X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

দুই বছরেও ধরা পড়েনি জুলহাজ-তনয়ের খুনিরা

নুরুজ্জামান লাবু
২৫ এপ্রিল ২০১৮, ০৯:৫৭আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০১৮, ২২:১১

জুলহাজ ও তনয় সমকামীদের অধিকার বিষয়ক সাময়িকী ‘রূপবান’-এর সম্পাদক জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয় হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পেরিয়ে গেলেও মূল খুনিরা এখন পর্যন্ত ধরা পড়েনি। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এরই মধ্যে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছেন, যাদের মধ্যে তিনজন হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আরও অন্তত তিন থেকে চারজনের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত ও ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের ধরতে অভিযান চলছে।

এদিকে, দুই বছরেও মূল খুনিদের গ্রেফতার করতে না পারায় ক্ষোভ জানিয়েছেন জুলহাসের পরিবারের সদস্যরা। তারা ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন।

২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগান লেক সার্কাস এলাকার বাসায় ঢুকে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস ও সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের কর্মী জুলহাজ ও তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। অনুসন্ধানে পুলিশ কর্মকর্তারা জানতে পারেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের একটি ‘স্লিপার সেল’ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত, যারা ২০১৩ সাল থেকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ব্লগার, লেখক, প্রকাশক ও ভিন্নমতাবলম্বীদের টার্গেট করে হত্যা করে আসছিল। আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদার অনুসারী আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশে আগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে তাদের কার্যক্রম চালাতো। জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডের পর আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের শাখা আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট (একিউআইএস) টুইটার বার্তায় এর দায় স্বীকার করে।

জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানায়।

আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর কলাবাগান থানায় হত্যা ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা দায়ের হয়। মামলা দুটি প্রথমে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করলেও সম্প্রতি এটি পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) তদন্ত করছে।

সিটিটিসির উপ-কমিশনার (ডিসি) মহিবুল ইসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডে আমরা এরই মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছি, যারা হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন পর্যায়ে অংশ নিয়েছিল। এদের মধ্যে তিনজন দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। আরও তিন-চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত হয়েছি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও আনসার আল ইসলামের সদস্যরা জড়িত। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারাও জিজ্ঞাসাবাদে বিষয়টি জানিয়েছে।’

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০১৬ সালের ১৫ মে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে শরীফুল ইসলাম ওরফে কেরামত ওরফে শিহাব নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে সে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল বলে পুলিশের দাবি। এছাড়া ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর সায়েদাবাদ থেকে ব্লগার নাজিম উদ্দিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় রশিদুন্নবী ভূঁইয়া ওরফে রাসেল ওরফে রফিক ওরফে রায়হান নামে এক যুবককে। পরে তাকে জুলহাজ-তনয় হত্যা মামলায়ও গ্রেফতার দেখানো হয়। গত বছরের ১৮ নভেম্বর তুরাগের বাউনিয়া বাঁধ এলাকা থেকে মোজাম্মেল হোসেন সায়মন ওরফে শাহরিয়ার ও ২৫ নভেম্বর সাভারের আমিনবাজার এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আরাফাত রহমান নামে দুই যুবককে। এ দুইজন জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ড ছাড়াও ব্লগার অভিজিৎ রায় ও নিলয় এবং প্রকাশক দীপন হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে জানায় পুলিশ।

সায়মন ও আরাফাতকে প্রথমে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার করা হলেও পরে তাদের দুজনকেই জুলহাজ-তনয় হত্যায় গ্রেফতার দেখানো হয়। আর সবশেষ গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ডেমরা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা ইয়ামিন মিয়া ওরফে জাভেদ নামে আনসার আল ইসলামের এক সদস্যকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, শরীফুল ওরফে শিহাব ও ইয়ামিন ছাড়া বাকি তিনজন জুলহাজ-তনয় হত্যকাণ্ডে বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেফতার হওয়া পাঁচজনের বাইরে এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া অন্তত চারজনের নাম-পরিচয় ও ছবি শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনার পর থেকে তারা পলাতক রয়েছে। এছাড়া জুলহাজ-তনয়সহ অন্যান্য ব্লগার-লেখক-প্রকাশক হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য মদতদাতা ও মাস্টারমাইন্ড হলো সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক। তাকেও হন্যে হয়ে খোঁজা হচ্ছে। তাকে ধরতে পারলে তদন্তে অনেক অগ্রগতি হবে বলে মন করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, আনসার আল ইসলাম তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম এমনভাবে চালায়, যাতে একজন সদস্য আরেকজন সদস্য সম্পর্কে কোনও তথ্য দিতে পারে না। এই পদ্ধতিকে জঙ্গিবাদের ভাষায় ‘স্লিপার সেল’ বলা হয়। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া আনসার আল ইসলামের সদস্যদের ‘আশকারি’ বিভাগের সদস্য বলে অভিহিত করা হয়। এর একজন সদস্য অপর সদস্যের সাংগঠনিক নাম ছাড়া অন্য কিছু সম্পর্কে কোনও তথ্য জানাতে পারে না।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য ব্লগার, লেখক বা প্রকাশক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাতেও একেকটি স্লিপার সেল অংশ নিয়েছে। সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ এসব স্লিপার সেল সম্পর্কে জানে। কিন্তু সাধারণ সদস্যরা কেউ একে অপরের বিস্তারিত পরিচয় জানতে পারে না। এজন্য আনসার আল ইসলামের কোনও সদস্যকে গ্রেফতার করা হলে বিস্তারিত তথ্য উদ্ধার করা কঠিন হয়ে যায়।’

দীর্ঘদিন আনসার আল ইসলামের কার্যক্রম নিয়ে কাজ করে আসা এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি এই সংগঠনটির শীর্ষনেতা বহিষ্কৃত মেজর জিয়াকে গ্রেফতার করার। তাকে গ্রেফতার করতে পারলে স্লিপার সেলগুলো সম্পর্কে জানা যাবে এবং তাদের পরিচয় শনাক্ত করা যাবে।’

হতাশ পরিবারের সদস্যরা

জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া খুনিদের দুই বছরেও ধরতে না পারায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবারের সদস্যরা। জুলহাজ মান্নানের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কী বলবো? পুলিশ তো আমাদের কোনও আপডেটই জানায় না। আমরা পত্রিকা পড়ে আপডেট জানতে পারি। আমার মনে হয় না এই হত্যাকাণ্ডের আমরা কোনও সুবিচার পাবো। কারণ, তদন্তের দৃশ্যমান কোনও ফলাফল তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’

মিনহাজ মান্নান বলেন, ‘জুলহাজ এমন একটি কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল, যেটি আমাদের দেশে অনেকেই পছন্দ না করলেও বহির্বিশ্ব তার কাজকে অনেক মূল্যায়ন করতো। তাই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করা, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। খুনিদের ধরে শাস্তি দিতে পারলে আমরা শান্তি পেতাম। এটাই আমাদের চাওয়া।’

/এইচআই/আপ-এসটি/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি