X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনবাজি রেখে অস্ত্রধারী খুনিকে ধরলেন তারা (ভিডিও)

আমানুর রহমান রনি
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০১:০০আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:১৬

অস্ত্রধারী খুনিকে ধরার ঘটনা বর্ণনা করছেন কেয়ারটেকার ফরিদ উদ্দিন ও শ্রমিক আরোচ খান

একজন অস্ত্র উঁচিয়ে যাকে দেখছে তার দিকেই গুলি করছে, মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে, আর তাকে আটকানোর জন্য পিছু পিছু চারজন বয়স্ক মানুষ দৌড়াচ্ছেন। খেটে খাওয়া এই চার ব্যক্তির সাহসিকতায় শেষমেশ ধরা পড়লো অস্ত্রধারী খুনি।

শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে মেরুল বাড্ডার মাছ বাজারের ভেতরে আবুল বাশার বাদশা (৩২) নামে এক যুবককে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তিন খুনি। তবে মাছ বাজারের ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও কেয়ারটেকারের সাহসিকতায় ধরা পড়ে এক খুনি। তার নাম নুরুল ইসলাম নূরা। পরবর্তীতে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় সে।

রামপুরা ব্রিজ-মধ্যবাড্ডা সড়কের মাঝামাঝি ও ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনের জায়গায় মেরুল কাঁচাবাজার। বাজারের পেছনেই মসজিদ। মসজিদের পেছনে মাছের আড়ত। এই আড়তে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মাছ নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা। রাতেই মূলত বাজারটিতে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের উপস্থিতি বেশি থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে লোকজনও কমতে থাকে। সেখানেই শনিবার দুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয় আবুল বাশার বাদশাকে।

ঘটনার পর নুরুল ইসলাম নূরার পিছু নেন চার ব্যক্তি এবং ধাওয়া করতে করতে একপর্যায়ে অস্ত্রধারী নূরাকে ধরেও ফেলেন তারা। জীবনবাজি রেখে এভাবে অস্ত্রধারী খুনিকে ধরার পর থেকে তারা সবার প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সেদিন কী ঘটেছিল, কীভাবে খুনিকে ধাওয়া করে ধরা হয়েছিল, সেই ঘটনা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন সাহসী মানুষগুলো।

রবিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বিকালে মাছের আড়তে ঢুকতেই দেখা যায়, মসজিদের প্রবেশমুখে কয়েকজন মুসল্লি দাঁড়িয়ে আছেন। কথা বলে জানা যায়, তাদের কেউ শ্রমিক, কেউ ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে একজন কেয়ারটেকার ফরিদ উদ্দিন, যিনি প্রথম নুরুল ইসলাম নূরাকে আটকে ছিলেন। ফরিদ উদ্দিন সেই ঘটনার বর্ণনা দেন।

বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি  বলেন, ‘মাছের আড়তের মধ্য দিয়ে সরু পথ রয়েছে ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির দিকে যাওয়ার জন্য। শনিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চারজন ব্যক্তি এসে দীর্ঘ সময় কথা বলছিলেন। আমি তাদের বললাম, এখানে থাকা যাবে না, আপনারা চলে যান। তারা বলল, “আমরা পাঁচ মিনিট পর চলে যাবো।” এরপর তারা একসঙ্গে হেঁটে মাছের আড়তের বাথরুমের সামনে যায়।’

তিনি বলেন, ‘বাথরুমটি পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ফরিদ নামে এক ব্যক্তি সেখানে দায়িত্ব পালন করে। বাথরুম ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে সে টাকা নিয়ে থাকে। সে বাথরুমের পাশেই দাঁড়ানো ছিল। এমন সময় হাফ-হাতা শার্ট পরা দুই ব্যক্তি একজনকে ধরে বাথরুমের ভেতরে নিয়ে যায়। পাঞ্জাবি পরা এক ব্যক্তি তাকে গুলি করে। এরপর তারা পালিয়ে যাচ্ছিল। তখন ফরিদ বাথরুমের পাশ থেকে হেলাল নামে এক ছেলেকে ইশারায় ‍গুলির কথা বলে। তখন আমি, মাছ ব্যবসায়ী কালিম সরদার, শ্রমিক আরোচ খান ও মো. বাচ্চু মসজিদের গেটে দাঁড়ানো ছিলাম। হেলাল তখন আমাদের বলল, এই গুলি করে পালিয়ে যাচ্ছে। দুইজন আড়তের পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যায়।’

এখানেই খুন করা হয় আবুল বাশার বাদশাকে

তিনি আরও বলেন, ‘পাঞ্জাবি পরা ব্যক্তিকে আমি দাঁড়াতে বললাম। তখন সে আমার পেটে পিস্তল ঠেকায়। এরপর আমি সরে আসি। সে যখন একটু দূরে যায়, আমি একটা ইটের আধলা তুলে তার দিকে ছুড়ে মারি। তার পিঠে ইটটি পড়ে, এরপর সে পড়ে যায়। আমাদের দিকে গুলি করে। আমরা শুয়ে পড়ি। এরপর আবার গুলি করে। কিন্তু তখন গুলি আর বের হয় না। এরপর সে রামপুরা ব্রিজের দিকে দৌড় দেয়। আমরা তার পিছু পিছু দৌড়াই। সে গুলি করার ভয় দেখায়, কিন্তু আমরা কেউ পিছু ছাড়ি নাই। সে হাতিরঝিলের দিকে যায়। আমরাও সেদিকে ছুটি এবং তাকে ধরে ফেলি। তখন সে আবার গুলি করার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। এরপর পুলিশ আসলে তাকে ও তার পিস্তলটি ‍পুলিশের কাছে দেওয়া হয়।’

অস্ত্রের মুখে এভাবে জীবনবাজি রেখে প্রতিরোধ গড়ার সাহস দেখানোর বিষয়ে ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এখানে কাজ করি। যদি এই খুনি এখান থেকে চলে যেতো, তাহলে খুনের দায় পড়তো আমাদের ওপর। একজন মানুষকে এভাবে হত্যা করে পালিয়ে যাবে, তা আমরা চাইনি। গুলি করার পরও আমরা তার পেছনেই ছিলাম।’

ফরিদ উদ্দিনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, সেসময় অপর সাহসী ব্যক্তি আরোচ আলী তার পাশেই ছিলেন। আরোচ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটুর জন্য আমাদের গায়ে গুলি লাগেনি। যখন সে গুলি করে, আমরা শুয়ে পড়ি। এজন্য বেঁচে গেছি। তা না হলে আমাদেরও লাশ পড়তো।’

তবে অপর দুই খুনিকে ধরতে না পারায় তাদের মধ্যে অনুশোচনা বোধ হচ্ছে। তারা দুজন বলেন, হত্যা করেছে তিনজন মিলে। দুজন আড়তের পেছন দিক দিয়ে চলে গেছে। তাদের আটকানো যায়নি। তবে যে গুলি করেছে আমরা তাকেই ধরেছি।’ যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা এর আগে কখনও এখানে আসেনি বলেও জানান তারা।

পুলিশের হাতে সোপর্দ করার পর নুরুল ইসলাম নূরাকে নিয়ে শনিবার দিবাগত রাতেই অভিযানে যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। বাড্ডার সাতারকুলে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সে নিহত হয়। নূরা বনানীতে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক সিদ্দিক হোসেন মুন্সি হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের ভাষ্য, নূরা ও বাদশা একসঙ্গে অপরাধ জগতে কাজ করতো। তাদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে কোনও দ্বন্দ্বের কারণেই বাদশাকে নূরা গুলি চালিয়ে হত্যা করে।

নিহত বাদশা মেরুল বাড্ডার আনন্দনগরে ১৭নং রোডে মা-বাবা ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। সে শরীয়তপুরের ডামুড্ডার মোস্তফা ফকিরের ছেলে। শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে স্ত্রী শিউলি আক্তার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে বাদশার লাশ শনাক্ত করেন। তার স্ত্রী জানান, বাদশা পুলিশের সোর্স হিসাবেও কাজ করতো। তবে পুলিশ তা অস্বীকার করেছে।

শিউলি জানান, তারা বছরখানেক ধরে বাড্ডায় থাকেন। এর আগে টঙ্গিতে থাকতেন। সেখানে থাকার সময় বাদশা মাদক মামলায় এক বছর জেল খাটে। সেখান থেকে বাড্ডায় আসার পর বাদশা মৌচাকের একটি শাড়ির দোকানে চাকরি নেয়। শিউলি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন।

নিহত বাদশার লাশ তার পরিবারের কাছে রবিবার হস্তান্তর করেছে পুলিশ। তবে নূরার লাশ এখনও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।

গত ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানীতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে সিদ্দিক মুন্সিকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায় নূরাকে খুঁজছিল পুলিশ। এই মামলায় গত ৮ ডিসেম্বর ডিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় দুই সন্দেহভাজন আল-আমিন ও সাদ্দাম। আল-আমিন নূরা ও বাদশার গ্রুপে কাজ করতো বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ডিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, আল-আমিন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর তার স্ত্রীকে নূরা এক লাখ টাকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে বাদশা রাজি হচ্ছিল না। এই গ্রুপটির ক্যাশিয়ার ছিল বাদশা। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ হয়। তাই বাদশাকে তারা গুলি করে। এ সময় রাজু, মাসুম ও আরিফ নূরার সঙ্গে ছিল। এদের গ্রেফতারে পুলিশ কাজ করছে।

এই গ্রুপটির টঙ্গিতে মাদক স্পট রয়েছে বলেও জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।

বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওয়াজেদ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাদশা হত্যার ঘটনায় একটি এবং ক্রসফায়ারের ঘটনায় একটি—মোট দুটি মামলা হয়েছে। হত্যা মামলায় নূরাসহ চারজন আসামি ছিল। বাকি আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘অপরদিকে নূরার কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় রামপুরা থানায় একটি মামলা হয়েছে।’

 

/এমএ/এইচআই/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঘুমের ওষুধ খাইয়ে স্বামীর পুরুষাঙ্গ কেটে স্ত্রীর ’আত্মহত্যা’
ঘুমের ওষুধ খাইয়ে স্বামীর পুরুষাঙ্গ কেটে স্ত্রীর ’আত্মহত্যা’
‘ভারত কিংবা অন্য কোনও দেশে এমনটি দেখিনি’
‘ভারত কিংবা অন্য কোনও দেশে এমনটি দেখিনি’
পশ্চিম তীরে ১০ যোদ্ধাকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
পশ্চিম তীরে ১০ যোদ্ধাকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
গরম থেকে বাঁচতে ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকানে ভিড়
গরম থেকে বাঁচতে ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকানে ভিড়
সর্বাধিক পঠিত
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও