X
শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪
২৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের অর্ধেক গর্ভবতী কিশোরী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে

তাসকিনা ইয়াসমিন
১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:৪৯আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১২:৫২





কিশোরী গর্ভবতী

সুরাইয়া সুলতানা (১৩) গাজীপুর জেলায় বসবাসকারী একজন কিশোরী। এই বয়সেই সে বিবাহিতা এবং সন্তান সম্ভবা। গর্ভবতী এই কিশোরীর ওজন স্বাভাবিক পরিমাপের চেয়ে অনেক কম।  আছে রক্তস্বল্পতাও। নিজের শারীরিক গঠন সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই মা হওয়াও এসব সমস্যা তার এবং অনাগত সন্তানের জন্য  যথেষ্ট ঝুঁকির সৃষ্টি করছে। এরপরও সুরাইয়ার মতো  বহু কিশোরীর বিয়ে হচ্ছে, তারা  মা হতেও বাধ্য হচ্ছে অল্পবয়সে।  এদের প্রত্যেকেই কোনও না কোনওভাবে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

শুধু সুরাইয়া নয়, দেশের অর্ধেক বিবাহিত কিশোরীই গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডি্ক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এর এডোহার্টস বেইজলাইন সার্ভের গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য।

পঞ্চম আদমশুমারির হালনাগাদ তথ্য মতে, দেশে এখন ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীর সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি, যা মোট জনগোষ্ঠীর ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, এর মধ্যে ৪৯ শতাংশের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। সেই হিসেবে ১ কোটি ৭১ লাখ ৫০ হাজার কিশোরীর বিয়ে হয় ১৮’র আগেই। আর ৫৯ শতাংশ কিশোরী ২০ বছরের আগেই গর্ভধারণ করে। সেই হিসেবে এদের মধ্যে ১ কোটি ১ লাখ ১৮ হাজার ৫শ’ জন গর্ভধারণ করে।

এডোহার্টস বেইজলাইন সার্ভে থেকে প্রাপ্ত গবেষণা তথ্যে  দেখা যায়, কৈশোরে গর্ভধারণ করায় হতাশায় ভুগছে ১৪ শতাংশ কিশোরী। এছাড়াও বাকিদের মধ্যে বিভিন্ন আসক্তি আছে এমন কিশোরীর সংখ্যা ১৫ শতাংশ,  রক্তশূন্যতায় ভুগছে ২৫ শতাংশের, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো নয় ২৭ শতাংশের এবং পুষ্টিহীনতায় ভুগছে ৬৫ শতাংশ কিশোরী।


এ অবস্থার পরিবর্তনে কিশোরী মায়েদের সঠিক চিকিৎসা সেবা দেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। পাশাপাশি কিশোরীদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য অল্প বয়সে তাদের বিয়ে না দেওয়াকেও উৎসাহিত করতে বলছেন তারা।

গবেষণায় দেখা যায়, কিশোরীদের মাসিক পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সুযোগ তেমন নেই। তারা এ কারণে ডাক্তারের কাছে যায় না। প্রথম মাসিকের পর কিশোরীদের রক্তস্বল্পতার হার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। ১০-১১ বছরের কিশোরীদের মধ্যে রক্তস্বল্পতার হার ১৭ শতাংশ হলেও ১২-১৯ বছরের অবিবাহিত ও বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে রক্তস্বল্পতার হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশ। আর গর্ভাবস্থায় কিশোরীদের রক্তস্বল্পতার হার বেড়ে দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ। তবে এর তুলনায় ১০-১৯ বছরের কিশোরদের মধ্যে রক্তস্বল্পতার হার অনেক কম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ এডোহার্টস প্রকল্পভুক্ত চারটি জেলায় এ সার্ভে পরিচালনা করে। জেলাগুলো হচ্ছে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, খুলনা এবং জামালপুর। এবছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এই সার্ভেটি পরিচালিত হয়।
সার্ভের ফলাফলে জানা যায়, ১৫-১৯ বছরের প্রায় অর্ধেক কিশোর-কিশোরী অপুষ্টিতে ভুগছেন। স্বাস্থ্যসেবার জন্য কিশোর-কিশোরীরা সরকারি সেবাকেন্দ্র কম ব্যবহার করেন। এছাড়া কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য সরকারি সেবাকেন্দ্রগুলোর প্রস্তুতির অভাব রয়েছে। 

এ প্রকল্পের গবেষকদের একজন ডা. দিলীপ কুমার বসাক বলেন, রক্তস্বল্পতা দূর করতে আক্রান্ত কিশোরী মায়েদের বেশি খাবার দিতে হবে। তাদের কাউন্সেলিং করতে হবে যে কোন কোন খাবার খেলে তাদের রক্তস্বল্পতা হবে না। কিশোরীদের মাসিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য স্কুলে স্কুলে কাউন্সেলিং করা যায়। কিশোরীরা ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা  নিতে গেলে তাদের শারীরিক বিভিন্ন ঝুঁকির বিষয়ে বলে দেওয়া যায়।
তিনি বলেন, আমরা গবেষণার ক্ষেত্রে কিশোরীদের ওজন ও উচ্চতা দুটি বিষয় দেখেছি। এদুটো বিষয় থেকে তাদের অন্যান্য স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নির্ধারণ করেছি। আমরা কিশোরীদের রক্তস্বল্পতার বিষয়টিও দেখেছি। এই গবেষণার মাধ্যমে বিএসএমএমইউ এর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে যে, সরকারের এই খাতেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
সেন্ট্রাল হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশের মেয়েরা রক্তস্বল্পতায় ভোগেই। যখন গর্ভ ধারণ করে  তখন এর মাত্রা আরও বেড়ে যায়। তখন শরীরে রক্ত তৈরি না হলে এর হার আরও বাড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ১১ বছরের নিচে কারও যদি ১১ পার ডেসিলিটার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা থাকে তাহলে তা স্বাভাবিক। কিন্তু এর নিচে চলে গেলে সেটাকে আমরা অ্যানিমিয়ার (রক্তশূন্যতা) মধ্যে ফেলি। এক্ষেত্রে কিশোরী যদি গর্ভবতী হয় তাহলে তার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা আরও কমে আসে। গর্ভধারণ  তখন তার জন্য চাপ হয়ে যায়। সে দুর্বল হয়ে যায় এবং নানা সমস্যায় ভুগতে থাকে।
সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক  ডা. মুনীরা ফেরদৌসী বলেন, আমাদের দেশের কিশোরী মেয়েরা সবকিছুতে বিপর্যস্ত থাকে। খাওয়া-দাওয়া, নিরাপত্তা, পরিবারের সার্বিক সহযোগিতা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। যখন ওরা বড় হচ্ছে বিশেষ করে মাসিক শুরু হলে তাদের শরীর থেকে বাড়তি রক্ত বের হয়ে যায়। কিন্তু এসময় তাদের ঘাটতি পূরণে বাড়তি খাওয়া দাওয়ার প্রয়োজন। সেই মনোভাবটা  তাদের তো বটেই বেশিরভাগের পরিবারেও শুরু হয়নি। এরপর যখন মেয়ে শিশুটির বিয়ে হয়ে যায়, তখন সে আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। সে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি জানে না। বাসা থেকেও তাদের কিছু বলা হয় না। মায়েরা  খোলা মনে মেয়েদের সঙ্গে এসব নিয়ে কথাও বলে না। কোনও কিশোরী গর্ভবতী হতে না চাইলে তখন সে গর্ভপাত করে। এতে করে তার শরীরে আরও রক্তস্বল্পতা তৈরি হয়। আর গর্ভবতী হলে গর্ভের সন্তান মায়ের সব রক্ত শূষে নেয়। মা আরও রক্তশূন্যতায় ভুগতে থাকে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা ভালো নয়। একটি কিশোরী মেয়েকে পরিবার নিরাপত্তা দিতে পারে না। কিশোরী মেয়ের ওপর সবার দৃষ্টি পড়ে। ১৮ বছরের নিচে  মেয়ের বিয়ে না দেওয়াটা আইনে আছে, কিন্তু আমরা বাল্যবিয়ে রোধ করতে পারছি না। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার সবাই মেয়েটিকে প্রটেকশন দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার কারণে বেশিরভাগ সময় বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। কিশোরী নিজে যদি পড়াশোনা করে তাহলে তার মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়। এখন কিশোরী মেয়েরা নিজেরাই সংগঠন করে তাদের বাল্যবিয়ে রোধ করছে। সবার মধ্যে বাল্য বিয়ে রোধে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সরকার একা পারবে না। সবাই মিলে সচেতনতা তৈরি করে কিশোরীদের বাল্য বিয়ে এবং রক্তস্বল্পতা থেকে বাঁচাতে হবে। তাহলেই কিশোরী মেয়েরা ভালো থাকবে।

 

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মে মাসেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে পারে স্পেন ও আয়ারল্যান্ড
মে মাসেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে পারে স্পেন ও আয়ারল্যান্ড
জেরুজালেমে জাতিসংঘের কার্যালয়ে আগুন দিলো ইসরায়েলি বিক্ষোভকারীরা
জেরুজালেমে জাতিসংঘের কার্যালয়ে আগুন দিলো ইসরায়েলি বিক্ষোভকারীরা
অস্থির সবজির বাজার, মাংস ও ডিমের দামও চড়া
অস্থির সবজির বাজার, মাংস ও ডিমের দামও চড়া
বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের বানান ভুল লিখলো সওজ, চলছে সমালোচনা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের বানান ভুল লিখলো সওজ, চলছে সমালোচনা
৫ জনকে হারিয়ে বিপুল ভোটে ভাইস চেয়ারম্যান সেই সুইটি
৫ জনকে হারিয়ে বিপুল ভোটে ভাইস চেয়ারম্যান সেই সুইটি
দেশের ব্যাংকগুলো ধ্বংস হচ্ছে, তার উদাহরণ এনআরবিসি: জিএম কাদের
দেশের ব্যাংকগুলো ধ্বংস হচ্ছে, তার উদাহরণ এনআরবিসি: জিএম কাদের
অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে পারমাণবিকনীতি পরিবর্তন করবে ইরান
অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে পারমাণবিকনীতি পরিবর্তন করবে ইরান
রাশিয়াকে ঠেকাতে আরও অস্ত্র চাইলেন জেলেনস্কি
রাশিয়াকে ঠেকাতে আরও অস্ত্র চাইলেন জেলেনস্কি