X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমরণ অনশনে শিক্ষকরা: সমাধান কোন পথে?

রশিদ আল রুহানী ও সাদ্দিফ অভি
০৪ জানুয়ারি ২০১৮, ১১:১৮আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০১৮, ১৩:৩৫

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশনরত নন-এমপি শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারি সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষকরা ২০১৩ সাল থেকে এমপিওভুক্তির (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু বারবার সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন করতে দেখা যায়নি। এমপিওভুক্তির দাবিতে এই শিক্ষকরা ‘নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট’-এর ব্যানারে এবার আমরণ অনশন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন। শিক্ষক নেতারা বলছেন, এর আগে সরকারের আশ্বাসে তারা অনেকবার কর্মসূচি স্থগিত করেছেন। তবে এবার দাবি আদায় না করে তারা রাজপথ ছাড়বেন না। এদিকে শিক্ষাবিদরা বলছেন, নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ২২ বার এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিয়েছে সরকার। আর কত আশ্বাস দেবে? এই সংকটের সমাধান কোন পথে?
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর থেকে সরকারি সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষকরা এমপিওভুক্তির দাবিতে অবস্থান নেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে। ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু তার সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে শিক্ষকরা আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছেন। সর্বশেষ গত ২ জানুয়ারি শিক্ষকদের অনশন ভাঙাতে হাজির হন শিক্ষামন্ত্রী নিজে। তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, ‘এখন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশের বাইরে। তবে যাওয়ার আগে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এমপিওভুক্তির বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। আশা করি, আপনারা বিষয়টা বুঝবেন। আপনাদের এমপিওভুক্ত করা হবে।’ তবে তার এই আহ্বানস প্রত্যাখ্যান করেন আন্দোলনরত শিক্ষকরা।
অনশন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত অসুস্থ হয়েছেন ৯০ জন শিক্ষক, তবু অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা এই প্রসঙ্গে সংগঠনের সভাপতি গোলাম মাহামুদুন্নবী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেকবার অনেক কিছু করে দেখেছি আমরা। কোনও সাড়া পাইনি। এবার প্রয়োজন হলে রাজপথে মরবো। তারপরও দাবি আদায় করে ছাড়বো। এমপিও আমাদের দিতেই হবে। এটা আমাদের ন্যায্য দাবি।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ৯৮ শতাংশ বেসরকারি ব্যবস্থাপনানির্ভর। বিভিন্ন স্তরে সাত হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক লাখেরও বেশি শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। কিন্তু এসব শিক্ষক-কর্মচারী নিয়মিত বেতন পান না। দীর্ঘদিন এ কথা বললেও তাতে কেউ তাতে কান দেয়নি। আশ্বাসের ভিত্তিতে আমরা অনেকবার কর্মসূচি স্থগিত করছি। এবার আর দাবি আদায় না করে রাজপথ ছাড়বো না।’
জানতে চাইলে ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হাজী বিশারদ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘২০০৩ সাল থেকে একই স্কুলে শিক্ষকতা করছি। গ্রামের স্কুলে ছেলে-মেয়েরা স্বল্প বেতন কিংবা বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পায়। কিন্তু তাতে তো একজন শিক্ষকের কোনও বেতন হয় না। তবু বছরের পর বছর পাঠদান করে যাচ্ছি। ছেলে-মেয়েরা অন্তত শিক্ষাবঞ্চিত না থাকুক; এই লক্ষ্যেই এ কাজ করি। কিন্তু বিনা বেতনে আর কতদিন শিক্ষকতা করতে পারবো, সেটাও অজানা।’
খুলনার তেরখাদা সোনারতরী নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা সাগরিকা মজুমদার বলেন, ‘দীর্ঘ ১৪বছর ধরে শিক্ষকতা করছি। স্কুলের প্রতি এক প্রকার মায়া জন্মে গেছে বলেই এর সঙ্গে এতদিন থাকা। এতদিন ধরে বিনা বেতনে পাঠদান করে আসছি। আশা ছিল, সরকার আমাদের দেখবে। আশায় আশায় পার হয়ে গেছে অনেক বছর। সরকার এ রকম আশা দিয়ে আমাদের না রাখলেও পারতো।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস কেউ না দেখলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দেখবেন।’
অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়া শিক্ষকদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতে শিক্ষামন্ত্রীর ওপর আস্থা হারিয়েছেন শিক্ষকরা। এ কারণে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী ননএমপিও শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষকরা তার আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারেননি। কারণ শিক্ষামন্ত্রী তার নিজের মন্ত্রণালয়কেই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করতে পারেননি বলেই শিক্ষকরা তার আশ্বাসে ভরসা করতে পারেননি। তারা একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর ওপরই আস্থা রাখেন।’ শিক্ষকরা অধিকারবঞ্চিত উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে সরকারি আমলাদের বেতন বাড়ানো হলো ঠিকই। কিন্তু শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো হয়নি। কাজেই সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে অনেক গলদ আছে। এ সম্পর্কে সরকারের সজাগ থাকতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু একবার নয় ২২ বার তাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আর কতবার আশ্বাস দেবে? হিসাব করে দেখা গেছে, ২ হাজার কোটি টাকা হলেও এসব শিক্ষকের কষ্টের দিন অবসান হয়, কিন্তু এই টাকা দেওয়া তো এমন কিছু না। সরকারের ব্যাংকে যে লুটপাট হয়, যেমন সোনালী ব্যাংকে যে ৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়ে গেলো, তখন অর্থমন্ত্রী বললেন, ৫ হাজার কোটি টাকা তো কিছুই না। এখন শিক্ষকদের এই ২ হাজার কোটি টাকা এত বেশি হয়ে গেলো?’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা মানুষ গড়ার কারিগর, তাদের কেন আজ রাস্তায় নামতে হবে? তাদের দাবি যৌক্তিক। তারা সংগ্রাম করছেন ন্যূনতম জীবন ধারণের তাগিদে। তাদের এমপিওভুক্ত করলে কতই বা বাড়বে? হয়তো দুই থেকে তিন হাজার টাকা। ফলে আমি দাবি করি ওইসব শিক্ষকের বিষয়ে সরকার দ্রুত কোনও সমাধানে আসুক।’
অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়া শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখ্য, সরকারি সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষরা এমপিওভুক্তির দাবিতে প্রথম আন্দোলন শুরু করেন ২০১৩ সালে। ওই বরের ১০ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশ পিপার স্প্রে ব্যবহার করে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর একই বছরের ১৫ জানুয়ারি ন্যাম ভবনের সামনে অনশন কর্মসূচি করতে গেলে মানিক মিয়া এভিনিউর পশ্চিম পাশে পুলিশ বাধা দেয়। সেই বাধা থেকে শুরু হয় হাতাহাতি। একপর্যায়ে পিছু হটেন শিক্ষকরা। সোবহানবাগের প্রিন্স প্লাজার সামনে অবস্থান করতে চাইলে জলকামান ব্যবহার করে পুলিশ। এরপর তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এসে অবস্থান করে। শিক্ষামন্ত্রী এই ঘটনার পর শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ৩ মাসের মধ্যে এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিয়েছিলেন।এই আশ্বাসে পেরিয়ে যায় ‍দুই বছর।
এরপর ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রথমে শহীদ মিনারে সমাবেশ এবং পরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশন পালন করে ‘নন এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশন’। সমাবেশ থেকে বলা হয়, সুস্পষ্ট ঘোষণা না এলে এই আন্দোলন চলবে। সরকার আবারও এমপিওভুক্তির আশ্বাস দেয়। ওই আশ্বাসের পর কেটে যায় একবছর। এরপর ২০১৬ সালে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় আবার রাজপথে নামেন শিক্ষকরা। ওই সময় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অন্তর্ভুক্তি হওয়ার আশ্বাস দেয় সরকার। ওই আশ্বাসের পর শিক্ষকরা ২০১৭ সালের জানুয়ারি আবার অবস্থান নেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে। প্রায় ২৮ দিন অবস্থান করার পর শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসে তারা ফিরে যান বিদ্যালয়ে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও যখন এমপিও প্রসঙ্গ আসেনি। প্রতিবাদে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেন সংগঠনের নেতারা।
আরও পড়ুন-
আমরণ অনশনে অসুস্থ ৯০, হাসপাতালে ভর্তি ৪
দাবি না মানলে কাল থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ নয়, অনশন চালিয়ে যাবেন নন-এমপিও শিক্ষকরা

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় বেড়েছে
দারুল ইহসানের বৈধ সনদধারীদের এমপিওতে বাধা নেই
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
সর্বশেষ খবর
দক্ষিণ লেবাননে ‘আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ’ নিচ্ছে ইসরায়েল
দক্ষিণ লেবাননে ‘আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ’ নিচ্ছে ইসরায়েল
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৯ মাসে ৪৩৫৫ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৯ মাসে ৪৩৫৫ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি
সেতুমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে জিডি
সেতুমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে জিডি
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প বাংলাদেশের পর্দায়
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প বাংলাদেশের পর্দায়
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
তাপপ্রবাহের গেটওয়ে যশোর-চুয়াডাঙ্গা
তাপপ্রবাহের গেটওয়ে যশোর-চুয়াডাঙ্গা