X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মরণনেশা থেকে জীবনে ফেরা

উদিসা ইসলাম
২৩ মে ২০১৮, ২৩:৫৬আপডেট : ২৪ মে ২০১৮, ১০:৩৮

ড্রাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, এক সময়ের তুখোড় ছাত্র বেলাল (৩৫)। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জড়িয়ে পড়েন শহুরে মেধাবী বন্ধুদের মরণ আড্ডা ইয়াবার পাল্লায়। প্রথমে গ্রুপ স্টাডির নামে সবাই একত্রিত হয়ে নেশা করতেন। তারপর নেশায় ডুবে গিয়ে বন্ধুদের অপেক্ষা বাদ দিয়ে নিজেই হয়ে ওঠেন একক ভোক্তা। একসময় নেশার অর্থ নিশ্চিত করতে কৌশলে যুক্ত করে নেয় একই শহরে বসবাসরত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া খালাতো বোন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ভগ্নিপতিকে।

প্রথম ছয়মাস তাদের তিনজনের এই নেশার রাজ্য বেশ আয়েশে চললেও এরপরই ঘটে ছন্দপতন। শুরুতে সেমিস্টার লস, এরপর নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে গিয়ে বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, দেড়বছরের মাথায় বিভাগ থেকে বিদায়। আর খালাতো বোন নেশার জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে তার স্বামীকে জোর করতে থাকলে জীবনের এই দুর্দশার জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকেন এবং মাত্র দুবছরের মাথায় ঘটে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ। পরবর্তীতে বেলাল না পারলেও তার খালাতো বোন রোকসানা বের হয়ে এসেছেন মাদকের কড়াল ছোবল থেকে। আত্মবিশ্বাস ও নিজ চেষ্টায় তিনমাসে তিনি সুস্থ জীবনে ফিরে আসেন। এখন তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করছেন।

নাসরিন (ছদ্মনাম) নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার শেষ দিকে এসে বিয়ে হয় রায়হান (ছদ্মনাম) নামে এক বড় ব্যবসায়ীর ছেলের সঙ্গে। স্বামীর হাত ধরে প্রথমে মাদক নেওয়া নাসরিনের জীবনে মদ, ফেনসিডিল থেকে শুরু করে সীসার নেশা হয়ে ওঠে অনুষঙ্গ। পড়া শেষ করে নাসরিন একটি নাম করা প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে ঢোকেন। সবই ঠিকঠাক চলছিল। নাসরিনের ভাষ্য মতে— মূলত ওই জীবন তারা এনজয় করছিলেন। কিন্তু বছর না ঘুরতেই রায়হানের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে।

নাসরিন শুরুতে নিজের অফিসে বেশ গুরুত্ব পেলেও পরে সহকর্মীরা তার বিষয়ে মাদকাসক্তের অভিযোগ আনেন। অফিস থেকে শুরু হয় নানারকম অসহযোগিতা। একপর্যায়ে মাদক কিনতে টাকা চুরির অভিযোগ ওঠায় চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয় তিনি। ততদিনে রায়হান নতুন সম্পর্কে জড়ালে অসহায় নাসরিন ফিরে আসেন বাবা মায়ের কাছে। নানা ধরনের মাদক সেবনের কারণে রোগব্যাধির মধ্যেই নাসরিন নতুন করে জীবন ‍শুরুর চেষ্টা করেন। তবে সামাজিক বাঁকা দৃষ্টি তাকে এখনও ভোগায়।

নাসরিন, রোকসানা বা বেলাল সবার বক্তব্য হলো— মাদক জগতে ঢোকার শুরুর সময় জীবন উপভোগের ছিল। তারপর বিরক্ত লাগতো। কিন্তু অভ্যাসের মধ্যে, শরীরের মধ্যে এবং আশেপাশের সার্কেলও এসবে জড়িত থাকায় বের হওয়ার পথ ছিল না। রোজ খাওয়া শেষে ভাবতাম ‘আর না, আজই শেষ।’ কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি আবারও পরের দিন ওইপথেই নিয়ে গেছে।

মনোরোগ বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মিথ্যা কথা বলা, নানা গল্প সাজিয়ে নিজেকে স্মার্টলি উপস্থাপন করা, আর্থিক অসচ্ছলতা, জীবনসঙ্গীর সঙ্গে প্রতারণা থেকে শুরু করে নেতিবাচক যেসব প্রবণতা মাদকাসক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেগুলো সে নিজে টের পায় না। কিন্তু তার সামনে যেসব সুস্থ মানুষ থাকে, তারা কিন্তু অস্বস্তিগুলো টের পায়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে ৭৩ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে। যদি বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের হিসাব করা হয়, তাহলে প্রতিটি গ্রামে গড়ে ১০৭ জন করে মাদকাসক্ত রয়েছে। মাদকের জগত থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো উল্লেখ করতে গিয়ে তিনবছর টানা একাধিক মাদকে ডুবে থাকা রোকসানা বলেন— ‘আমি যখন এটা ওটা খেতাম, লোকজন সেটা বিশ্বাস করতো। কিন্তু আমি যে নিজ চেষ্টায় বেরিয়ে এলাম, এখন যে আমি সুস্থ জীবনে অভ্যস্ত হতে চাইছি, তখন কিন্তু কেউ আমাকে সহযোগিতা করছে না। তারা বিশ্বাসই করলো না, আমি এসব নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমার ঘর-সংসার সবই হারাতে হয়েছে যে নেশার জন্য, সেটা থেকে আমি বের হয়ে যখন নিজেকে যোগ্য জায়গায় দাঁড় করালাম, তখন এই সমাজের উচিত ছিল আমাকে সামাজিক পরিসরে আরেকটু জায়গা করে দেওয়া।’

পুনঃআসক্তির পেছনে সমাজের এই নেতিবাচক আচরণ দায়ী উল্লেখ করে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ডা. তাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘সমাজকে ভুলে গেলে চলবে না, মাদকসেবীরা অপরাধী না। না বুঝে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাজ তাকে ‘নেশাখোর’, ‘মাদকাসক্ত’ ধরনের শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করে শৃঙ্খলিত করে ফেলে বিধায়, সে নিজেকে বৃহত্তর সমাজের অংশ মনে করে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিজের মূল সমাজের বাইরে উপ-সংস্কৃতি তৈরি করে। সেখান থেকে তাকে বের করে আনার ক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজ ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। যে একবার মাদক খেয়েছে, সে আবারও সেই জগতে ফিরে যেতে পারে, এটা মাথায় রাখতে হবে। কিন্তু সেটা নিয়ে তাকে উত্ত্যক্ত করা যাবে না।’

 

/ইউআই/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি