X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

রোগীর সঙ্গে ভালো আচরণ করা বাধ্যতামূলক, কিন্তু দেখবে কে?

তাসকিনা ইয়াসমিন
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৭:২৬আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৮:২০

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের অবস্থার খোঁজ-খবর নিচ্ছেন  উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান।

দুই বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন কুমিল্লার ব্যবসায়ী আব্দুল রানা (৩৫)। অ্যাম্বুলেন্সে তাকে নেওয়া হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। ভোর রাত থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত প্রায় চার ঘণ্টা হাসপাতালের সামনের বারান্দায় ছিলেন তিনি। তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনও আয়া বা ওয়ার্ডবয় এগিয়ে আসেননি।
রানার (ছদ্মনাম) বাম পা অচল হয়ে গেছে। সে সময় চিকিৎসকরা বলেছিলেন, যদি হাসপাতালে নিয়ে আসার পরপরই চিকিৎসা শুরু করা যেত তাহলে হয়তো তার পা অচল হতো না।
রাজধানীর ধানমন্ডির বাসিন্দা আফরোজ (ছদ্মনাম) অসুস্থ স্বামীকে প্রায় ছয় মাস আগে ভর্তি করান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে। কিডনি সমস্যার জন্য দুদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর হাসপাতাল ছাড়েন তারা। ওই সময় কোনও আয়া সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেননি। অথচ ছাড়পত্র নিয়ে হাসপাতাল ছাড়ার সময় দুই আয়া বখশিস চান।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মীরা জামান তার সাত মাস বয়সী অসুস্থ ছেলেকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ভর্তি করান। তবে ছেলে বাঁচেনি। লাশ নিয়ে হাসপাতাল ছাড়ার সময় কর্মচারীরা বখশিস দাবি করেন। বিস্ময়ে হতবাক ও বিমূঢ় হয়ে পড়েন তিনি।
আব্দুল রানা, মীরা জামান বা আফরোজ শুধু নন, প্রতিদিনই দেশের কোনও না কোনও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে নার্স, আয়া ও ওয়ার্ডবয়দের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ পান রোগী ও তার স্বজনেরা। কখনও কখনও রোগীর সঙ্গে খারাপ আচরণের জন্য শাস্তিও পান হাসপাতালের কর্মচারী-কর্মকর্তারা। কিন্তু অবস্থার তেমন হেরফের হয় না। এ অবস্থা পরিবর্তনে প্রতিষ্ঠানেরই দায়িত্ব তাদের কর্মীদের জন্য নীতিমালা ও আচরণবিধি তৈরি করা এবং মেনে চলতে বাধ্য করা বলে মত স্বাস্থ্যখাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। পাশাপাশি তা কার্যকর হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নজরদারি জরুরি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের অবস্থার খোঁজ-খবর নিচ্ছেন  উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান।
নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালের গেটে কোনও মুমূর্ষু রোগী এলে তার জন্য গেট খুলে দেবেন দারোয়ান। এরপর তাকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে জরুরি চিকিৎসা শেষে রোগীর জন্য নির্ধারিত ওয়ার্ড বা কেবিনে ট্রলি বা স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাবেন ওয়ার্ডবয় বা আয়ারা।
দেশের কিছু বেসরকারি হাসপাতালে গেট থেকে রোগীদের ভেতরে নিয়ে যাওয়াসহ ওয়ার্ড বা কেবিনের জন্য হাসপাতালের নির্ধারিত কর্মী থাকলেও সরকারি হাসপাতালে তা বিরল। আত্মীয় বা সঙ্গে আসা ব্যক্তিই ছোটাছুটি করে রোগীকে বেড পর্যন্ত নিয়ে যান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট সান্তনা রাণী দাস বলেন, ‘আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী প্রতি চারজনে একজন এবং আইসিইউতে একজনের জন্য একজন নার্স থাকার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয় না। বিএসএমএমইউ’র আইসিইউতে ২১টি বেডের বিপরীতে ৬০ জন নার্স আছে। দিনে একজন নার্সের বিপরীতে দুজন রোগী দিই, কিন্তু রাতে একজন নার্সের বিপরীতে ৬-৭ জন রোগী হয়ে যায়। আমাদের নার্সের প্রতি নির্দেশনা আছে, যে রোগী আসবে তাকে সেবা দিতে হবে। ইনজেকশন, মেডিসিন ইত্যাদি চেক করে দিতে হবে। দুর্ব্যবহার করা যাবে না। রোগীর সঙ্গে ফ্রেন্ডলি হতে হবে, যেন রোগী তার অসুবিধার কথা বলতে পারেন । নার্সরা চেষ্টা করে ভালোভাবে সেবা দিতে। এরপরও মাঝে মাঝে অভিযোগ আসে।’
তিনি বলেন, ‘দেরি করে কেউ উপস্থিত হলে লেট ফি’র ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমাদের এখানে ভালো নার্সের জন্য অ্যাওয়ার্ড আছে, খারাপ করলে শাস্তির ব্যবস্থা।’ ২০০১ সাল থেকে চারজন নার্স অসদাচরণের জন্য শাস্তি পেয়েছে বলেও জানান তিনি।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শাহেদুর রহমান খান বলেন, ‘সাধারণত হাসপাতালের লোকাল স্টাফদের বিরুদ্ধে রোগীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া যায়। সুইপার, আয়ারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকে। তারা খুব অল্প বেতন পায়। ওদের বেতন পেতে দেরি হয়। ওরা রোগীদের সার্ভিস দেয়।’ দুই পক্ষের লেনদেনে মিল না হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ আসে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিএসএমএমইউ হাসপাতালে রোগীদের পর্যবেক্ষণ করেছেন নার্সরা
হেলথ রাইটস মুভমেন্ট ন্যাশনাল কমিটির প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা দুই ধরনের- পাবলিক ও প্রাইভেট। সরকারি হাসপাতালে সরকারি চাকরির নিয়ম বিরাজমান। রোগীদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে তিনটি কারণ বিরাজমান। প্রথমত, সরকারি হাসপাতালে রোগীর প্রত্যাশা বেশি; দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের সক্ষমতা এবং রোগীর সেবার জন্য আনুষঙ্গিক যা থাকার কথা, সেসবের স্বল্পতা। সব মিলিয়ে আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা রোগীবান্ধব নয়। রোগীবান্ধব করতে গেলে কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আছে, তাদের ওরিয়েন্টেশন করা দরকার। রোগীর অনেক বেশি চাপ থাকায় নার্স ও চিকিৎসকদের কম্বিনেশন রোগীবান্ধব নয়। মনে হয় যেন রোগীকে চিকিৎসক বা নার্সরা দয়া করছেন। অথচ এটা তার অধিকার।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে মানুষ যায়। সেখানে দাবি বেশি। সেখানে সে চিকিৎসা করাতে আগ্রহী। সরকারি হাসপাতালে মানুষ নেগলেক্টেড হয়, অ্যাবিউজ হয় না। কিন্তু প্রাইভেট সেক্টরে দুটোই ঘটে। এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য রোগীর মতামত, রোগীর প্রত্যাশা বোঝা দরকার এবং সে মোতাবেক কাজ করা দরকার। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে যেটা দেখা যায়, বাইরের লোকের ইনফ্লুয়েন্স বেশি পড়ে। চিকিৎসক যে পরামর্শ দেন, রোগীরা সেটা না শুনে বাইরের মানুষের কথা বেশি শোনেন। তৃতীয়ত, উটকো লোকজন রোগীর ব্যাপারটাকে পুঁজি করে অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা হাসপাতালের নেই।’
প্রফেসর ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘প্রাইভেট সেক্টরে মাল্টিসেক্টরাল সমস্যা। হাইটেকনোলজি আছে, উচ্চশিক্ষিত মানুষরা কাজ করেন হাসপাতালে, কিন্তু এর মূল অন্তরায় রেগুলেট করার মেকানিজম। জবাবদিহির ব্যাপার নেই। অ্যাট দ্য সেম টাইম, হাসপাতালের প্রত্যেকটা জিনিস খরচ হয়, তারপর হাসপাতাল প্রফিট করে।’
তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাদের চাকরি স্থায়ী। ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী, তাদের বদলি করা যাবে না। তাদের রাজনৈতিক প্রভাব। সুতরাং এই চক্রের কাছ থেকে সার্ভিস আদায় করা কঠিন। সাধারণ কারো পক্ষে সম্ভব নয়। দলবাজি, গডফাদার ও দুর্বৃত্তায়ন— তিন মিলে এই চক্র তৈরি হয়েছে।’
আর চিকিৎসকের ব্যাপারে প্রফেসর ডা. রশীদ-ই-মাহবুবের মত হলো, সব চিকিৎসক সব ব্যাপারে দক্ষ নন। চিকিৎসক ভুল করলে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সরকারের সেই তদারকি দরকার।

/এইচআই/এফএস/টিএন/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া