X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

যে কারণে কর্মক্ষেত্রে প্রতি ৫ জনে একজন অস্থিরতায় ভোগেন

তাসকিনা ইয়াসমিন
২১ এপ্রিল ২০১৮, ১৮:৪৩আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০১৮, ১৮:৫৪




প্রতীকী ছবি
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথের (ডব্লিউএফএমএইচ) একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে প্রতি পাঁচজনে একজন কর্মী মানসিক সমস্যায় ভোগেন। তাদের মধ্যে গুরুতর মানসিক অসুস্থতার জন্য কাজ হারান ৮০ শতাংশ কর্মী। তাদের অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেন।

মনোরোগবিদরা বলছেন, কর্মীর মানসিক সমস্যা, বসের মানসিক সমস্যা, যোগ্যতা অনুযায়ী পদ না পাওয়া, চাহিদামতো বেতন-ভাতা না পাওয়া, নিরাপত্তাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ঠিকমতো না থাকা, সহকর্মীদের আচরণ কর্মীবান্ধব না হওয়ার কারণে কর্মক্ষেত্রে কর্মী অস্থিরতায় ভুগতে পারেন।

দেশে ২০১৭ সালে আইসিডিডিআরবি ৮০০ জন গার্মেন্টস কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা গেছে, ৪০ ভাগ গার্মেন্টস কর্মীর মধ্যে বিষন্নতার উপসর্গ রয়েছে।

২০১৭ সালে আইসিডিডিআরবির গবেষক ড. রুচিরা তাবাসসুম পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হন। তাদের মধ্যে ৪০ ভাগ নারী বিষন্নতায় ভুগেন। স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার এই নারীদের কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপ বৃদ্ধি করে। কর্মক্ষেত্রে অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতার জন্ম দেয় এবং সাধারণ স্বাস্থ্য, আত্মসম্মান ও জীবন নিয়ে সন্তুষ্টির অবনতি ঘটিয়ে বিষন্নতা তৈরি করে। এই গবেষণায় দেখা যায় কর্মক্ষেত্রে অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজের চাপ বাড়িয়ে এবং সাধারণ স্বাস্থ্য ও জীবন নিয়ে সন্তুষ্টির অবনতি ঘটায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোরশেদ বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক অস্থিরতার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। যে ব্যক্তি কাজ করবেন তার ওপরও নির্ভর করে। তিনি আগে কোন জায়গায় কাজ করেছেন; তার আগে থেকে কোনও মানসিক সমস্যা আছে কিনা? বেতন-পদবি নিয়ে তার অসন্তুষ্টি থাকতে পারে, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পাওয়া, আবার যে কাজ করবেন তা না বোঝাও অস্থিরতার কারণ হতে পারে। পদে অযোগ্য বস থাকলেও সমস্যা হতে পারে। নারীকর্মীদের জন্য নিরাপত্তাহীনতাও একটা কারণ হতে পারে। কাজের পরিবেশ, মেশিনারিজ, ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।’  
তিনি বলেন, ‘কর্মীর নিজের অবসাদগ্রস্ততা, উদ্বেগ, সন্দেহবাতিকতাও কর্মক্ষেত্রে অস্থিরতার কারণ হয়। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে রিফ্রেশরুম না থাকা, সময়মতো কাজ শেষ না হওয়া, যদি নারী অন্তঃসত্ত্বা বা স্তন্যদায়ী মা হন, তখন তার বাড়তি সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। সেটা অনেক সময় সহকর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। এসব কারণে তার কর্মক্ষেত্রে অস্থিরতা বিরাজ করতে পারে।’
বিএসএমএমইউর মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এম এ সালাউদ্দীন কাউসার বিপ্লব বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে সমস্যা আছেই কিন্তু ট্রিটমেন্টটা প্রোপারলি হচ্ছে না। অনেকেরই সমস্যা থাকে, তবে তারা স্বীকার করতে চায় না যে তারা অসুস্থ। অন্যরা টিজ করে, বিভিন্ন ধরনের ঝামেলা করে। মানসিক রোগ হলেই চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দেবে, বিষয়টি এমন নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানসিক রোগ বলতে মানুষ যেটি বোঝে অর্থাৎ, পাগল বলে; সেটা মাত্র ৬ ভাগ। বাকি মানসিক রোগগুলো আলোচনায় আসে না। যেমন মানুষ আমাদের পাগলের ডাক্তার বলে। পাগলের ডাক্তার বলতে এই পাগল মাত্র ৪-৬ পার্সেন্ট। কেউ যদি তেলাপোকা ভয় পায়, এটার জন্য যদি তার কাজের সমস্যা হয়, এটাও কিন্তু মানসিক রোগ। যৌন সমস্যা, ঘুমের সমস্যা–যত আছে, সবই মানসিক রোগ। এগুলো নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে অন্যদের ধারণা হয় যে, সে একেবারে পাগল হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, ব্যালান্স, রাস্তাঘাট, সোশ্যাল কন্ডিশন, বেতন, পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া-চলা, সোশ্যাল ব্যালান্স, মানুষের সঙ্গে মেইনটেইন করার কোনকিছুর সামঞ্জস্য নেই। চাকরির কোনও নিশ্চয়তা নেই। বেতন বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে কিনা, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এসব কিছু মিলিয়েই মানসিক অসুস্থতা তৈরি হয়।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে নানামুখী চাপ থাকে। যারা কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, তাদের একটা চাপ থাকে। কর্মক্ষেত্রে এক ধরনের একঘেয়ে একটা অবস্থা থাকে। কর্মক্ষেত্রে কলিগদের সঙ্গে টানাপোড়েন থাকে। অনেক টার্গেট থাকে। অনেক সময় হ্যারাজমেন্টের শিকার হতে হয়। শুধু যৌন নয়, বিভিন্ন ধরনের উত্ত্যক্তের শিকার হতে পারে। এটি নারীদের ক্ষেত্রেও হতে পারে। পুরুষের ক্ষেত্রেও হতে পারে। ভারবাল হ্যারেজমেন্ট হয়,অনেক সময় ফিজিক্যাল হ্যারেজমেন্টও হয়। সন্তোষজনক বেতন না পাওয়া, প্রশংসা না পাওয়ার কারণেও মানসিক চাপ হতে পারে। সেই হতাশা থেকে বিষন্নতাসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের কর্মক্ষেত্রগুলো আরও কর্মীবান্ধব হওয়া প্রয়োজন।’
কর্মক্ষেত্রে অস্থিরতা প্রতিরোধে করণীয় প্রসঙ্গে ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোরশেদ বলেন, ‘কেউ যদি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়, তাকে কাজে যাওয়ার আগে চিকিৎসা করিয়ে নিতে হবে। যদি কর্মী ডিপ্রেশনে ভুগে, অন্যদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারে, তাহলে তার উচিত হবে চিকিৎসা বা কাউন্সেলিং নেওয়া। বসদের উচিত হবে কর্মীদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ বণ্টন করা, টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করা। কর্মীদের প্রশংসা করা, ভুল কাজের সমালোচনা না করে তা শুধরে দেওয়া। অফিসের বসদের অবশ্যই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ফোকাস করতে হবে। যেন সব কর্মীর কাজ সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়। যার যে ক্ষেত্রে ট্রেনিং দরকার তাকে তা দিতে হবে। এমনকি বসদেরও ট্রেনিং নিতে হবে। প্রত্যেক কাজের টার্গেট নির্ধারণ করে তা শেষ করতে হবে। কর্মীর সেফটি, ফুড অ্যান্ড সেনিটারি ও সিকিউরিটি অফিসকে নিশ্চিত করতে হবে। ভালো কাজের জন্য সম্মাননা, সাতদিনের কাজের মূল্যায়ন করা, বিশেষ করে নারী কর্মীদের অসুস্থতার সময়ে রিলিফের জন্য আড্ডার ব্যবস্থা রাখা, ডে-কেয়ারের ব্যবস্থা রাখলে কাজে গতি আসবে। প্রত্যেক কর্মীকে ছয় মাস পর অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য ছুটিতে পাঠাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘কর্মীকে নিজের পরিবার, অফিস–দুটোতেই সমানতালে সময় দিতে হবে এবং নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে কাজ করে যেতে হবে। তা না হলে তার নিজের, পরিবারের ও অফিসের জন্য সে সহায়ক হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিজের ক্যারিয়ার ও পরিবারে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট ও সুস্থ থাকুন। পারি না, পারব না, আমাকে দিয়ে হবে না–এসব শব্দের কোনও মূল্য নেই।’
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রকে কর্মীবান্ধব হতে হবে। কর্মক্ষেত্রে লিডারকে অ্যাকটিভ থাকতে হবে। কর্মীকে উৎসাহ দিতে হবে। তাকে প্রশংসা করতে হবে। তাকে শুধু আর্থিক প্রণোদনা নয়, পুরস্কারও দিতে হবে। কোনও হ্যারেজমেন্ট থাকলে তা বন্ধ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে যদি কোনও পলিটিকস থাকে তা বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজর দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বলি যে, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের একটা দায়িত্ব থাকে যে, কর্মক্ষেত্রকে কর্মীবান্ধব করার। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হলে এটা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য যদি খারাপ থাকে তাহলে আলটিমেটলি বছর শেষে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। ফলে যারা কর্মক্ষেত্রের নীতিনির্ধারণী পদে আছেন, তাদের মাথায় রাখতে হবে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলে অফিসেরই প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে।’

 

 

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘আমার স্ত্রী শুধু অন্যের পরামর্শ শোনে’
‘আমার স্ত্রী শুধু অন্যের পরামর্শ শোনে’
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!