X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন জাহিদের মৃত্যু: যে দুই কারণে পরিবারের সন্দেহ হত্যা

রাফসান জানি
১৫ জুন ২০১৮, ২০:১৫আপডেট : ১৫ জুন ২০১৮, ২০:২০

সুমন জাহিদ (ছবি: সংগৃহীত) হত্যার হুমকি ও ঘটনার ধরন দেখে শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদের মৃত্যুর ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে এখনও অভিযোগ স্বজনদের। ইতোমধ্যে পরিবারের অভিযোগ আমলে নিয়ে পুলিশও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের কাজ শুরু করেছে। পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত ও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন আইজিপি মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী।
বৃহস্পতিবার (১৪ জুন) সকালে খিলগাঁওয়ের বাগিচা এলাকায় রেললাইনের পাশ থেকে সুমন জাহিদের (৫২) দ্বিখণ্ডিত লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে থানা পুলিশ। একই থানায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছে।
সুমন জাহিদের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড অভিযোগ তোলার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় উল্লেখ করেছে তার পরিবার। প্রথমত, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে তাকে এর আগেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে পুলিশও অবগত আছে। স্বজনদের দাবি, হুমকিদাতারাই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
দ্বিতীয়ত, ট্রেনে কাটা পড়ে কারও মৃত্যু হলে লাশের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর আঘাত থাকার কথা। কিন্তু সুমন জাহিদের মরদেহে তেমন কোনও গুরুতর আঘাত নেই। তাই পরিবারের অভিযোগ, অন্য কোথাও তাকে হত্যা করে রেললাইনের পাশে ফেলে রাখা হয়।

সুমন জাহিদের পরিবারের পক্ষ থেকে তার ভায়েরা (স্ত্রীর বোনের স্বামী) এটিএম এমদাদুল হক বুলবুল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশ এই মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলছে। কিন্তু আমরা মনে করছি, তাকে খুন করে রেললাইনে ফেলে গেছে হত্যাকারীরা। যাতে এটাকে সবাই দুর্ঘটনা ভাবে। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই।’

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৯৪ সালের গণআদালতের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা সুমন জাহিদ। এছাড়া বর্তমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। যুক্তরাজ্যে পলাতক চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক আশরাফুজ্জামান উভয়কেই শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

কেন সুমন জাহিদকে হত্যা করা হতে পারে এমন প্রশ্নে এটিএম এমদাদুল হক বুলবুলের উত্তর— “আপনারা জানেন, গণআদালতের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন সুমন জাহিদ। এছাড়া বর্তমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। দু’জনই পলাতক। তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তারাও সুমন জাহিদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করতে পারে। ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে তার পরা পোশাকের ক্ষয়ক্ষতি হতো। কিন্তু তা হয়নি। এটা রহস্যজনক।”

উত্তর শাজাহানপুরের ৩১২ নম্বর ভবনের সপ্তম তলায় স্ত্রী দ্রাকসিন্দা জবীন টুইসি ও দুই ছেলেকে নিয়ে বসবাস করতেন সুমন জাহিদ। এই ঘটনায় পুরো পরিবার শোকে বিহ্ববল ও বাকরুদ্ধ। তারা কেউ এই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে মানতে পারছেন না। নিহত সুমন জাহিদের বড় ছেলে শ্রয়ন জওহর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাবা প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটাহাটি করতেন। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিনি বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে বের হন। ১০টার পর আমরা তার লাশ রেললাইনের পাশে পড়ে থাকার খবর পাই। কিন্তু তিনি সচেতন মানুষ ছিলেন।’

শুক্রবার (১৫ জুন) সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, রেললাইনের দুই পাশের মানুষ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন। ঘটনাস্থলের পাশেই রয়েছে একটি ছোট চায়ের দোকান। এটি পরিচালনা করেন নুরুন্নাহার। শুক্রবার সকালে তার দোকান বন্ধ ছিল। তবে বৃহস্পতিবার ঘটনার সময় দোকানের পাশে তার মেয়ে নাদিয়া (৮) খেলছিল।

চা-দোকানি নুরুন্নাহার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার মেয়ে ছোট। সময়টা আমার মনে নেই। কিন্তু মেয়ে বাসায় গিয়ে আমাকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে। আমি তার কাছ থেকে বিষয়টি শুনি। এরপর আমি রেললাইনের সামনে এসে দেখি লোকটার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ট্রেনের লাইনে পড়ে আছে। আর শরীর ট্রেনের লাইনের বাইরে। এরপর পুলিশ আসে। মানুষটা প্রায়ই এদিকে আসতেন।’

তবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা ট্রেন চলে যাওয়ার পর সুমন জাহিদের লাশ দেখতে পান। তবে কখন ও কীভাবে তিনি সেখানে এসেছিলেন তা কেউ বলতে পারেননি। মিডলাইন পরিবহনের শ্রমিক আশিকুর রহমান মুরাদ থাকেন ওই এলাকাতেই। সুমন জাহিদকে তিনিও চেনেন। ঘটনার কয়েকদিন আগেও কাজে যাওয়ার পথে তাকে ওই এলাকায় দেখেছেন মুরাদ। তবে মৃত্যুর বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারেননি।

সুমন জাহিদের মৃত্যুকে ট্রেনে কাটা পড়ে কিংবা আত্মহত্যা বলার চেষ্টা করলেও শহীদ সিরাজউদ্দিনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর তাতে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আট বছর বয়সে সুমন জাহিদের সামনে তার মা সেলিনা পারভীনকে আল বদররা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে দেখেছি তার সংগ্রামী জীবন। স্কুটার চালিয়ে লেখাপড়া করেছেন। শত সংগ্রামের পথ পেরিয়ে তিনি একটা পর্যায়ে এসেছিলেন। সেই সুমন জাহিদের আত্মহত্যা করার প্রশ্নই ওঠে না।’

সুমন জাহিদ (ছবি: সংগৃহীত) তৌহিদ রেজা নূরের কথায়, ‘সুমন জাহিদ খুব সচেতন মানুষ ছিলেন। বাসা থেকে সবসময় মোটরসাইকেল নিয়ে বের হতেন। কিন্তু আজ তার সঙ্গে মোটরসাইকেল ছিল না। তার মতো একজন সচেতন মানুষের সামনে এত বড় ট্রেন আসবে আর তিনি ট্রেনে কাটা পড়বেন, এটা হতেই পারে না। সুমন জাহিদের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ট্রেনে কাটা পড়লে শরীর থেকে মাথা এভাবে বিচ্ছিন্ন হতো না। গলা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো, মুখে আরও আঘাতের চিহ্ন থাকতো। ধারণা করছি, তার গলায় ধারালো কোনও অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। এটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কারা, কীভাবে ও কেন এই হত্যাকাণ্ড, আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।’

ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইয়াসিন ফারুক মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পরিবার দাবি করছে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের থানায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। আমরা সব বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করছি। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।’

এদিকে সুরতহাল প্রতিবেদনে কমলাপুর রেলওয়ে থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই ) আনোয়ার হোসেন উল্লেখ করেছেন, ‘সুমন জাহিদের কপালের সামনের অংশে সামান্য জখম রয়েছে। মাথার পেছনে কানের ওপরে ২ ইঞ্চি থেতলে গেছে, সেখানেও জখমের দাগ রয়েছে। শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন ছিল। নাক, পায়ের পাতা, পিঠ ও পাঁজর স্বাভাবিক মনে হয়েছে। মুখ অর্ধ্বখোলা আর দাঁত দেখা গেছে। দুই হাত লম্বালম্বি অবস্থায় পড়ে ছিল।’

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়— উপস্থিত লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ও রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম স্টেশন মাস্টার কর্তৃক মেমো পর্যালোচনায় জানা যায়, ট্রেনে কাটা পড়ে সুমন জাহিদের মৃত্যু হয়েছে। তথাপি মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ে মৃতদেহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের মর্গে পাঠানো হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘ময়নাতদন্তের আলোকে বলা যায়, সুমন জাহিদের শরীর থেকে মাথা আলাদা হয়ে গেছে। ধারণা করছি, ট্রেনে কাটা পড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। তার মাথা, পিঠ ও মুখে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এগুলো ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে হতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি। আমরা লাশের ভিসেরা পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছি। এই পরীক্ষাগুলোর রিপোর্ট হাতে এলে আরও স্পষ্ট হবো কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে।’

আইজিপি মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘একটা মৃতদেহ অস্বাভাবিক অবস্থায় পাওয়া গেলে তদন্ত হয়। সুমন জাহিদের বিষয়টিও এখন তদন্তের পর্যায়ে আছে। এটা হত্যা, আত্মহত্যা, নাকি অন্যকিছু; তা নিয়ে মন্তব্য করার এখনও সময় হয়নি।’

বৃহস্পতিবার (১৪ জুন) সকালে খিলগাঁওয়ের বাগিচা এলাকায় রেললাইনের পাশ থেকে সুমন জাহিদের (৫২) দ্বিখণ্ডিত লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে থানা পুলিশ। এরপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গে ময়নাতদন্তের পর পরিবারের কাছে তার মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।

আরও পড়ুন-
সুমন জাহিদের মৃত্যু নিয়ে কথা বলার সময় আসেনি: আইজিপি
সুমন জাহিদের মৃত্যু নিয়ে রহস্য: ময়নাতদন্ত রিপোর্টের অপেক্ষায় পুলিশ
‘হুমকিদাতারাই সুমন জাহিদকে হত্যা করেছে’

সুমন জাহিদের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন

সুমন জাহিদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ

শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনের ছেলের লাশ উদ্ধার

/এআরআর/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তাপ কমাতে সড়কে প্রতিদিন ৪ লাখ লিটার পানি ছিটাচ্ছে ডিএনসিসি
তাপ কমাতে সড়কে প্রতিদিন ৪ লাখ লিটার পানি ছিটাচ্ছে ডিএনসিসি
ঢামেকে কারাবন্দি হাজতির মৃত্যু
ঢামেকে কারাবন্দি হাজতির মৃত্যু
ফটোগ্রাফারদের ওপর খেপলেন নোরা ফাতেহি!
ফটোগ্রাফারদের ওপর খেপলেন নোরা ফাতেহি!
রানা প্লাজায় নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ
রানা প্লাজায় নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…