X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘শিক্ষক আকরামুজ্জামান মরে বেঁচেছেন, আমরা অসম্মান নিয়ে বেঁচে আছি’

এস এম আববাস
১৫ জানুয়ারি ২০১৮, ২১:২৬আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০১৮, ২১:৩২

আত্তীকরণ বঞ্চিত শিক্ষকদের মানববন্ধন

ক্যান্সার শরীরে বাসা বাঁধলেও লড়াই করেই টিকে ছিলেন কলেজ শিক্ষক মো. আকরামুজ্জামান। কিন্তু হঠাৎ একটি দুঃসংবাদের শুনে আর শেষরক্ষা হয়নি। গত বছরের ১০ অক্টোবর হঠাৎ মারা যান তিনি। ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ সরকারি হওয়া গোপালগঞ্জের মকসুদপুর কলেজে আত্তীকরণ বঞ্চিত ইসলামী শিক্ষা বিভাগের এই প্রভাষকের এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তার সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা।

এই কলেজের আরেক শিক্ষক ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দীনেশ চন্দ্র বিশ্বাসও আত্তীকরণ বঞ্চিত। এই শিক্ষক গত ৫ জানুয়ারি অবসরে গেছেন। যোগ্যতা অর্জন করেও সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান না পেয়েই চাকরি থেকে বিদায় নিতে হয়েছে তাকে। সুবিধা বঞ্চিত হয়ে ও অসম্মান নিয়ে তার এই বেঁচে থাকাকে অর্থহীন বলে মনে করেন এই শিক্ষক। শুধু তিনিই নন, এই পরিস্থিতির শিকার বেশিরভাগ শিক্ষকের অবস্থা তাদের দু’জনের মতো।

দীনেশ চন্দ্র বিশ্বাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘আত্তীকরণ হবে না শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েন আমার সহকর্মী মো. আকরামুজ্জামান। ক্যান্সারে মরার কথা থাকলেও গত বছরের ৬ অক্টোবর উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। অবশ্য মরে বেঁচেই গেছেন,তাঁকে আর আমাদের মতো অসম্মান বয়ে বেড়াতে হবে না। আর আমি সুস্থভাবে বেঁচে থেকে সারাজীবনই বয়ে বেড়াবো অসম্মান। অবসর নিয়েও পরিবারের সদস্যদের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না। এর চেয়ে আকরামুজ্জামান সাহেবের মতো মরে যাওয়াই ভালো ছিল।’

আকরামুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা এই শিক্ষকদের মৃত্যুর বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেন না বলে জানান দীনেশ চন্দ্র বিশ্বাস।

মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৮ সাল থেকে দেশে বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩২৫টি কলেজ জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকারি কলেজ হিসেবে রূপান্তরিত হয়। ‘আত্তীকরণ বঞ্চিত শিক্ষক ও অশিক্ষক জাতীয় ঐক্যে’র আহবায়ক হুমায়ূন কবির জানান, ৩২৫টি কলেজের মধ্যে ১৭টি কলেজের সব শিক্ষকসহ ৪২টি কলেজের প্রায় প্রায় তিনশত শিক্ষক, প্রদর্শক ও সহকারী গ্রন্থাগারিক আত্তীকরণের সুযোগ পাননি। যদিও কাম্য যোগ্যতা অর্জন করে অনেকেই আত্তীকরণ হয়েছেন। তবে এই তিন শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর অনেকেই কাম্য যোগ্যতা অর্জন করার পরেও আত্তীকরণ বঞ্চিত হয়েছেন।

এদিকে, আগের সরকারি হওয়া ৩২৫টি কলেজ ছাড়াও ২০১৭ সালে আরও ২৮৩টি কলেজ জাতীয়করণের আওতায় নেয় সরকার। এরপর শুরু হয় ‘নো বিসিএস, নো ক্যাডার’ আন্দোলন। পিছিয়ে পড়ে সরকারি হওয়া কলেজের আত্তীকরণ প্রক্রিয়া। এতে ৪২টি কলেজের তিন শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কী হবে তা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। এসব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্তীকরণ না হওয়ায় সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করে ১৮ জন শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব ও মানবাধিকার সংগঠক বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, জাতীয় জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি অধ্যাপক মু. আবুল হাশেম খান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী, সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, শিল্পী অধ্যাপক রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, শিক্ষাবিদ ড. মেসবাহ কামাল, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, সংস্কৃতিকর্মী মাহমুদ সেলিম প্রমুখ।

সংশ্লিষ্ট কলেজ শিক্ষকদের সূত্রে জানা গেছে, সরকারি করা ৪২ কলেজের কিছু শিক্ষক আত্মীকরণের সুযোগ পাওয়ার আগেই অবসরে গেছেন। অনেকেই আবার অবসরে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। একই যোগ্যতা নিয়ে ও মানোন্নয়ন করে কেউ কেউ আত্তীকরণের সুযোগ পেলেও অনেক শিক্ষক বঞ্চিত হয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, কলেজ সরকারিকরণের পর আত্তীকরণ যোগ্যতা না থাকায় মানোন্নয়নের সুযোগ দিয়ে বীরশ্রেষ্ট নূর মোহাম্মদ ডিগ্রি কলেজের সাতজন শিক্ষককে ক্যাডারভুক্ত করা হয়। ২০১৪ সালের ৩ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুনের স্বাক্ষর করা চিঠিতে বলা হয়, ‘পরিদর্শনের পর বর্ণিত শিক্ষকরা (সাত জন শিক্ষক) কাম্য যোগ্যতা অর্জন করেছেন। কর্মরত শিক্ষকদের আত্তীকরণের কাগজপত্র পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে প্রেরণ করা হলো।’

আত্তীকরণ বঞ্চিত শিক্ষক ও অশিক্ষক জাতীয় ঐক্যের আহ্বায়ক হুমায়ূন কবির বলেন, ‘মন্ত্রণালয়কে দেওয়া এই চিঠির আলোকে সাতজন শিক্ষক বর্তমানে ক্যাডারভুক্ত। এই কলেজ ছাড়াও যশোরের শার্শা কলেজের সাতজন, টুঙ্গিপাড়ার জাতির পিতা শেখ মুজিবর রহমান কলেজের ১১ জন শিক্ষকসহ আরও কিছু কলেজ শিক্ষকদের এভাবে আত্তীকরণ করা হয়েছে ক্যাডার হিসেবে।’

‘এ ছাড়া শ্যামনগর মহসীন ডিগ্রি কলেজ, সাতক্ষীরা ও মুজিবনগর ডিগ্রি কলেজ, মেহেরপুর কলেজের দু’জন পদার্থ প্রদর্শকের (ডেমোনেস্টেটর) কাম্যযোগ্যতা না থাকলেও প্রমার্জন সাপেক্ষে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এমনকি এই দু’জনের পদোন্নতির আবেদনও করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। এভাবে ২০০১ সালে বিধি সংশোধন করে ১৮টি মহিলা কলেজের অনেক শিক্ষক প্রদর্শক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রমার্জন সাপেক্ষে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। অথচ কাম্য যোগ্যতা অর্জন করার পরেও অনেক শিক্ষক আত্তীকরণের সুযোগ পাননি।

অন্যদিকে, মানোন্নয়ন করার পরেও রাজশাহীর শহীদ কামারুজ্জামান কলেজের তিন জন শিক্ষককে আজ অবধি আত্তীকরণ করা হয়নি। তবে আগামী ১৮ জানুয়ারি প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় এই কলেজের ৫৪টি পদ সৃজনের বিষয়টি উত্থাপনের জন্য এজেন্ডায় রাখা হয়েছে। এই ৫৪ জন ছাড়াও আরও ১০ জন শিক্ষক, প্রদর্শক ও সহকারী গ্রন্থাগারিক বাদ পড়েছেন। যাদের মধ্যে কাম্য যোগ্যতা অর্জন করা শিক্ষকও রয়েছেন। কাম্য যোগ্যতা থাকা বাদ পড়াদের মধ্যে রয়েছেন কলেজের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক হারুন অর রশিদ সাপলু, সমাজ বিজ্ঞানের আইরিন পারভীন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের আবুল কালাম আজাদ।

‘আত্তীকরণ বঞ্চিত শিক্ষক ও অশিক্ষক জাতীয় ঐক্যে’র সদস্য সচিব হারুন অর রশিদ সাপলু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারের কাছে আমাদের প্রস্তাব ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জাতীয়করণ করা ৪২টি কলেজের বিধিবদ্ধ বৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত যোগ্য প্রায় তিনশত শিক্ষক ও প্রদর্শক এবং সহকারী গ্রন্থাগারিকের আত্তীকরণের সুযোগ দেওয়া জরুরি। তা না হলে এসব শিক্ষকদের সঙ্গে বৈষম্য করা হবে। আমরা চাই সবাইকেই আত্তীকরণ করা হোক।’

আত্তীকরণ বঞ্চিত ৪২ কলেজের শিক্ষকদের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে সরকারি হওয়া সব কলেজ শিক্ষক-কর্মকর্তারা আত্তীকরণের সুযোগ পাবেন। তবে কাম্য যোগ্যতা না থাকলে নীতিমালার বাইরে কাউকে আত্তীকরণ করা যাবে না।’

এতদিনেও আত্তীকরণ সম্পন্ন হয়নি কেনও জানতে চাইলে ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন বলেন, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পদ সৃজনের অনুমোদন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ ছাড়ের অনুমোদন না হলে আত্তীকরণ করা যায় না। তবে সবগুলোই প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কাম্য যোগ্যতা থাকা সবাইকেই আত্তীকরণের সুযোগ দেওয়া হবে।’

/টিএন/
সম্পর্কিত
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুজিবনগর দিবস পালনের নির্দেশ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই ধাপে কৃমি নিয়ন্ত্রণ সপ্তাহ পালনের নির্দেশ
টেস্ট পরীক্ষার নামে অতিরিক্ত ফি নিলে ব্যবস্থা
সর্বশেষ খবর
গরমে পুড়ছে খুলনা বিভাগ
গরমে পুড়ছে খুলনা বিভাগ
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি