X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিউ ইয়র্কে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে বাংলা

শাহাব উদ্দিন সাগর, নিউ ইয়র্ক
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:১১আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:২২

 

 



নিউ ইয়র্কে বাংলায় ছাপা হওয়া ভোটার গাইড যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক একটি সদা জাগ্রত নগর। এখানে বসবাস করছেন বহু ভাষাভাষী মানুষ। এ তালিকায় আছে পাঁচ লাখের মতো বাংলাদেশিও। বহু ভাষাভাষীর এ নগরে ইংরেজির পর সরকারি-বেসরকারিভাবে দাফতরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে স্প্যানিশ। তবে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে বাংলা ভাষাও।

নিউ ইয়র্কের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের ব্যালটে ব্যবহার হয়েছে বাংলা। ভাষার মাসে স্বীকৃতি মিলেছে নিউ ইয়র্কের স্কুলগুলোতে বাংলা ভাষা অন্তর্ভুক্তিকরণের। বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোর হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিলবোর্ডে দেখা মেলে বাংলার। ডিপার্টমেন্ট অব মটর ভেহিক্যালের (ডিএমভি) লার্নার পরীক্ষায় দেওয়া যাচ্ছে বাংলায়। এছাড়া কিছু দিন আগে ট্যাক্সি ও লিমোজিন কমিশনও (টিএলসি) বাংলা ভাষায় পরীক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি চালু করেছে।

নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশি প্রবাসীরা বলছেন, এধারা অব্যাহত থাকলে একদিন বাংলা নিউ ইয়র্কের দাফতরিক ভাষার জায়গা করে নেবে।

নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে নিউ ইয়র্ক সিটি নির্বাচন। এতে বাংলাদেশি ভোটারদের সম্পৃক্ততা বাড়ার কারণে কর্তৃপক্ষ বাংলায় ভোটার নির্দেশিকা প্রকাশ করেছিল। কারণ, দিন দিন মূল ধারার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বাংলাদেশিরা।’

নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক পরিচয়’-এর সম্পাদক নাজমুল আহসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিউ ইয়র্কের দফতরগুলোতে বাংলা ভাষার প্রচলন বাড়ছে। দেড় দশকের বেশি আগে বাংলা প্রচলন শুরু হয়েছিল শিক্ষা বিভাগে। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়েছে নিউ ইয়র্কের অন্যান্য সরকারি দফতরে। সবখানেই গুরুত্বের সঙ্গে স্থান করে নিয়েছে ভাষা বাংলা। অনেক দিন ধরেই সিটির বেশকিছু হাসপাতালে, বিশেষ করে বাংলাভাষী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বাংলার ব্যবহার চালু হয়েছে। প্রবেশপথে লেখা হয়েছে “স্বাগতম”। রিসেপশন কাউন্টারে লেখা হয়েছে “অভ্যর্থনা”। অন্যান্য নির্দেশনাও বাংলায় লেখা আছে।’
শুধু দৃশ্যমানভাবেই নয়, বিভিন্ন অফিস ও নিউ ইয়র্ক সিটির বিভিন্ন দফতরে বাংলাভাষীদের সুবিধার দিকে লক্ষ্য রেখে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ‘ইন্টারপ্রিটেশন’ ব্যবস্থায়। এই ব্যবস্থায় অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি এখন পাওয়া যাচ্ছে বাংলা দোভাষী। ইংরেজি বলতে অক্ষম বা ইংরেজিতে স্বল্পজ্ঞানসম্পন্ন বাংলাভাষীদের জন্য কাজ করছেন এই দোভাষীরা। তারা বাংলা থেকে ইংরেজিতে এবং ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তর করে দিচ্ছেন।

কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট মাজেদা উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আরও কিছু ভাষার পাশাপাশি দাফতরিক কাজে সরকারিভাবে বাংলার প্রথম প্রচলন করেছিল সিটির শিক্ষা বিভাগ। তাদের অধীনে পরিচালিত বিভিন্ন স্কুলে বাংলাভাষী শিক্ষার্থীদের সংখ্যার দিকে লক্ষ্য রেখে গৃহীত হয়েছিল তাদের এই উদ্যোগ। ২০০১ সালে তাদের তৈরি সিটির স্কুল শিক্ষাব্যবস্থার ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্রে প্রথম সংযোজিত হয়েছিল বাংলা ভাষা। প্রামাণ্যচিত্রের প্রারম্ভেই অন্য ভাষার সঙ্গে সঙ্গে একজন বাংলাদেশি শিক্ষিকাকে দিয়ে বলানো হয়েছিল “স্বাগতম”।’

শিক্ষা বিভাগের পথ ধরে সিটির অন্যান্য দফতরও এগিয়ে এসেছে এই উদোগে। প্রথম প্রথম কিছু ভুল শব্দ, ভুল বানান বা ভুল প্রয়োগের ঘটনা ঘটলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভুল দূর হয়ে যাচ্ছে। এখন নির্ভুল ও চমৎকার ভাষায় এবং সুন্দর হরফে বাংলা বিজ্ঞপ্তি, ঘোষণা ইত্যাদি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

ডিপার্টমেন্ট অব হোমলেস সার্ভিসের বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তিতে শুদ্ধ ভাষায় বাংলার প্রয়োগ হচ্ছে। তাদের বিজ্ঞপ্তির ১১টি ভাষার মধ্যে বাংলা একটি। তাদের একটি বিজ্ঞপ্তির বাংলা এরকম, ‘আপনি কি বাংলায় কথা বলেন? অনুগ্রহ করে বসুন। আমি আপনার জন্য একজন দোভাষী ডাকবো।’ শুদ্ধ বানানে সুন্দর ভাষায় লেখা বিজ্ঞপ্তিটি প্রশংসনীয় হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি ডিপার্টমেন্ট অব মোটরভেহিক্যালস (ডিএমভি) ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার পরীক্ষা বাংলায় দেওয়ার সুবিধা চালু করেছে।

আমেরিকা বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সভাপতি দর্পণ কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অতি সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক সিটির পাবলিক স্কুলে বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মহান ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির শুরুতে নিউ ইয়র্কের প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য শিক্ষা বিভাগের এই ঘোষণা একটি বড় সুসংবাদ হিসেবে এসেছে। এ ঘোষণার ফলে বাংলাভাষী শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষায় পড়াশোনার সুযোগ পাবে।’

সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক সিটির স্কুল চ্যান্সেলর কারমেন ফারিনা এ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। তার এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে এডুকেশন ডিপার্টমেন্টকে সাধুবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশি অভিভাবক ও কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ।

যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ স্কুল ডিস্ট্রিক্ট হিসেবে পরিচিত নিউ ইয়র্ক স্কুল সিটির চ্যান্সেলর কারমেন ফারিনা বাংলাকে নিউ ইয়র্কের এক হাজার ৮০০ স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘দ্বিভাষিক ক্লাসে শিশুরা নিজেদের ভাষার পাশাপাশি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবে।’

নির্দেশিকায় অন্য ভাষার পাশাপাশি রয়েছে বাংলাও নিউ ইয়র্কের স্কুল চ্যান্সেলরের ঘোষণাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন আইনপ্রণেতা নিদিয়া ভ্যালেসকুয়েজ। তিনি বলেছেন, ‘নিউ ইয়র্ক সিটির বাসায় মা-বাবা যে ভাষায় কথা বলেন, সেই ভাষাকে ক্লাসে গুরুত্ব দেওয়ায় শিশুরা আমেরিকান ভাষার প্রতি আরও উৎসাহিত হবে। বহুজাতিক এই সিটি তথা আমেরিকার ঐতিহ্যকে মহিমান্বিত করতে শিশুরাও অপরিসীম ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।’
নিউ ইয়র্ক সিটি এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের অধীনে পাবলিক স্কুলের শিক্ষক শাহেনা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিউ ইয়র্কের এক হাজার ৮০০ স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলার অন্তর্ভুক্তি এক বিরাট অর্জন। এর ফলে প্রবাসী শিশুরা মাতৃভাষায় কথা বলা ও লেখার সক্ষমতা অর্জন করবে। এটি বাংলাদেশি কমিউনিটির দীর্ঘদিনের দাবি ছিল।’

পাবলিক স্কুলের অ্যাসিসট্যান্ট টিচার সাদিয়া খন্দকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা ঐতিহাসিক।’

এদিকে বাংলা ভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করছে নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে বড় বোরো কুইন্স। এ কারণে কুইন্স বোরো প্রেসিডেন্ট ম্যালিন্ডা কাটজ জ্যামাইকার ক্যাপটেন টিলি পার্কে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন।

নিউ ইয়র্কে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপনের জন্য জ্যামাইকা-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটি দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিল। সংগঠনটি পাঁচ বছর আগে কুইন্স বোরো প্রেসিডেন্টের কাছে এ দাবি জোরালোভাবে উত্থাপন করে। তখন মেলিন্ডা কাটস কুইন্সে একটি স্থায়ী শহীদ নির্মাণে বাংলাদেশিদের প্রতিশ্রুতি দেন।

ম্যালিন্ডা সেই সময় বলেছিলেন, তিনি বোরো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে শহীদ মিনার স্থাপনের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে কাজ করবেন। এর পর থেকে ধীর গতিতে হলেও শহীদ মিনার নির্মাণের প্রক্রিয়া এগোতে থাকে।

জ্যামাইকার হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউয়ে ১৬৫ ও ১৬৭ স্ট্রিটের মাঝখানে ক্যাপটেন টিলি পার্কে স্থায়ী শহীদ মিনারটি নির্মিত হবে।

এবিষয়ে জ্যামাইকা-বাংলাদেশে ফ্রেন্ডস সোসাইটির সাবেক সভাপতি ও কমিউনিটি বোর্ড মেম্বার ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এনিয়ে আমরা দাবি জানিয়ে আসছিলাম। স্থায়ী শহীদ মিনারটি হলে বাংলাদেশের ইতিহাস, বিশেষ করে ভাষার জন্য যে বাঙালি জীবন দিতে পারে, সেটি প্রবাসের নতুন প্রজন্মসহ অন্য কমিউনিটিকেও জানানো সম্ভব হবে। এতে করে প্রবাসে বাংলা ভাষার কদর বাড়বে বহু গুণ।’

 

/এইচআই/
সম্পর্কিত
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
কানাডায় দ্বিতীয়বার ‘ডিরেক্টরস ক্লাব অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন মাহবুব ওসমানী
বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে ম্যানিলায় শিশু-কিশোরদের মিলনমেলা 
সর্বশেষ খবর
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা