X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্রে বাবা মারা যাওয়ার পর বদলে যেতে থাকে আকায়েদ

নুরুজ্জামান লাবু
১২ ডিসেম্বর ২০১৭, ২৩:৫০আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ১২:২৭

আকায়েদ উল্লাহ নিউ ইয়র্কে যাওয়ার পর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আকায়েদ উল্লাহর বাবা সানাউল্লাহ মিয়া। এরপর থেকেই বদলে যেতে থাকে আকায়েদ। তার মধ্যে ধর্মের প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ দেখা যেতে থাকে। পরিবারের সদস্যদের নামাজ পড়ার তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি সালাফি রীতিনীতি অনুসরণের জন্য চাপ দিতে শুরু করে সে। দেশে তার স্বজন ও পরিচিতজনরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে আকায়েদের মধ্যে উগ্রবাদ বা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কোনও লক্ষণ কখনও দেখা যায়নি। এ পরিবর্তন আসে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর, বিশেষ করে সেখানে তার বাবা মারা যাওয়ার পর।  

ঢাকার হাজারীবাগে বেড়ে ওঠা আকায়েদ নিউ ইয়র্কে যাওয়ার পর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করে। অন্যদেরও নামাজ পড়তে উৎসাহ দেওয়া শুরু করে। এমনকি, পরিবারের সদস্যদেরও সালাফিজম-এর রীতি অনুযায়ী ধর্মীয় চর্চা করতে বলে। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি নম্র ও ভদ্র আকায়েদ কোনও একদিন ধর্মান্ধদের মতো ‘আত্মঘাতী’ হামলা চালানোর পরিকল্পনা করবে। তার এই হামলাচেষ্টা বাংলাদেশকে যেমন অস্বস্তিতে ফেলেছে, তেমনি হতভম্ব হয়ে পড়েছেন তার পরিবারের সদস্যরাও। অভিবাসন নিয়ে নতুন করে সংকটের মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন নিউ ইয়র্কের প্রবাসী বাংলাদেশিরাও।

নিউ ইয়র্ক পুলিশ বলছে, শরীরের সঙ্গে পাইপ বোমা বেঁধে আত্মঘাতী হামলা করতে গিয়ে আহত হয় আকায়েদ। ওই বিস্ফোরণে অন্তত তিন জন আহত হন। তবে সন্দেহভাজন আকায়েদসহ সবাই আশঙ্কামুক্ত। আর্ন্তজাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের অনুপ্রেরণায় আকায়েদ এই হামলা চালায় বলেও জানানো হয়েছে নিউ ইয়র্ক পুলিশের পক্ষ থেকে।

সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়ায় নিজেদের নিয়ন্ত্রিত ভূমি হারানো ইসলামিক স্টেটের কার্যক্রম বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেক আগে থেকেই জানিয়ে আসছিলেন জঙ্গিবাদ বিশ্লেষকরা।

কিন্তু সোমবার সকালে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন বাস টার্মিনালে বিস্ফোরণের ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়া আকায়েদ কিভাবে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়লো? বাংলাদেশের পুলিশ ও আকায়েদের স্বজনরা বলছেন, ২০১১ সালে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আকায়েদের ধর্মীয় জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। ২০১২ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর নিউ ইয়র্কে থাকা অবস্থাতেই বদলে যেতে থাকে সে। সেখানে প্রথম দিকে সে ট্যাক্সি চালাতো।

নিউ ইয়র্কে বিস্ফোরণের পর সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়ার পর আকায়েদের বিষয়ে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট তার বিষয়ে খোঁজখবর শুরু করে। দেশের দক্ষিণের জেলা চট্টগ্রামের সন্দীপে জন্ম নেওয়া আকায়েদ পরিবারের সঙ্গে ছোট থেকেই থাকতো ঢাকার হাজারীবাগে। ২০১১ সালে দেশ ছাড়ার পাঁচ বছর পর ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে দেশে ফিরে পারিবারিকভাবে ছোট বোন হেলেনের বান্ধবী জান্নাতুল ফেরদৌস জুঁইকে বিয়ে করে সে। এরপর দু’বার দেশে এসেছিল আকায়েদ, সর্বশেষ চলতি বছরের ৮ সেপ্টেম্বর দেশে এসে ২২ অক্টোবর আবার ফিরে যায়। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে এসে চলতি বছরের জানুয়ারিতে নিউ ইয়র্কে ফেরে সে।

আকায়েদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য মঙ্গলবার বিকালে তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জুঁই, শ্বশুর জুলফিকার হায়দার ও শাশুড়ি মাহফুজা আক্তারকে নিজেদের কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেওয়া তথ্যে আকায়েদ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া গেছে বলে জানান সিটিটিসি কর্মকর্তারা।

সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আকায়েদ বাংলাদেশে র‌্যাডিকাল হয়েছে এমন কোনও তথ্য আমরা পাইনি। নিউ ইয়র্কে বসেই সে র‌্যাডিক্যাল হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। তার বিষয়ে আরও বিস্তারিত খোঁজখবর জানার চেষ্টা চলছে।’

বিস্ফোরণের পর আকায়েদ সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের কাছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আকায়েদকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘হোমগ্রোন সন্ত্রাসী’ বলে জানানো হয়েছে। বিস্ফোরণের পর পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হকও সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, আকায়েদের নামে বাংলাদেশে কোনও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের রেকর্ড নেই।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ঘটনার পর থেকেই আকায়েদের বিষয়ে জানতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) সদস্যরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

ঢাকায় আকায়েদের স্ত্রী ও শ্বশুর-শাশুড়িকে জিজ্ঞাসাবাদ করা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, বিয়ের পর আকায়েদ তার স্ত্রীকেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে বাধ্য করে। এমনকি স্বামীর নির্দেশনা অনুযায়ী বিয়ের পর থেকে আকায়েদের স্ত্রী হিজাব পরে চলাফেরা করতেন। এটিকে সাধারণ ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলার মতোই মনে করেছিলেন পরিবারের অন্য সদস্যরা।

আকায়েদের স্ত্রী এবং শ্বশুর-শাশুড়িকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সিটিটিসির আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৩ সালে আকায়েদ তার পুরো পরিবারকে নিয়ে সৌদি আরবে ওমরাহ করতে যায়। সেখান থেকে তারা বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখনই তাদের মধ্যে সালাফিজম-এর রীতি মেনে চলতে দেখেন পরিবারের সদস্যরা। সারাবিশ্বে সক্রিয় জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর বেশিরভাগই সালাফি মতবাদ অনুসরণ করে থাকে।

বাংলা ট্রিবিউনকে আকায়েদের শ্যালক ২০ বছরের তরুণ হাফিজ মাহমুদ জয় বলেন, ‘বিয়ের সময় আকায়েদ ভাইয়ের মুখে দাড়ি ছিল। তখন থেকেই তাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে দেখেছি। সর্বশেষ যখন দেশে এসেছিলেন তখনও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। বাইরে তেমন যেতেন না। সারাদিন বাড়িতেই থাকতেন। অন্যদের নিয়মিত নামাজ পড়তে অনুরোধ করতেন।’

আকায়েদের বোন হেলেন ও স্ত্রী জুঁই একই ক্লাসে পড়তেন ঢাকার একটি স্কুল ও কলেজে। তাদের দুজনের ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আকায়েদ ভাইদের বাসায় আমি অনেকবার গিয়েছি। তার ছোট বোন হেলেন আমার বান্ধবী। আকায়েদ ভাই ছিল খুবই ভদ্র ও নম্র একটি ছেলে। সুন্দর ব্যবহার ছিল তার। নিউ ইয়র্কে চলে যাওয়ার পর মাঝখানে যখন দেশে এসেছিল তখনও তার সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু তাকে কখনোই ধর্মীয় উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে মনে হয়নি। অন্য ৮-১০টা সাধারণ ছেলের মতোই তাকে মনে হতো। এই তরুণী বলেন, ‘আমি তাকে খুব রেসপেক্ট করতাম। আমার নিজের ভাইয়ের মতো সম্মান করতাম। সে এমন কিছু করতে পারে আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।’ ওই ঘটনার খবর জেনে মঙ্গলবার বিকালে আকায়েদের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে তাদের ১০/১ মনেশ্বর রোডের বাসায় গিয়েছিলেন তিনি।

আকায়েদের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জুঁই সিটিটিসির কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, প্রতিদিনই সকালে তিনি ফোন করে আকায়েদকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতেন। আকায়েদ ফজরের নামাজ শেষ করে কাজে বেরিয়ে যেতো। সোমবারও তিনি আকায়েদকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেন। তারপর তাদের মধ্যে বেশ কয়েক মিনিট কথাবার্তাও হয়। এসময় আকায়েদ তার এবং সন্তানের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার কথা বলে ফোন রেখে দেয়।

জুঁই আরও জানন, আকায়েদ আমেরিকাতে গেলেও শেষদিকে কিছুটা আমেরিকা বিদ্বেষী হয়ে ওঠেছিল। তার সঙ্গে ইরাক-সিরিয়ায় মুসলমানদের নির্যাতন-নিপীড়ন নিয়েও কথাবার্তা বলতো। তাকেও বিভিন্ন ইসলামিক স্কলারের লেকচার শুনতে বলতো। ভিডিও বার্তাগুলোর লিংক পাঠাতো। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি ধীরে ধীরে তার স্বামী ধর্মীয় উগ্রবাদীদের খাতায় নাম লিখিয়ে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা করে চলেছেন।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, ধানমন্ডির কাকলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং বাংলাদেশ রাইফেলস স্কুল (মুন্সী আব্দুর রউফ স্কুল অ্যান্ড কলেজ) থেকে এইচএসসি পাস করার পর আকায়েদ ঢাকার সিটি কলেজে বিবিএতে ভর্তি হন। তৃতীয় বর্ষে পড়া অবস্থায় পরিবারের সঙ্গে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে।

তার এক মামা দীর্ঘদিন আমেরিকায় বাস করতেন। তিনি প্রথমে আকায়েদের বড় ভাই আহসান উল্লাহকে আমেরিকায় নিয়ে যান। আহসান উল্লাহ সেখানে প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াশোনা শেষে চাকরি শুরু করেন। আহসানই ২০১১ সালে তার বাবা-মা, দুই ভাই ও দুই বোনকে তার কাছে নিয়ে যান। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আগে চাকরি করলেও আহসান উল্লাহ সেখানে একটি ইলেকট্রনিক কোম্পানি চালু করেন। এই বছরই ভাইয়ের সেই প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করে আকায়েদ। আকায়েদের স্ত্রী জানিয়েছেন, প্রথম দিকে আকায়েদ ট্যাক্সি চালাতো। তারপর একজন প্রবাসী বাঙালির দোকানে কাজ করতো। নিউ ইয়র্কে গিয়ে লেখাপড়ায় বিচ্ছেদ ঘটলেও ইংরেজির ওপর সে একটি কোর্স করে বলেও সিটিটিসির কর্মকর্তাদের জানান তিনি।

 

 

 

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ওসির বিরুদ্ধে নির্বাচনে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
ওসির বিরুদ্ধে নির্বাচনে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা