X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে সহায়ক হতে পারে ‘ডিস্ট্রিবিউটেড প্রিন্টিং’

আসিফ ইসলাম শাওন
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৮:৩৪আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৯:২০

ছবি: ঢাকা ট্রিবিউন দেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে নতুন একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। তারা এর নাম দিয়েছেন ‘ডিস্ট্রিবিউটেড প্রিন্টিং’। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে কেন্দ্রগুলোতেই প্রশ্নপত্র ছাপানো যাবে পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণ আগে।

সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিদ্যমান পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে সহায়ক হতে পারে প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতি।

প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে ব্যর্থ হয়ে গত বছরের জুলাইয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এরপর থেকেই বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি দল প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ শুরু করে।

এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে ব্যবস্থা নিতে বিচার বিভাগীয় ও প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর মধ্যে প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির সদস্য ও বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এম সোহেল রহমান বলেন, ‘আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে স্বল্পমেয়াদ ভিত্তিতে আমরা চেষ্টা করছি।’

জানা গেছে, একইসঙ্গে একই বিভাগের অধ্যাপক ড. এম কায়কোবাদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি প্রশ্নফাঁস সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানে কাজ করছেন। এজন্য তারা দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন। এমনকি হাইকোর্টে সুপারিশ করার আগে এই সমস্যা নিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু করেছে কমিটি।

প্রাথমিক ধারণা: ‘ডিস্ট্রিবিউটেড প্রিন্টিং’ পদ্ধতি
বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘ডিস্ট্রিবিউটেড প্রিন্টিং’ পদ্ধতি প্রশ্নপত্র ফাঁসস রোধে ভালোভাবে কাজে আসতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই পদ্ধতি ব্যয়বহুল মনে হলেও ভবিষ্যতে এটা যুক্তিসঙ্গত লাগবে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হলে প্রতিটি পরীক্ষা কেন্দ্রে উচ্চ গতির ইন্টারনেট, একটি প্রিন্টার, একটি ফটোকপিয়ার ও কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরা দিতে হবে সরকারকে।

অধ্যাপক সোহেল রহমান বলেন, ‘আমাদের বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, নতুন পদ্ধতি যুক্ত করতে প্রত্যেক প্রার্থীকে গুনতে হবে ৬০০-৯০০ টাকা। আর এই পদ্ধতি একবার যুক্ত করে ফেললে তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নূন্যতম ব্যয় বহন করতে হবে কর্তৃপক্ষকে। এটি একটানা ৫-৬ বছর ব্যবহার করা যাবে।’

যেভাবে কাজ করবে ‘ডিস্ট্রিবিউটেড প্রিন্টিং’ পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্নগুলো বেছে নেওয়া হবে। অধ্যাপক সোহেল রহমান বলেন, ‘এজন্য আমরা একটি ডিজিটাল প্রশ্ন ব্যাংক গঠনের কথা ভাবছি। যশোর শিক্ষা বোর্ড ইতোমধ্যে পাইলট প্রকল্পের আওতায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রশ্ন বেছে নিতে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করছে।’

বছরের বিভিন্ন সময় বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের কাছ থেকে এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রশ্ন সংগ্রহ করবে শিক্ষা বোর্ড। পরীক্ষার দিন সকালে আরেকটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে ওই প্রশ্নব্যাংক থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রশ্ন বেছে নেওয়া হবে। তবে এই প্রশ্নব্যাংক ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে না। ফলে তা হ্যাক হওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই।

বুয়েটের এই শিক্ষক বলেন, ‘প্রশ্নব্যাংক থেকে এলোমেলোভাবে প্রশ্ন বেছে নেওয়া হবে না। সেখানেও একটি কঠিন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। এরপর প্রশ্নগুলো প্রিন্টিংয়ের জন্য পাঠানো হবে পরীক্ষা কেন্দ্রে।’

তবে বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেছেন, এ ধরনের প্রশ্নব্যাংক তৈরি করতে সময় প্রয়োজন। এছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে অন্য উপায় বের করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। তবে তাদের মূল লক্ষ্য— ফাঁস ঠেকাতে পরীক্ষার আগে যেন প্রশ্ন ছাপানো না হয়।

অধ্যাপক সোহেলের ভাষ্য, ‘যারা প্রশ্নপত্র তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকবেন তাদেরকে বিচারকদের মতো নিযুক্ত করা হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রশ্ন প্রস্তুতকারী শিক্ষকরা পরীক্ষার আগের দিন রাতে শিক্ষা বোর্ডের অফিসে যাবেন। সেখানে তারা প্রশ্নপত্র তৈরি করবেন ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা তা দেখভাল করবেন। এভাবে সকালের মধ্যে প্রশ্নপত্র প্রস্তুত হয়ে যাবে। এমনকি প্রশ্নপত্র প্রস্তুতকারীরা পরীক্ষা শুরুর আগ পর্যন্ত নজরদারিতে থাকবেন।’

নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যমে পাঠানো হবে প্রশ্নপত্র
পরীক্ষ কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পাঠানোর পদ্ধতি হবে এনক্রিপ্ট ও পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত। অধ্যাপক সোহেল বলেন, ‘আমাদের হিসাব করতে হবে, কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র প্রিন্ট দিতে কত সময় লাগবে। সময় হিসাব করেই পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পাঠানো হবে। প্রশ্নপত্রের সফট কপি পাঠানো হবে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।’

হ্যাকাররা সহজে খুঁজে পাবে না এমন ভিপিএন-এর মাধ্যমে কনটেন্ট পাঠানো হবে। সেগুলো হ্যাক করা সহজ হবে না কিংবা হ্যাকাররা তা পেলেও পাসওয়ার্ড চাইবে। বুয়েটের এই শিক্ষক জানান, এজন্য শক্তিশালী পাসওয়ার্ড তৈরি করা হবে যা ভাঙা খুবই কঠিন।

তবে এই অধ্যাপক উল্লেখ করেছেন, কোনও পদ্ধতিই অলঙ্ঘনীয় নয়। তাই যে কোনও পদ্ধতি ভাঙার আগেই কেবল প্রশ্নপত্র প্রিন্ট করা যাবে এমনটা নিশ্চিত করবেন বিশেষজ্ঞরা। তিনি বলেন, ‘যদি আমরা হ্যাকারদের কাছ থেকে এই পদ্ধতি ৪-৫ ঘণ্টা নিরাপদ রাখতে পারি তাহলেই যথেষ্ট। এ পদ্ধতিতে পাসওয়ার্ড দিতে কয়েকটি জটিল প্রটোকল অনুসরণ করা হবে। তাই হ্যাকারদের পক্ষে তা আবিষ্কার করা সহজ নয়।’

পরীক্ষা কেন্দ্রগুলো থাকবে নজরদারিতে
এ পদ্ধতিতে প্রাইভেট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রশ্নের ফাইল আসার পর পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে তা প্রিন্ট করা হবে। অধ্যাপক সোহেল বলেন, ‘প্রশ্নপত্র প্রিন্টের ফুটেজ রাখার জন্য কেন্দ্রগুলোতে রিয়েল টাইম ক্যামেরা স্থাপন করা যেতে পারে। ওই ভিডিও পরে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে দেখা যাবে।’

বুয়েটের এই শিক্ষকের বক্তব্য, ‘এই পদ্ধতি সুশৃঙ্খলভাবে তৈরির জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমান্ড স্টেশন স্থাপন করা যেতে পারে। যেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সিসিটিভির রিয়েল টাইম ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করবেন। এছাড়া প্রিন্টারের আশপাশে কেউ প্রশ্নপত্রের ছবি তোলার চেষ্টা করলে একটি কৃত্রিম পর্যবেক্ষণ যন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি তুলে কমান্ড স্টেশনে পাঠিয়ে দেবে।’

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য— এই নজরদারির মাধ্যমে উচ্চপর্যায়ের সুরক্ষা রাখা সম্ভব, তবে তা নির্ভর করবে খরচের ওপর। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী কিংবা শিক্ষামন্ত্রী ঘরে বসে পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোর রিয়েল টাইম ফুটেজ দেখতে পারবেন এমন পদ্ধতি সাজানোর সামর্থ্যও আছে আমাদের।’

বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য— ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে ‘ডিস্ট্রিবিউটেড প্রিন্টিং’ পদ্ধতির মতো স্থায়ী সমাধানে যেতে চাইবে না সরকার। এর চেয়ে বরং পরীক্ষার আধঘণ্টা আগে শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়া বাধ্যতামূলক করা বা ইন্টারনেট বন্ধ রাখার মতো স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপই বেছে নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

‘ডিজিটাল খাম’ পদ্ধতি
বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট প্রেস (বিজি প্রেস) নির্ধারিত প্রশ্ন সেট কম্পোজ, প্রিন্ট, প্যাকেজ করে ও ট্রাঙ্কে তুলে সেগুলো তালাবদ্ধ করে রাখে ট্রাঙ্কে। পরবর্তী সময়ে সেগুলো জেলা প্রশাসনের ট্রেজারি কার্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে সরবরাহ করা হয়।

অধ্যাপক সোহেল বলেন, ‘আমরা প্রশ্নপত্র রাখার জন্য সিলযুক্ত ট্রাঙ্কের পরিবর্তে ‘ডিজিটাল খাম’ বা ‘ডিজিটাল বক্সে’র মতো নতুন প্রযুক্তি আনতে চাই। কেউ যদি পরীক্ষার আগে ওই খাম বা বক্স খোলেন তাহলে অ্যালার্ম বেজে উঠবে অথবা নির্দিষ্ট মোবাইল নম্বরে এসএমএস চলে যাবে।’

অনেক দেশ প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে এই পদ্ধতি ব্যবহার করছে বলে জানান এই অধ্যাপক। তার ভাষ্য, ‘আগে আমরা ভাবতাম, সুরক্ষিত খামের ভাবনাটা কাজে আসবে। কিন্তু সম্প্রতি বিজি প্রেস ঘুরে আমরা জানতে পেরেছি, প্রশ্নপত্র কয়েকবার সংশোধন ও বাছাই করা হয়। তাই এসব প্রক্রিয়ার কোনও পর্যায়ে ডিজিটাল খাম ব্যবহার করবো তা নিয়ে বেশ দ্বিধায় পড়েছি আমরা।’

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রশ্নপত্র তৈরির পুরো পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা ফেরা দরকার। আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার আগে তাদের হাতে আর ৪০ দিন আছে। তবে অধ্যাপক সোহেলের মন্তব্য, ‘এত অল্প সময়ে সব বোর্ডে নতুন পদ্ধতি চালু করা সম্ভব নয়। এটা অনেক বড় একটা কাজ। তবে ভবিষ্যতের স্থায়ী সমাধানের কথা ভাবা যেতেই পারে।’

বুয়েটের এই শিক্ষকের মতে, ‘প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার হবে ইঁদুর-বিড়াল খেলার মতো। এটা নিয়মিত আপডেট করতে হবে। যে পদ্ধতিই সরকার নির্বাচন করবে, এ বিষয়ে নিয়মিতভাবে কৌশল নির্ধারণ ও পর্যালোচনায় মনোযোগী হতে হবে। এটা যুদ্ধের মতোই ব্যাপার।’

/এসএনএইচ/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
অবৈধ ব্যবহারকারীদের ধরতে বাড়ি বাড়ি যাবে তিতাস
অবৈধ ব্যবহারকারীদের ধরতে বাড়ি বাড়ি যাবে তিতাস
ছক্কায় মুশফিকের ‘আউট’ নিয়ে যা বললেন রনি
ছক্কায় মুশফিকের ‘আউট’ নিয়ে যা বললেন রনি
ফাইনালে ১১ মিনিট লড়াই, জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন বাঘা শরীফ
ফাইনালে ১১ মিনিট লড়াই, জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন বাঘা শরীফ
বন ডাকাতদের জন্যই পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয়: জিএম কাদের
বন ডাকাতদের জন্যই পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয়: জিএম কাদের
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা