X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

জালিয়াতির গবেষণা প্রবন্ধ দিয়ে জাবি শিক্ষকের পদোন্নতি!

সোয়াইব রহমান সজীব
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৯:৫৭আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২১:১৬

জালিয়াতির গবেষণা প্রবন্ধ দিয়ে জাবি শিক্ষকের পদোন্নতি! জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সাবেরা সুলতানার বিরুদ্ধে দুটি গবেষণা প্রবন্ধে জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে একটি গবেষণা প্রবন্ধ ব্যবহার করে সম্প্রতি তিনি সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপকে পদোন্নতি পেয়েছেন। ভারতের একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত ওই প্রবন্ধের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেম্পা’র অধ্যাপক ক্যাথরিন ভ্যান স্প্যাংকেরেনের লেখা একটি বইয়ের বেশ কিছু অংশের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। এছাড়া, দর্শন বিভাগের জার্নালে প্রকাশিত সাবেরা সুলতানার আরেকটি গবেষণা প্রবন্ধের বিভিন্ন অংশে চারজন ভারতীয় লেখকের লেখা কপির প্রমাণও বাংলা ট্রিবিউনের হাতে এসেছে।     

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক জানিয়েছেন, উদ্ধৃতি বা উল্লেখ ছাড়া নিজের জবানিতে অন্যের ভাষার সরাসরি ব্যবহার চৌর্যবৃত্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়। এতে গবেষকের নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জাবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম জানিয়েছেন, কেউ জালিয়াতির প্রমাণসহ অভিযোগ উত্থাপন করলে সেটি নিয়ে কাজ করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ইংরজি বিভাগের সভাপতি তানিয়া শারমীন ছুটিতে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।      

বাঁয়ে সাবেরা সুলতানার প্রবন্ধের অংশবিশেষ। ডানে ক্যাথরিন ভ্যান স্প্যাংকেরেনের বইয়ের একটি অংশ প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২০ জুলাই পদোন্নতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন করেন সাবেরা সুলতানা। নিয়ম অনুযায়ী, এজন্য তিনি তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। গত ২ অক্টোবর সিলেকশন বোর্ড প্রবন্ধগুলো মূল্যায়ন ও সাক্ষাৎকার নিয়ে তার পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করে। এরইমধ্যে গবেষণা প্রবন্ধে জালিয়াতির একটি অনানুষ্ঠনিক অভিযোগ পান উপাচার্য। পরে ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় জালিয়াতির বিষয়টি উঠলে সেদিনের মতো তাকে পদোন্নতি দেওয়া থেকে বিরত থাকে সিন্ডিকেট। পরে ২৯ নভেম্বর আরেকটি বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্ত আগের সিন্ডিকেটের তারিখ থেকে কার্যকর হয়।

বাঁয়ে সাবেরা সুলতানার প্রবন্ধের অংশবিশেষ। ডানে ক্যাথরিন ভ্যান স্প্যাংকেরেনের বইয়ের একটি অংশ   অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেরা সুলতানা পদোন্নতির জন্য যে তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন, তার একটি ২০১৬ সালের এপ্রিলে ভারতের ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সায়েন্টেফিক রিসার্চ (আইওএসআর) নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে (ভলিউম ২১, ইস্যু ৪) প্রকাশিত হয়। জার্নালটির ৫৮-৬৫ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘ইনভেস্টিগেটিং আমেরিকান রোমান্টিসিজম: এ কম্পারেটিভ স্টাডি’ শিরোনামের প্রবন্ধটি সাবেরা সুলতানা এবং বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক মো. মহিউল ইসলামের যৌথ গবেষণা। মহিউল ইসলাম জাবির ৩৬তম আবর্তনের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। 

বাঁয়ে কপুলার জার্নালে সাবেরা সুলতানার প্রবন্ধ। ডানে দ্য নভেলস অব অনিতা দেশাই অ্যা ক্রিটিক্যাল স্টাডি’র অংশবিশেষ প্রবন্ধটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাদের প্রবন্ধের শুরুর একটি বড় অংশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেম্পা’র ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ক্যাথরিন ভ্যান স্প্যাংকেরেনের লেখা ‘আউটলাইন অব আমেরিকান লিটারেচার’ বইয়ের কিছু অংশের হুবহু মিল রয়েছে। বইটির প্রকাশক যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বইয়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদে ক্যাথরিন ‘দ্য রোমান্টিক পিরিয়ড, ১৮২০-১৮৬০: এসেয়িস্ট্স অ্যান্ড পয়েট্স’ শিরোনামে আমেরিকান সাহিত্যের রোমান্টিক পিরিয়ডের কবি ও প্রাবন্ধিকদের নিয়ে আলোকপাত করেন। এই পরিচ্ছেদের পরিচিতি অংশ থেকে সাবেরা সুলতানা সেগুলো গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এজন্য তিনি কোনও রেফারেন্স বা উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করেননি।

বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত সহ-গবেষক মহিউল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৬ সালের শুরুর দিকে ম্যাডাম (সাবেরা সুলতানা) আমাকে রিসার্চ প্রজেক্টে কাজ করার প্রস্তাব দেন। এ প্রজেক্টকে রিসার্চ আর্টিকেলে রূপ দিতে শুধু পেপার অ্যারেঞ্জমেন্ট, সেনটেন্স সিকোয়েন্সিং, গ্রামার চেক, প্রুফ রিডিং ও পেপার সাবমিটের কাজগুলো আমি করেছি। পুরোটাই ম্যাডামের গবেষণা ছিল।’    

এ বিষয়ে সাবেরা সুলতানা বলেন, ‘আমি এবং আমার এক কলিগ ২০১০-২০১১ সালে গবেষণা করি। ২০১৬ সালে তা জার্নালে প্রকাশিত হয়। অন্য কোনও জায়গা থেকে কপি করা হয়নি। আমার গবেষণাপত্রটি আগে পাবলিশ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগের জবাব দিয়ে আমি পদোন্নতি পেয়েছি।’

বাঁয়ে কপুলার জার্নালে সাবেরা সুলতানার প্রবন্ধ। ডানে ‘অনিতা দেশাই অ্যান্ড হার ফিকশনাল ওয়ার্ল্ড’ বইয়ের অংশবিশেষ এছাড়া, ২০১২ সালের জুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ‘কপুলা’ জার্নালে সাবেরা সুলতানার একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। জার্নালের ৪৭-৫৪ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘বিম, দ্য প্রোটাগনিস্ট, ইন অনিতা দেশাই’স ক্লিয়ার লাইট অব ডে:এন এমবডিমেন্ট অব এমানসিপেশন’।

প্রবন্ধটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এটির ৪৮, ৫১ ও ৫২তম পৃষ্ঠার কয়েকটি লাইন ভারতের মহিত কে রায়ের ‘ইন্ডিয়ান রাইটিং ইন ইংলিশ’ গ্রন্থ থেকে কপি করা হয়েছে। ৪৮তম পৃষ্ঠার একটি অংশ নেওয়া হয়েছে ভারতের নেরু টেন্ডনের ‘অনিতা দেশাই অ্যান্ড হার ফিকশনাল ওয়ার্ল্ড’ গ্রন্থ থেকে। একই দেশের মনমোহন কে ভত্মাগরের ‘ফেমিনিস্ট ইংলিশ লিটারেচার’ গ্রন্থের সঙ্গে সাবেরা সুলতানার প্রবন্ধের ৪৯ ও ৫২তম পৃষ্ঠার কিছু অংশে হুবহু মিল পাওয়া গেছে। ৪৯, ৫০ ও ৫৩ পৃষ্ঠার বেশ কিছু অংশ নেওয়া হয়েছে মনমোহন কে ভত্মাগর ও মিত্তপল্লী রাজেশ্বরের ‘দ্য নভেলস অব অনিতা দেশাই: অ্যা ক্রিটিকাল স্টাডি’ থেকে। ওই চারটি বই ২০০০ থেকে ২০০৭ সালের বিভিন্ন সময়ে ভারতের আটলান্টিক পাবলিশার্স অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউটর থেকে প্রকাশিত হয়।

সাবেরা সুলতানার এই প্রবন্ধের রিভিউয়ার ছিলেন ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু তাহের মজুমদার। তিনি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মারা যান।

দর্শন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সাবেরা সুলতানার জালিয়াতির বিষয়টি প্রথমে বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপকের নজরে আসে। পরে ২০১৫ সালে একাডেমিক কমিটির সভায় অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসানকে আহ্বায়ক করে ‘কপুলার সামগ্রিক উন্নয়ন ও পরামর্শ প্রদান’ নামে একটি কমিটি করা হয়।

গবেষণা প্রবন্ধের সমস্ত দায় গবেষকের উল্লেখ করে দর্শন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ তারেক চৌধুরী বলেন, ‘শিগগিরই একাডেমিক সভায় কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে। সভার সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবহিত করা হবে।’

এ প্রবন্ধের বিষয়ে সাবেরা সুলতানা বলেন, ‘প্রবন্ধটি সাবমিট করার সময় তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলাম। অসতকর্তাবশত রেফারেন্সিং মিস হয়ে যেতে পারে। প্রবন্ধ প্রকাশের পর এর দায় রিভিউয়ার ও এডিটরের।’          

বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ’র ৩ নং ধারায় বলা আছে, কোনও শিক্ষক শিক্ষকতা-গবেষণাকর্মে উদাসীন কিংবা অবহেলাকারী হিসেবে গণ্য হলে তাকে লঘু শাস্তি হিসেবে সতর্কীকরণ/তিরস্কার এবং গুরু শাস্তি হিসেবে পদাবনতি/বরখাস্ত করা হতে পারে। পাশাপাশি এক বা একাধিক শাস্তিও আরোপ করা যেতে পারে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাবেরা সুলতানা তার গবেষণা প্রবন্ধের বিষয়ে যেসব তথ্য উপস্থাপন করেছেন, তাতে দেখা গেছে তার প্রবন্ধটিই আগে প্রকাশিত হয়েছে। এ বিবেচনায় তিনি পদোন্নতি পেয়েছেন। এরপরও যদি কেউ প্রমাণসহ অভিযোগ করে তবে সেটি নিয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এসব বিষয় কখনও তামাদি হয় না।’

আরও পড়ুন:

আলোচনায় প্লেজারিজম: আইনি প্রতিকার কী?

 

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দুই চিকিৎসকের ওপর হামলার প্রতিবাদে হাসপাতালে কর্মবিরতির ঘোষণা
দুই চিকিৎসকের ওপর হামলার প্রতিবাদে হাসপাতালে কর্মবিরতির ঘোষণা
১৯টি সামরিক সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ, ২৭টি নিয়ে আলোচনা চলছে
১৯টি সামরিক সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ, ২৭টি নিয়ে আলোচনা চলছে
সালাউদ্দিনের ছেলের অভিষেকের দিনে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
সালাউদ্দিনের ছেলের অভিষেকের দিনে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
বৈধপথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধপথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার