X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপ যায় কোথায়?

রাফসান জানি
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৩:৪০আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২০:১৮

আইন অমান্য করে বেচাকেনা হয় বিলুপ্তপ্রায় এসব কচ্ছপ বাংলাদেশে একসময় প্রচুর পরিমাণে কচ্ছপ পাওয়া গেলেও বর্তমানে প্রাণীটি প্রায় বিলুপ্ত। ২০১২ সালে আইন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও থেমে নেই কচ্ছপের অবৈধ শিকার, বিক্রি ও পাচার। ফলে একেবারে বিলুপ্ত হওয়ার হুমকিতে রয়েছে এই সরীসৃপ প্রাণীটি।
নিষেধাজ্ঞা থাকার পর অবৈধভাবে কচ্ছপ শিকারের কারণ সন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদার কারণে কচ্ছপ শিকার করা হচ্ছে। দেশেই কিছু মানুষ আছেন, যারা কচ্ছপের মাংস পছন্দ করেন। আন্তর্জাতিক বাজারেও কচ্ছপের মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এই মাংসের দাম অনেক বেশি হওয়ায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অবাধে শিকার করে যাচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপ।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে। ওজন অনুযায়ী এগুলোর দাম নির্ধারিত হয়। দেশের বাজারে তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি ওজনের একটি কচ্ছপের দাম চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম আরও বেশি।
বর্ষাকালে কচ্ছপ সাধারণত বড় বড় জলাশয়, বিল বা নদীতে অবস্থান করে। কিন্তু বর্ষা শেষে নদী বা বিলের পানি কমে গেলে এরা আশ্রয় নেয় ছোট ছোট জলাশয়ে। সেখান থেকেই শিকার করে রাজধানীর নির্ধারিত কিছু স্থান ও বিদেশি রেস্টুরেন্টগুলোতে বিক্রি করা হয় কচ্ছপ। আরেকটি চক্র আছে, যারা শিকারিদের কাছ থেকে কিনে আস্ত কচ্ছপ বা শুধু মাংস, যা আলাদা করে দেশের সীমান্ত ও বিমানবন্দর দিয়ে দেশের বাইরে পাচার করা হয়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কেবল বাংলাদেশ থেকে কচ্ছপ বিদেশে পাচার হয়—এমন না। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেও কচ্ছপ বাংলাদেশে আসে। বেশ কয়েক বছর ধরে কচ্ছপ পাচারে বাংলাদেশ ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে শিকার হওয়া কচ্ছপের পাশাপাশি ভারত থেকেও সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে কচ্ছপ আসে। এগুলো পরে চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ার মতো দেশে পাঠানো হয়। এসব দেশে খাবার হিসেবে কচ্ছপের মাংসের যেমন চাহিদা রয়েছে, তেমনি কচ্ছপের হাড়ের ব্যবহার রয়েছে ওষুধ বানানোর কাজেও।
দেশের বাজার ও সীমান্ত এলাকায় প্রায়ই উদ্ধার করা হচ্ছে কচ্ছপ। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শাঁখারিবাজর এলাকা থেকে বিলুপ্তপ্রায় একশ কচ্ছপ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় তিনজনকে নয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার হয় একশ কচ্ছপ র‌্যাব-১০-এর সিনিয়র পরিচালক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দেশে হিন্দুদের মধ্যে কচ্ছপের মাংস খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। সংখ্যায় কম হলেও ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীরাও কচ্ছপের মাংস খেয়ে থাকেন। আমরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শাঁখারিবাজার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করি। তখন একশ কচ্ছপ উদ্ধার করা হয়। এই অপরাধে তিনজনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।’
মহিউদ্দিন ফারুকী জানান, এই চক্রে আরও ১০-১৫ জন সদস্য রয়েছে, যারা নরসিংদী ও মুন্সীগঞ্জের চর এলাকা থেকে এসব কচ্ছপ শিকার করে রাজধানীতে বিক্রি করে। তাদের আইনের আওতায় আনতে নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে র‌্যাব। নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করেও যারা কচ্ছপ বিক্রি করে ও খায়— দুজনেই সমান অপরাধী বলে জানান ফারুকী।
শাঁখারিবাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন র‌্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এসব কচ্ছপ মাংস হিসেবে বিক্রি করা হয়ে থাকে। কিছু সনাতন ব্যক্তি এই মাংসটা খেতে পছন্দ করেন। আবার দেশের কিছু রেস্টুরেন্টেও কচ্ছপের মাংস বিক্রি করা হয়। বিশেষ করে গুলশান-বনানীর বিদেশি রেস্টুরেন্টগুলোতে এগুলোর বিক্রি বেশি। কচ্ছপ ও কচ্ছপের মাংসের বিদেশি ক্রেতাও আছে।’
কচ্ছপ বিক্রি ও পাচারে বেশ কয়েকটি চক্র জড়িত উল্লেখ করে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলম বলেন, ‘আমরা এর আগেও একাধিকবার অভিযান চালিয়েছি। বিদেশে পাচারের সময় আমরা বিমানবন্দর থেকে কচ্ছপ উদ্ধার করেছি। এয়ারপোর্ট ছাড়াও দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাচার হয় কচ্ছপ। ভারত-চীনসহ বেশ কিছু দেশে কচ্ছপ পাচার হয়। সঠিক সংখ্যা বলা না গেলেও এটা বলা যায়, বেশ কয়েকটি চক্র কচ্ছপ শিকার ও পাচারে জড়িত। আমরা অভিযান পরিচালনার সময় লক্ষ্ করেছি, আলাদা আলাদা চক্র এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।’
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক অসীম কুমার মল্লিক বলেন, ‘দুঃখের বিষয়, আমরা কাউকে এই অপরাধে সাজা দেওয়ার পর সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া পেয়ে আবার একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘শাঁখারিবাজারে দণ্ডপ্রাপ্ত পনির চন্দ্রকে আগেও একই অপরাধে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। চার মাস জেলে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবার সে একই অপরাধ শুরু করেছে।’
মূলত মাংস খাওয়ার জন্য কচ্ছপের বেচাকেনা ও পাচারের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুর রব মোল্লা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খাওয়ার জন্য কচ্ছপ শিকার, বেচাকেনা ও পাচার হয়ে থাকে। এগুলো বেশ ভালো দামে বিক্রি হয়। আগে আমাদের দেশ থেকে বিভিন্ন দেশে কচ্ছপ যেত। সেই অভ্যাসটাই এখনও রয়ে গেছে।’
বাংলাদেশে দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে কচ্ছপের সংখ্যা কমে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি প্রজাতির কচ্ছপই বিপন্ন। এর মধ্যে কয়েকটি প্রজাতি আরও বেশি বিপন্ন। দিন যত যাচ্ছে, কচ্ছপের সংখ্যা ততই আশঙ্কাজনক হারে কমছে।’
আইন করেও বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপ রক্ষা করা যাচ্ছে না বলে জানান অধ্যাপক ড. মো. আবদুর রব মোল্লা। তিনি বলেন, ‘কচ্ছপ রক্ষায় আমাদের দেশে আইন রয়েছে। বন বিভাগ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) এসব প্রাণীর অ্যাসেস করে থাকে। তারা বেসরকারিভাবেই এই অ্যাসেসমেন্টটা করে থাকে। এর ওপর ভিত্তি করে সরকার আইন প্রণয়ন করে। আমাদের দেশে এ সম্পর্কিত আইন অনুযায়ী কচ্ছপ শিকার, সংগ্রহ ও আমদানি-রফতানি নিষিদ্ধ।’
ড. রব আরও বলেন, ‘কচ্ছপের কিছু প্রজাতির আমদানি-রফতানি আন্তর্জাতিকভাবেও নিষিদ্ধ। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য কচ্ছপের মতো প্রাণী রক্ষা করতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। সবাইকে সচেতন না করতে পারলে বিলুপ্তপ্রায় এই সরীসৃপকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।’
আরও পড়ুন-
সব কর্মসূচি পালনে অনুমতি নিতে হবে কেন: ফখরুল
জলকামানে ছত্রভঙ্গ বিএনপির কালো পতাকা কর্মসূচি, আটক ৫৭

/টিআর/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
রামরুর কর্মশালায় বক্তারাঅভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা