X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

চীনের গুয়াংজু থেকে আসছে নকল ওষুধ

আমানুর রহামান রনি
২৮ মে ২০১৮, ১৪:৩২আপডেট : ২৮ মে ২০১৮, ২১:৩০



চীন থেকে  আনা নকল ওষুধ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দামি ওষুধের নমুনা দেখিয়ে তা তৈরির জন্য চীনের গুয়াংজু প্রদেশের কারখানাগুলোতে অর্ডার দেওয়া হয়। সেই নকল ওষুধ মোবাইল ফোন ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ আমদানির নামে বাংলাদেশে আনা হয়। এরপর দেশেই প্যাকেটজাত করে তা বাজারজাত করা হয়।

নকল ও ভেজাল ওষুধ বাজারজাত করে আদালতে এমন একটি চক্রের দেওয়া  স্বীকারোক্তিতে এ তথ্য জানা গেছে। এসব নকল ও অনুমোদনহীন ওষুধ অহরহ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। নকল ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীরা কৌশলের আশ্রয় নেয়। ফার্মেসিতে তারা এসব ওষুধ রাখে না,  নমুনা দেখালে তারা সেই ওষুধ ক্রেতার সামনে হাজির করে।

বাজারে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ওষুধ দেশের মধ্যে রাজধানীর মিডফোর্ট হচ্ছে ওষুধের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার। মিশর ও ভারতে তৈরি বলে পরিচিত কিছু ওষুধের প্যাকেটের ছবি (নমুনা) নিয়ে গত মঙ্গলবার (২২ মে) দুপুরে ক্রেতা সেজে মিডফোর্টের বিভিন্ন ওষুধের দোকানে ওষুধ কিনতে যান এই প্রতিবেদক। এসব ওষুধ  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন সময় আটক করেছিল। এরমধ্যে মিশরের একটি কোম্পানির ওষুধের নাম ‘ভ্যাস্টারেল এমআর’, এটি হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দেওয়া হয়। মিডফোর্টের ‘খলিল মেডিক্যাল হল’ নামে একটি ফার্মেসিতে প্যাকেটের ছবি দেখিয়ে ওষুধ চাইলে বিক্রয়কর্মী অপেক্ষা বলেন। ৬/৭ মিনিট পর তিনি ট্যাবলেটের একটি পাতা নিয়ে আসেন। এক পাতায় ট্যাবলেট রয়েছে ১০টি। বিক্রয়কর্মী দাম চাইলেন ১২০০ টাকা। তবে দরদামে তার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায়, পাশের আরেকটি দোকানে একই ওষুধ চাইলে তারাও এটি দিতে পারবেন বলে জানান। তবে  একপাতা ওষুধের দাম চাওয়া হলো একদাম একহাজার টাকা। তারা নিশ্চিত করে বললেন— এটা মিশরের ওষুধ, তাই দাম বেশি। একই গ্রুপের ওষুধ বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানিও তৈরি করে। বিক্রয়কর্মীরা জানান, এসকেএফ কোম্পানির ভ্যাস্টারেল ট্যাবলেট একপাতার দাম ২৭০ টাকা। এসকেএফের ভ্যাস্টারেল একপাতায় ৩০টি ট্যাবলেট থাকে।

এই ওষুধের দরদাম করার সময় সেখানে এক তরুণ এসে হাজির হন। সেই তরুণ দাম কমিয়ে দিতে রাজি হলেন। তবে তার শর্ত বেশি নিতে হবে। এসময় আরও  কিছু বিদেশি ওষুধের প্যাকেট দেখালে সেগুলোও দিতে পারবেন বলে আশ্বস্ত করেন ওই তরুণ। তিনি মিডফোর্টের একটি ভবনের সামনে অপেক্ষা করতে বলেন।

ওই তরুণের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের কাছে আরও  বিদেশি ওষুধ মজুত আছে। তারা প্রয়োজন অনুযায়ী দিতে পারবেন। তবে এই তরুণ তার নাম ও পরিচয় প্রকাশ করতে অনীহা দেখান। এসব ওষুধ ফার্মেসিতে না রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে ওই তিনি বলেন,আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মিডফোর্টে প্রায়ই অভিযান চালায়, তাই ওষুধগুলো বাইরে রাখা হয়। ফার্মেসির বিক্রয়কর্মীরা চাইলে তাদের পৌঁছে দেওয়া হয়।

নকল ওষুধ ব্যবসার হোতা পবিত্র কুমার ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এসব ওষুধ দেখালে তারা জানান, এগুলো  নকল, দেশের বাজারে বিক্রির অনুমোদন নেই। ওষুধ প্রশাসনের পরিচালক রুহুল আমিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিশরের ভ্যাস্টারেল ট্যাবলেট বাংলাদেশে বিক্রির অনুমোদন নেই। এসব ওষুধ নকল। কখনও কখনও অসাধু ব্যক্তিরা নিজেরাই তৈরি ও বাজারজাত করে।’

তিনি বলেন, ‘মিশর, পাকিস্তান, চীন ও ভারতসহ আরও  কিছু দেশ রয়েছে— যেসব দেশ থেকে আমরা কখনও ওষুধ আমদানি করি না। তবে ইউরোপের কিছু দেশ এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কিছু ওষুধ আনা হয়। সেগুলোর গায়ে মান, মেয়াদ, দাম ও আমদানির তথ্য থাকে।’

রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা বিদেশ থেকে খুবই কম ওষুধ আমদানি করি। আমরা যে পরিমাণ ওষুধ উৎপাদন করি, তার দুই শতাংশেরও কম আমদানি করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘অনুমোদনহীন ওষুধের ওপরে আস্থা রাখা যাবে না। এসব ওষুধের মান ঠিক নেই। মান নিয়ন্ত্রণও করা হয় না। এগুলো রোগীদের সেবন করা ঝুঁকিপূর্ণ।’   

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর তাঁতীবাজার এলাকা থেকে নকল ওষুধ বাজারজাত করার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন— রুহুল আমিন ওরফে দুলাল চৌধুরী (৪৬), নিখিল রাজ বংশী (৪৪) ও মো. সাঈদ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জাহাঙ্গীর ও তারেক আব্দাল্লাহ নামে আরও দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির উপপরিদর্শক (এসআই) একেএম মঈন উদ্দীন। তিনি জানান, গ্রেফতার চারজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্ধি দিয়েছে। স্বীকারোক্তিতে তারা আদালতকে জানিয়েছেন, চীনের গুয়াংজু প্রদেশ থেকে ওষুধগুলো তারা নিয়ে আসেন। দুলাল এই গ্রুপটিকে পরিচালনা করেন। আবু সাঈদ, জাহাঙ্গীর ও নিখিল দালাল হিসেবে কাজ করেন। তারা বিভিন্ন ফার্মেসিতে ওষুধ সরবরাহ এবং নতুন ক্রেতা ঠিক করেন।

নিখিল রাজ বংশী স্বর্ণের কারিগর হিসেবে কাজ করলেও তার কাছে মূলত ওষুধ জমা রাখতেন দুলাল। পুরান ঢাকার আলী নবাব ভবনের মার্কেটের ৮১ নম্বর রাধিকা মোহন বসাক লেনে থাকতো এই নকল ওষুধ। নিখিল তার জবানবন্দিতে বলেছেন, দুলাল তার কাছে ওষুধের কার্টন মজুত রাখতো। এজন্য তাকে ৩/৪ থেকে হাজার টাকা দেওয়া হতো।

তারেক আব্দুল্লাহ আদালতের কাছে বলেন, ‘সাঈদ, জুয়েল, লিটন ও শারমিন প্রায়ই আমদানি নিষিদ্ধ বিদেশি ওষুধ এনে দিতো। এসব ওষুধ বিভিন্ন লোক কিনে বাজারজাত করতো।’

তিনি তার স্বীকারোক্তিতে বলেন, ‘চীন থেকে বিভিন্ন ওষুধ তৈরি করে এনে তা বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করা হতো। দেশেই এর প্যাকেট প্রস্তুত করা হতো।’

নকল ওষুধ বাজারজাত করার জন্য এই গ্রুপটিকে দুলাল চৌধুরী পরিচালনা করলেও এর মূলে রয়েছেন পবিত্র কুমার দাস নামে একজন ওষুধ ব্যবসায়ী। গ্রুপটি সিআইডির হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর পবিত্র পালিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি দেশে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানিয়েছে সিআইডি। এছাড়া, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও  নাম উঠে এসেছে পবিত্র কুমার দাসের। শ্যামবাজার এলাকায় ওষুধের ব্যবসার আড়ালে পবিত্র এসব ভেজাল ও নকল বিদেশি ওষুধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

এসব নকল ওষুধ সেবনে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক দাম দিয়ে বিদেশি ওষুধ মনে করে যা সেবন করা হচ্ছে, তা যদি আসল  ওষুধ না হয়,তবে রোগীদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির বলে মনে করেন শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মো. আবদুল আজিজ। নকল ও ভেজাল ওষুধে কিডনি রোগেরও ঝুঁকি রয়েছে বলে জানান তিনি।

আটক ব্যক্তিরা সবাই নকল ওষুধের ব্যবসায়ী ভেজাল ওষুধ সেবন করে মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে এসেছেন বলে মন্তব্য করেছেন গোপালগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা খান আকরাম। তিনি বলেন, ‘আমি পুরনো ঢাকা থেকে ওষুধ নিতাম। কিন্তু সেই ওষুধে আমার রোগ ভালো না হয়ে উল্টো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। পরে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওই ওষুধ বাদ দেই।’

নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রেতাদের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম টিম সবসময় তৎপরতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নকল ওষুধের বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা মামলাটি এখনও তদন্ত করছি। তদন্তে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদেরই আইনের আওতায় আনা হবে। নকল ওষুধের সরবরাহকারী মূল হোতা পবিত্রকে আমরা অল্পের জন্য গ্রেফতার করতে পারিনি। সে পালিয়েছে। বর্তমানে তার কর্মীরাও গা ঢাকা দিয়েছে। আমরা তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।’

 

/ এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
সর্বাধিক পঠিত
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা