফুলবাড়িয়া পৌরসভার জোরবাড়িয়া দক্ষিণ মধ্যপাড়ার এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী  আবুল হোসেন ও নুরুন্নাহার দম্পতির চার পুত্র ও দুই মেয়ের মধ্যে সাখাওয়াত হোসেন ওরফে মাহফুজ তৃতীয়। বড় ভাই জাকির হোসেন স্থানীয় আল হেরা একাডেমি মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন, মেজ ভাই আবু সাইদ জাহাঙ্গীর হোসেন জামালপুরে ইসলামী ব্যাংকে সহকারী অফিসার হিসেবে কর্মরত, দুই বোন উম্মে কুলসুম ও সায়মা আক্তার স্কুল শিক্ষিকা এবং ছোট ভাই সাব্বির আহমেদ ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন।

সাখাওয়াতের স্বজনরা জানান, ২০১৩ সালে নৌবাহিনী থেকে সাখাওয়াতের পোস্টিং হয় প্রথমে নীলফামারী ও পরে টাঙ্গাইলের র‌্যাবে। এর আগে ২০১১ সালে সে বিয়ে করে। সাখাওয়াতের বাবা আবুল হোসেন জানান, সাখাওয়াত ছোটবেলা থেকেই নামাজ রোজ করতো। কিন্তু সে যে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল- তা বিশ্বাস করতে পারছেন না তারা।

আরও পড়ুন: 

ডাকাতি মামলার আসামি বিল্লাল গ্রেফতারের পর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত

 

 

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা