X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

আট কিলোমিটারে ৬৮ মাদ্রাসা!

সোহেল মামুন ও আসিফ ইসলাম শাওন
১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ১৭:৪৬আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০১৮, ১০:১১

কওমি মাদ্রাসায় পাঠ নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা (ফাইল ফটো)

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত আট কিলোমিটার মহাসড়কের আশপাশে গড়ে উঠেছে ৬৮টি মাদ্রাসা। এর মধ্যে ৬৬টি ব্যক্তি মালিকানাধীন কওমি মাদ্রাসা এবং দুটি সরকার অনুমোদিত আলিয়া মাদ্রাসা।

ব্যক্তি মালিকানাধীন কওমি মাদ্রাসাগুলো সরকারের পক্ষ থেকে কোনও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বা অনুদান পায় না। তবে মাদ্রাসাগুলো স্থানীয় এবং পৃষ্ঠপোষকদের অনুদান ও সাহায্য সহযোগিতায় পরিচালিত হয়। যদিও কয়েকটি মাদ্রাসার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। কিছু কিছু মাদ্রাসা এতিমখানা হিসেবে পরিচালিত হয় এবং সেখানে আর্থিক অনুদান শুধুমাত্র এতিমদের জন্য ব্যয় করার বাধ্যবাধকতা আছে। এসব মাদ্রাসায় সরকারের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানগুলোর অতীত কর্মকাণ্ড বিচার বিবেচনা করেন।

এছাড়া, ওই আট কিলোমিটার মহাসড়কে ৪৭টি স্কুল-কলেজের খোঁজ পাওয়া গেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে।

দেশে আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। ২০১১ সালে প্রকাশিত অধ্যাপক আবুল বারাকাতের ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অব মাদ্রাসা এডুকেশন’ শীর্ষক বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে দুই হাজার ৭২১টি মাদ্রাসা ছিল। আর ২০০৮ সালে দেশে মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ১৫২টি।

যদিও বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস (ব্যানবেইস)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৯ হাজার ৩১৯টি আলিয়া মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। এর মধ্যে তিনটি সরকারি এবং বাকিগুলো বেসরকারি। এসব মাদ্রাসায় মোট ২৪ লাখ ৯ হাজার ৩৭৩ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।

অধ্যাপক আবুল বারাকাতের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের আলিয়া মাদ্রাগুলোতে মোট ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ৮২ জন শিক্ষার্থী ছিল। এছাড়া, একই সময়ে ৩৯ হাজার ৬১২টি কওমি মাদ্রাসায় ৫২ লাখ ৪৭ হাজার ৬৬০ জন শিক্ষার্থী ছিল।

তবে ব্যানবেইস দেশের কওমি মাদ্রাসা এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যার কোনও তথ্য রাখে না।

অধ্যাপক আবুল বারাকাতের গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ১৯৫০-২০০৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাদ্রাসার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এ সময়ে কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা ৪ হাজার ৪৩০টি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ১৩০টি। গত ৬০ বছরে দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ১৩ গুণ এবং আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা ১১ গুণ বেড়েছে।

১৯৯১-২০০০ সাল পর্যন্ত দেশে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার হার সবচেয়ে বেশি ছিল। এই সময়ের মধ্যে দেশে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়।

আলোচনাকালে গবেষক, রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষকরা জানান, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা এবং শুরুতেই ধর্ম বিশ্বাসের কারণে বাংলাদেশে মাদ্রাসার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়ছে। সঠিকভাবে শিক্ষানীতি প্রণয়নে সরকারের অবহেলার কারণেও মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে।

এ বিষয়ে গাজীপুরে মুন্সিপাড়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা এবং এতিমখানার প্রিন্সিপাল মাওলানা রফিকুল আলম বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য একেবারেই ভিন্ন। যারা ধার্মিক হতে চান বা ধর্ম নিয়ে কাজ করতে চান, তারাই মাদ্রাসা শিক্ষাকে বেছে নেন।’

জানা গেছে, দেশে এক ডজনের বেশি শিক্ষাবোর্ডের আওতায় কওমি মাদ্রাসাগুলো পরিচালিত হয়। তবে গুটিকয়েক কওমি মাদ্রাসা কোনও শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হয় না। বিভিন্ন এলাকায় মসজিদের অধীনেও মক্তব আকারে কওমি মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। গ্রাম ও শহর এলাকায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় মূলত শিশুদের পড়া, লেখা, ব্যাকরণ শেখা এবং ইসলামি শিক্ষা দেওয়ার জন্য। বিশেষ করে কিরাত (কোরআন তেলওয়াত) শেখানো হয় এসব মক্তবে।

বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক) বা বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কওমি মাদ্রাসাগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বহুল পরিচিত। সংগঠনটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বেফাকের অধীনে মোট পাঁচ হাজার ৪৫১টি মাদ্রাসা পরিচালিত হয়।

মাওলানা রফিকুল আলম বলেন, ‘ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই আমাদের সমাজের অনেক মানুষ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে চান। এছাড়া, বেফাক নিজ অনুসারীদের কমিউনিটিগুলোতে বেশি করে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ইসলামকে প্রমোট করা এবং বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা।’

মাদ্রাসা জনপ্রিয় হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাওলানা রফিকুল আলম বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যয়ভার সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার চেয়ে কম।  মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় থাকা-খাওয়ার সুবিধা দেওয়া হয়, যা সাধারণ স্কুল কলেজে থাকে না।’

তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, কওমি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের জন্য রাষ্ট্রের সহায়তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করে এবং সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর করতে চায় না।

কওমি মাদ্রাসার অর্থায়ন এবং ব্যবস্থাপনা

দেশের প্রতিটি কওমি মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য মজলিশ-আস-সুরা নামে একটি ম্যানেজিং কমিটি থাকে। মাদ্রাসার প্রধানের নেতৃত্বে কমিটিতে থাকেন শিক্ষক এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। এছাড়া, একটি এক্সিকিউটিভ কমিটি থাকে। কমিটির প্রধান এবং মাদ্রাসার প্রধান (মোহতামিম) প্রতিষ্ঠানের ফান্ড দেখভালের দায়িত্বে থাকেন।

অধ্যাপক আবুল বারাকাতের বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, কওমি মাদ্রাসার অর্থের উৎস প্রধানত দুটি। একটি অভ্যন্তরীণ, অপরটি বিদেশি উৎস। স্বচ্ছল ব্যক্তিরা মাদ্রাসার ফান্ডে যাকাত, ফিতরা এবং সাদকার টাকা অনুদান হিসেবে দেন। এছাড়া, ওয়াকফ সম্পত্তি, গ্রাম এলাকায় ফসল চাষ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি আদায়ও মাদ্রাসার ফান্ডের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। মানুষ কোরবানির পশুর চামড়াও মাদ্রাসাগুলোতে দান করেন।

অন্যদিকে, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারীরাও কখনও বাড়ি বাড়ি গিয়ে, কখনও রেল ও বাসস্ট্যান্ডে গিয়েও অনুদান সংগ্রহ করেন। এ সময় তারা অনুদানকারীকে রশিদও সরবরাহ করেন। অতীতে মানুষ মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোতে নতুন ফসল অনুদান হিসেবে দিতো। তবে এখন তারা সেখানে অনুদান হিসেবে টাকা দেন।

বিদেশ থেকেও মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোতে নিয়মিত অনুদান আসে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপিয়ান দেশগুলো থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এসব অনুদান পাঠান। কিছু বিদেশি সংস্থাও মাদ্রাসাগুলোতে অনুদান পাঠায়, তবে এবিষয়টি গোপন রাখা হয়।

অধ্যাপক আবুল বারাকাত বলেন, ‘অধিকাংশ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ফান্ডের উৎস সম্পর্কে মুখ খুলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। কওমি মাদ্রাসাগুলো বিভিন্ন নামে ফান্ড সংগ্রহ করে।বিশেষ করে সাধারণ ফান্ড, লিল্লাহ ফান্ড (গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য), বই কেনার ফান্ড, অবকাঠামো নির্মাণ ফান্ড ইত্যাদি। একটি মানসম্পন্ন কওমি মাদ্রাসা বছরে গড়ে ২৫ লাখ টাকা খরচ করে।’

আলিয়া মাদ্রাসার অর্থনৈতিক কাঠামো

আলিয়া মাদ্রাসার অর্থনৈতিক কাঠামো পরিচালিত হয় মূলত একটি ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে। যেখানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। কমিটিতে একজন শিক্ষা অফিসার, মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল, শিক্ষক, অভিভাবক এবং এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা থাকেন।

এসব মাদ্রাসার সার্বিক অর্থনৈতিক দিক দেখভাল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড এবং মাদ্রাসা বোর্ড। মাদ্রাসার সব ধরনের খরচ এক্সিকিউটিভ কমিটি এবং স্থানীয় শিক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস অনুমোদন করে। এসব মাদ্রাসার সব লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

অলিয়া মাদ্রাসা মূলত সরকারি রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট থেকে ফান্ড পায়। কোনও কোনও অলিয়া মাদ্রাসা ব্যক্তিগত অনুদানও পায়। শিক্ষক, কমিটির সদস্য এবং শিক্ষার্থীরা এসব ব্যক্তিগত অনুদান সংগ্রহ করতে সহায়তা করেন।

সৌজন্য: ঢাকা ট্রিবিউন

/এসএনএইচ/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
রমজানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে সাপ্তাহিক ছুটি কমতে পারে
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্যাতন চলতে পারে না: মানবাধিকার কমিশন
সর্বশেষ খবর
জাবি ছাত্রলীগের সেই ৩ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ 
জাবি ছাত্রলীগের সেই ৩ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ 
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়