X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

জবির শিক্ষক নাসিরের চাকরিচ্যুতি নিয়ে এত বিতর্ক কেন?

রশিদ আল রুহানী
৩০ এপ্রিল ২০১৮, ০১:১৫আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০১৮, ১০:৫০

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আর্টিকেলে চৌর্যবৃত্তির অপরাধে গত বৃহস্পতিবার (২৬ এপ্রিল) বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৭তম সিন্ডিকেট সভায় চাকরিচ্যুত করা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাসির উদ্দিনকে। তার চাকরিচ্যুতির পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে চলছে নানা গুঞ্জন, বিতর্ক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে, ফলে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। অথচ শিক্ষক নাসিরের দাবি, তার বিরুদ্ধে অভিযোগটি সত্য নয়। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উদ্ধার আন্দোলনসহ নানা সময়ে ন্যায্য দাবিতে শিক্ষক নাসির সবসময় শিক্ষার্থীদের সমর্থন দিতেন। এ কারণেই সুযোগ বুঝে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

নাসির উদ্দিনকে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিতে ইতোমধ্যে সরব হয়ে উঠেছেন জবির শিক্ষার্থীরা। রবিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে তারা সোমবার থেকে ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণাও দিয়েছেন। ফেসবুকেও গ্রুপ খুলে নাসির উদ্দিনের পক্ষে অবস্থান জোরদার করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, নাসির উদ্দিন শিক্ষার্থীদের উসকে দিচ্ছেন।

নাসির উদ্দিন এবং বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য আবেদন করেন নাসির উদ্দিন। সেই আবেদনের সঙ্গে ‘The teachers Task in Fostering Autonomous Learning: A Study on Undergraduate EFL Class in Bangladeshএবং Motherhood in the poems of Silviya Plath আর্টিকেল দুটি জমা দেন। পরে নিয়োগ বোর্ড এই দুটি আর্টিকেলের বেশিরভাগ অংশ অন্য আর্টিকেল থেকে কপি করা হয়েছে বলে উপাচার্য বরাবর অভিযোগ করে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জবির সিন্ডিকেট সদস্য এবং বর্তমানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওই কমিটি টার্নিটিন সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে দেখতে পায়, নাসিরের একটি আর্টিকেলে ৮১ শতাংশ এবং অন্যটিতে ৫২ শতাংশ কপি করা হয়েছে। পরে আরও একটি কমিটি গঠন করার পর ওই কমিটি আরেকটি প্রতিবেদন জমা দিলে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট নাসির উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করে।

কিন্তু নাসির উদ্দিনের দাবি, ‘The teachers Task in Fostering Autonomous Learning: A Study on Undergraduate EFL Class in Bangladeshআর্টিকেলটি তিনি নিজে লেখেননি। এই লেখাটি লিখেছিলেন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আকরামুজ্জামান। এ বিষয়ে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে, ‘আকরামুজ্জামানের সঙ্গে  কো-অরডিনেট করে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল। আর্টিকেলটি আকরামই রেডি করেছিলেন। আমি শুধুমাত্র সেটার ভাষাটা দেখে দিয়েছিলাম। পরে সেই লেখাটিতে আকরামই আমার নাম বসিয়ে প্রকাশের জন্য ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়। এরই মধ্যে আমি আমার পদোন্নতির জন্য এই আর্টিকেলটির প্রকাশিতব্য চিঠি জমা দেই। কিন্তু যখনই জানতে পারি লেখাটিতে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ রয়েছে, তখনই আমি আর্টিকেলটি ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্যাহার করে নেই। ফলে এটা পরে প্রকাশিত হয়নি। যেটা প্রকাশিতই হয়নি সেটা দিয়ে কাউকে চাকরিচ্যুত করা যায় বলে আমি মনে করি না। এছাড়া সিলভিয়া প্লাথের অবদান নিয়ে অন্য একটি আর্টিকেল নিয়েও অভিযোগ ছিল। যেহেতু কবির অবদান নিয়ে লেখা আর্টিকেল সেখানে কবির কবিতার উদ্ধৃতি তো উদাহরণ হিসেবে দিতেই পারি। আর সফটওয়্যার তো সেখানেই কপি আছে বলে ধরেছে। তাহলে কেন এটার জন্য আমার চাকরি যাবে?’

তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পূর্বের কোনও জেরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আকরামের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র করে আমাকে ফাঁসিয়েছে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের একখণ্ড জায়গা স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতাকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন উপাচার্য। কিন্তু আমি এর প্রতিবাদ করি। এরপর উপাচার্য আমার ওপর ক্ষেপে যান। এছাড়া আমি ছাত্রকল্যাণ পদে থাকাকালীন শিক্ষার্থীদের সব ন্যায্য দাবিতে তাদের পাশে ছিলাম। হল আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধও হই। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার ওপর নাখোশ।‘

তিনি আরও বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এবং কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে তার ব্যাখায় আমি আমার সমস্ত কাগজপত্র জমা দিয়েছি। আর্টিকেলটি প্রকাশিত হওয়ার আগে সেটি প্রত্যাহার করা হয়েছে সেটার চিঠি জমা দিয়েছি। ওই আর্টিকেলটি যে আমি লিখিনি তার প্রমাণ হিসেবে আকরামুজ্জামানের সঙ্গে আমার কথপকথনের ভয়েস রেকর্ডও কমিটিতে জমা দিয়েছি। সঙ্গে আমি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটির বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে জানতে চেয়েছি আমার আর্টিকেলটির কোথায় কোন অংশে কপি পেস্ট হয়েছে এবং কোন সফটওয়্যার দিয়ে তা চেক করা হয়েছে। যেহেতু আমি অভিযুক্ত, আমার সেগুলো পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু আমাকে সেগুলো দেওয়া হয়নি। এছাড়া, তদন্ত কমিটি আমার দেওয়া চিঠিগুলো ঠিকমতো পড়েই দেখেনি। কারণ, আমাকে যখন শুনানির জন্য একদিন ডাকা হয়েছিল সেখানে আমাকে বলা হয়েছিল, ‘ওগুলো পড়ার কী আছে, সব তো জানাই আছে।’

এদিকে জবির ইংরেজি বিভাগের সহকারী শিক্ষক আকরামুজ্জামানকে ফোন করে আর্টিকেলটি কে লিখেছিলেন জানতে চাইলে তিনি আর্টিকেলটি লেখার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘যে আর্টিকেলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ সেটি আমি লিখিনি। আমি লিখেছি অন্য একটি আর্টিকেল। এই লেখার বিষয়ে আমার কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই।’

বাংলা ট্রিবিউনের কাছে আপনাদের দুজনের কথোপকথনের অডিও রয়েছে জানালে তিনি বলেন, ‘আমি কখনও স্যারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলিনি। এছাড়া ওই অডিওতে কে কথা বলেছে সেটাও জানি না। আমি নই, এটাই আমি জানি।’

নাসির উদ্দিন বলেন, ‘উপাচার্য আকরামুজ্জামানকে এ বিষয়ে নিষেধ করেছেন। এ কারণেই তিনি তা স্বীকার করছেন না। তারাই তো ষড়যন্ত্রটা করেছেন। তাছাড়া অডিওতে আকরামের কথা বলার স্টাইলই বলে দেয়, সে জেনে বুঝেই কাজটি করেছে।’

এদিকে জবির ২০০৫ সালের উপধারা ৪৪(৬) এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার ৪(৩)(গ) বিধি মোতাবেক যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার সমালোচনা করেন এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘জবির জন্য এখন পর্যন্ত ভেলিড কোনও প্রবিধান প্রণীত হয়নি। উপাচার্যের করা একটি নিজস্ব আইন তৈরি হয়েছে। যেখানে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া আমি যেহেতু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, সেখানে আমাকে কেন সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে? আমার বিরুদ্ধে অন্যায় ও ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমি সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আইনের আশ্রয় নেব।’

রবিবার (২৯ এপ্রিল) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে নাসির উদ্দিনের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে মানববন্ধন করেন জবির শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, যে অভিযোগের ভিত্তিতে অধ্যাপক নাসির উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রমূলক ও অবৈধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকও নাসির উদ্দিনের এই অপসারণকে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হতে পারে নাসির উদ্দিন স্যারের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু অপসারিত হওয়ার পরে ছাত্রদের অধিকার আদায়ে সরব ছিলেন এই ইস্যুকে সামনে এনে ছাত্রদের কাজে লাগাতে চাইছেন নাসির উদ্দিন।’

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নাসির উদ্দিন তার পদোন্নতির আবেদনের সঙ্গে ইবাইস ইউনিভার্সিটিতে আর্টিকেলটি জমা দিয়েছেন বলে এক্সেপটেন্স লেটার জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পরে যে প্রত্যাহারের চিঠি দিয়েছেন সেটি ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের। এছাড়া তিনি যে বলছেন, সরকারি কর্মচারী বিধিতে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না, এটাও সঠিক নয়। কারণ, যেহেতু জবির এখনও নিজস্ব প্রবিধান হয়নি সেহেতু একটা না একটা আইনে তো চলতে হবে। এ কারণেই সিন্ডিকেট তিন বছর আগে সরকারি কর্মচারী বিধি মেনে চলবে বলেই অনুমোদন হয়। এ যাবত ওই আইনেই চলছে। আরও তিন বছর লাগবে নিজস্ব প্রবিধান হতে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা কোনোভাবেই বিতর্কিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ সব কিছু সঠিকভাবেই হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে অনেক পছন্দ করি, ছাত্ররাও তাকে পছন্দ করেন। তিনি যদি ক্ষমা চেয়ে আচার্যের কাছ থেকে চিঠি আনতে পারেন, তাহলেই হয়ত সুবিধা পাবেন। অন্য কোনও পথ তো খোলা দেখি না তার জন্য। আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে কিন্তু তাতেও লাভ হবে না বলেই মনে হয়।’

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী