X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

দাঁতের চিকিৎসা করবেন কে?

তাসকিনা ইয়াসমিন
১৯ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:১৪আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০১৮, ১০:১৮

ডেন্টাল সার্জনরা ডিগ্রি হিসেবে লেখেন বিডিএস, আর টেকনোলজিস্টরা লেখেন বিডিএ

বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) আইন অনুযায়ী শুধু এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রিধারীরাই চিকিৎসা করতে পারবেন। এরমধ্যে বিডিএস ডিগ্রিধারীরা কেবল দাঁতের চিকিৎসা করেন। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। দেশে সনদধারী ডেন্টাল সার্জনদের পাশাপাশি বিএসসি ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট, ডিপ্লোমা ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট এবং কোয়াকরা (হাতুড়ে ডাক্তার) হরহামেশাই দাঁতের চিকিৎসা করছেন। এ নিয়ে ডেন্টাল সার্জনদের সঙ্গে অন্যদের পেশাগত দ্বন্দ্ব- রেষারেষি বিদ্যমান। এমনকি দুপক্ষের এ দ্বন্দ্ব আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছে।

দেশে কর্মরত ডেন্টাল সার্জনরা বলছেন, ডেন্টাল সার্জন ছাড়া অন্য কেউ দাঁতের চিকিৎসা করলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ ডেন্টাল টেকনোলজিস্টরা প্র্যাকটিস করার অনুমতি চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেছেন। তারা যাতে প্র্যাকটিস করতে না পারেন, সেজন্য আদালতে পাল্টা আপিল করেছেন ডেন্টাল সার্জনরা।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কোষাধ্যক্ষ ও কনজারভেটিভ ডেনটিসট্রি অ্যান্ড অ্যান্ডোডনটিকস বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আলী আসগর মোড়ল বলেন, ‘আম আর আমড়া দুইটা দুই জিনিস। টেকনোলজিস্টরা কখনও দাঁতের ডাক্তার হতে পারেন না। তারা তো চিকিৎসক না। কিভাবে তারা ক্লিনিক চালাবেন? কিভাবে তারা রোগীর ট্রিটমেন্ট করবেন? তারা ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ডেন্টাল সার্জনদের সহযোগিতা করার জন্য। তাদের ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট হিসেবেই থাকতে হবে।’   

টেকনোলজিস্টদের রোগী দেখার ব্যাপারে তিনি বলেন,‘এখন দেশে যেটা হচ্ছে, তা বিএমডিসি অ্যাক্টের পরিপন্থী। একজন টেকনোলজিস্ট রোগী দেখলে তা রোগীর জন্য ক্ষতিকর হবে।’  

ডা. আলী আসগর আরও  বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা আদালতে আপিল করেছি। ডেন্টাল সার্জনদের টেকনোলজিস্ট দরকার। তারা আমাদের সহযোগিতা করবেন। তারা চাইলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবেন। এমনকি তারা পিএইচডি পর্যন্ত করতে পারবেনব। কিন্তু একজন ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট কখনও ডেন্টাল সার্জন হতে পারবেন না, বা রোগীর চিকিৎসা করতে পারবেন না। একজন চিকিৎসকের সঙ্গে কাজ করে তারা অভিজ্ঞ হয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু তাই বলে কখনও চিকিৎসক হতে পারেন না।’

একজন ডেন্টাল টেকনোলজিস্টের লেটার হেড

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কাসেম বলেন,  ‘ডেন্টাল টেকনোলজিস্টরা প্র্যাকটিস করতে চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেছেন। পরবর্তীতে আমরাও আপিল করেছি। কেন তারা প্র্যাকটিস করতে পারবেন না, তা আমাদের জানাতে বলা হয়েছে। বিএমডিসি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ডেন্টাল সোসাইটি এসব প্রশ্নের উত্তর হাইকোর্ট দিচ্ছে। আমরা আশাবাদী রায় আমাদের পক্ষে থাকবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশে এখন প্রায় এক লাখের মতো এমবিবিএস চিকিৎসক ও ১০ থেকে ১৫ হাজার ডেন্টাল সার্জন আছেন । স্বাভাবিক কারণেই তাদের আয় ভালো। তাদের চাহিদা বেশি থাকায় ডেন্টাল টেকনোলজিস্টরা এই পেশায় আসতে চাইছেন। তবে তারা নিজেরা চিকিৎসক না হয়ে চেম্বারে ডাক্তারের সহযোগী হয়ে অনায়াসে কাজ করতে পারেন।’ 

ডা. আবুল কাশেম আরও বলেন, ‘জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে নগ্নপদ ডাক্তার  (কোয়াক) চালু করেছিলেন। যাদের কোনও ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। তখন কোয়াকরা কেউ ৫ বছর, কেউ ১০ বছর, কেউ ২০ বছরের রেজিস্ট্রেশন নেন। এখন আর তারা কেউ নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন না। বিএমডিসি থেকে তাদের আর কোনও সুযোগ দেওয়া হবে না। মেডিসিন ও সার্জারি বিষয়ে ডেন্টাল টেকনোলজিস্টদের পড়াশোনাও নেই।  তাদের শিক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্যে রোগী দেখার বিষয়টি নেই। তারা রোগী দেখলে তা রোগীর জন্য হ্যাজার্ড হবে।’

রোগী দেখার অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে বিএমডিসি’র রেজিস্ট্রার ডা. মো. জাহিদুল হক বাসুনিয়া বলেন, ‘আমরা শুধু এমবিবিএস ও বিডিএসদের সার্টিফিকেট দেই ও তাদের রেজিস্ট্রেশন করি। আমরা ছয়টি ডিসিপ্লিনে রেজিস্ট্রেশন করি। কিন্তু এর কোনোটিতেই ডেন্টাল টেকনোলজিস্টরা নেই। আমাদের এখানে রেজিস্ট্রেশন করার কোনও কোয়ালিফিকেশন নেই তাদের। ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট বা কোয়াক— যারা চিকিৎসা করছেন, তারা আইনবিরোধী কাজ করছেন। তবে এসব টেকনোলজিস্ট বা কোয়াকদের (হাতুড়ে ডাক্তার) নিয়ে চিন্তা করে না বিএমডিসি। এটা রাষ্ট্রীয় ব্যাপার। নীতিনির্ধারকরা তাদের আইনের আওতায় আনবেন কিনা সেটা তাদের ব্যাপার।’  

কিন্তু বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন ২০১০ এর ধারা ৫ এর ১৯ ও ২০ উপধারায় বলা হয়েছে, যারা নিবন্ধিত চিকিৎসক নয়, তাদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বিএমডিসি।

এ প্রসঙ্গে ডা. জাহিদুল হক বাসুনিয়া বলেন, ‘আমাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নেই। পৃথিবীর কোনও দেশেই সব অর্গানাইজেশনের এসব ক্ষমতা থাকে না। কোথাও ভুয়া চিকিৎসকের তথ্য পেলে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলি। তারা পদক্ষেপ নেয়। এ ব্যাপারে বিএমডিসির মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে সিভিল সার্জন থাকেন। তিনি নিজে বা তার প্রতিনিধিকে পাঠাতে পারেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডেন্টাল টেকনোলজিস্টরা মূলত টেকনিশিয়ান। তারা ডেন্টাল সার্জনের সহযোগী হয়ে কাজ করবেন। তারা কাজ দেখে দেখে শেখেন, অভিজ্ঞতা হয় বলেই যে লাইসেন্স দেওয়া হবে এটা ঠিক না।’

কোয়াক ডাক্তার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এর কোষাধ্যক্ষ ও কনজারভেটিভ ডেনটিসট্রি অ্যান্ড অ্যান্ডোডনটিকস বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আলী আসগর মোড়ল বলেন, ‘জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট থাকার সময় পল্লী চিকিৎসক হিসেবে কোয়াকদের বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন দেন। তখন সীমিত সংখ্যক গ্রাম্যচিকিৎসক তৈরি হয়। এখন বিএমডিসি এই রেজিস্ট্রেশনের পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। আমার মতে, কোনও ট্রেনিং ছাড়া ১০ বছরও কেউ প্র্যাকটিস করলে ডাক্তার হওয়া যায় না।’

একজন ডেন্টাল টেকনোলজিস্টের বিজ্ঞাপন সাধারণ মানুষ চেম্বারে বসা ডেন্টাল সার্জনদের সঙ্গে টেকনোলজিস্ট ও কোয়াকদের পার্থক্য কিভাবে বুঝবেন, জানতে চাইলে ডা. আলী আসগর মোড়ল বলেন, ‘তারা (টিকনোলজিস্ট ও কোয়াক) তাদের প্রেসক্রিপশনে বিভিন্ন ধরনের ডিগ্রির কথা উল্লেখ করেন, যা ভুয়া। একজন ডেন্টাল সার্জনের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিডিএস কথাটি থাকবে। অন্যদের ক্ষেত্রে বিডিএস শব্দটি লেখা থাকে না।’  

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক ডা. নাজমুল হক সজিব বলেন, ‘আমাদের পরিচিতি দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই বিডিএস লেখা থাকবে, সঙ্গে বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন নম্বরও দেওয়া থাকবে। কেউ ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার করলে, অনলাইনে গিয়ে তালিকা দেখে যাচাই করা যায়। আমরা যদি সবাই সচেতন হই, তাহলে সহজেই এ পার্থক্য বোঝা সম্ভব।’

টেকনোলজিস্ট ও কোয়াকদের কাছে চিকিৎসা করানোর কারণে রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন দাবি করে ডা. আলী আসগর মোড়ল বলেন, ‘বাংলাদেশে দুই ধরনের চিত্রই দেখা যায়। প্রথমত, রোগীরা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করাতে বিদেশ যান। দ্বিতীয়ত, দাঁতের চিকিৎসা করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে রোগীরা এই দেশে আসেন। উচ্চ ও মধ্যম শ্রেণির মানুষ কখনও ডেন্টাল সার্জন ছাড়া দাঁতের চিকিৎসা করান না। কিন্তু অল্প শিক্ষিত মানুষেরা না বুঝে তাদের কাছে সেবা নিতে গিয়ে ঠকছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘যারা আমাদের কাছে আসতে পারছেন না, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রথমে রোগীরা তাদের কাছে চিকিৎসা নেন। পরে দেখা যায়, ক্যান্সার হয়ে গেছে। পরে আমাদের কাছে আসেন তারা। কিন্তু তখন  আর কিছু করার থাকে না।’

সার্জন ও টেকনোলজিস্টদের নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্ত সৃষ্টির কারণ হিসেবে তিনি আরও বলেন, ‘সারাদেশের সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে ডেন্টাল সার্জনের পদ রয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় ডেন্টাল সার্জন আছেন। একইভাবে ডেন্টাল টেকনোলজিস্টদের পদও রয়েছে। তাদের আচরণই এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

ডেন্টাল সার্জনদের অভিযোগ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজারে অবস্থিত আর কে ডেন্টাল কেয়ারের ডেন্টিস্ট (ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট) মো. রায়হান কবির টেলিফোনে বলেন, `আমার চেম্বারে এখন একজন বিডিএস আসে। তাকে দিয়েই চালাচ্ছি। আমি নিজে আর প্র্যাকটিস করি না। আমি ঢাকা থেকে তিন বছরের কোর্স করেছি।’ প্র্যাকটিসের অনুমতি চেয়ে আদালতে টেকনোলজিস্টদের আপিল এবং তার নিজের পড়াশোনার বিষয়ে জানতে চাইলে রায়হান কবির কোনও মন্তব্য না করে ফোন কেটে দেন।

এ বিষয়ে জানতে বঙ্গবন্ধু টেকনোলজিস্ট পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক কামাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাৎক্ষণিক কোনও মন্তব্য করতে চাননি। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকেও পাওয়া যায়নি।

 

/এএইচ/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালহৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা
কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা
ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কবে সমন্বয় করবে রাজউক?
বহুতল ভবনের সংজ্ঞাফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কবে সমন্বয় করবে রাজউক?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়