X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ফাইল নিয়ে ডাক্তার খোঁজেন রোগীর স্বজনরা

আমানুর রহমান রনি
১৮ জুন ২০১৮, ১৭:২৯আপডেট : ১৯ জুন ২০১৮, ১০:৩৮






অসুস্থ মনোয়ারা বেগমকে পরিচর্যা করছেন তার দুই মেয়ে মনোয়ারা বেগম। ষাটোর্ধ্ব এই নারী যকৃতের সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগ নিয়ে গত বুধবার ভর্তি হয়েছেন রাজধানীর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তবে ঈদের ছুটি থাকায় ঠিকঠাক চিকিৎসা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন তার দুই মেয়ে।
মনোয়ারা বেগম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চার নম্বর ওয়ার্ডের ১১৮ নম্বর বেডে ভর্তি রয়েছেন। ঈদের দিন (শনিবার) বিকাল তিনটার দিকে দেখা গেছে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দুই মেয়ে নুরুন্নাহার বেগম ও শিল্পী বেগম তার পাশে বসে কান্না করছেন। তারা মাকে ডাকছেন—কিন্তু তাদের মা তখন বেহুশ ও নিস্তেজ হয়ে আছেন। বড় মেয়ে নুরুন্নাহার মায়ের বুক মালিশ করে দিচ্ছেন। ছোট মেয়ে শিল্পী দৌড়ে নার্সের কাছে গেছেন। ওই ওয়ার্ডে দুজন নার্স তখন দায়িত্বে ছিলেন, এদের একজন কনিকা সরকার জরুরি বিভাগের চিকিৎসকদের কাছে যেতে বললেন নুরুন্নাহারকে। নার্স এসে মানোয়ারাকে অক্সিজেন দিয়েছেন।
এরপর ছোট মেয়ে শিল্পী দৌড়ে আবারও জরুরি বিভাগে যান। জরুরি বিভাগ থেকে ফিরে এসে শিল্পী তার বড় বোনকে জানান, চিকিৎসক আসবে বলেছেন। কিন্তু ২০/২৫ মিনিট হয়ে গেছে, চিকিৎসক আসেন না। এদিকে, তাদের মায়ের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। নুরুন্নাহার ও শিল্পীর বিলাপ বেড়ে যায়। বড় বোন আবারও শিল্পীকে ফাইল নিয়ে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের কাছে যেতে বলেন। শিল্পী দৌড়ে জরুরি বিভাগের দিকে গেলেন। এবার ওয়ার্ডের নার্স ইন্টারকমে রোগীর খারাপ অবস্থার কথা কাউকে বলেছেন। এর কিছুক্ষণ পর এক নারী চিকিৎসক জরুরি বিভাগ থেকে আসেন। তিনি রোগী মনোয়ারা বেগমের ফাইল দেখেন এবং ফের অক্সিজেন লাগিয়ে দিয়ে চলে যান।

এ সময় আশপাশের রোগীর স্বজনরা মনোয়ারা বেগমের বেডের পাশে ভিড় করেন। তার বড় মেয়ে নুরুন্নাহার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বুধবার যখন এখানে ভর্তি করা হয়, সেদিন ডাক্তার এসে মাকে দেখেছিলেন। এরপর বৃহস্পতিবার একজন চিকিৎসক এসেছিলেন, তিনি দূর থেকে দেখে চলে যান। তবে শুক্র ও শনিবার কোনও চিকিৎসক ওয়ার্ডে আসেননি। সমস্যা হলে নার্সরা জরুরি বিভাগের চিকিৎসদের কাছে আমাদের যেতে বলেছেন।’


মনোয়ারা বেগমকে নিয়ে তার দুই মেয়ে বরিশালের মুলাদীর খালাসিরচর এলাকা থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এসেছেন। ঈদের ছুটিতে চিকিৎসক না থাকায় তারা যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন।
একই ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন ফরিদা বেগম (৪৫)। তার বেডের পাশেই বসা ছিল শাহীন নামে এক যুবক। ফরিদা বেগম তার চাচী হন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে তাকে ঈদের দিন সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এনে ভর্তি করানো হয়।
এই ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন মনোয়ারা বেগম শাহীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিকিৎসকরা ওয়ার্ডে আসেন না। ঈদের কারণে সবাই ছুটিতে রয়েছেন। চাচির স্বাস্থ্যের অবনতি হলে নার্সদের কাছে যাই। তারা জরুরি বিভাগের চিকিৎসকদের কাছে পাঠান। এছাড়া, আগেকার ওষুধ খাচ্ছে। শনিবার সকালে ফাইল নিয়ে জরুরি বিভাগে গিয়েছিলাম। তবে চাচির স্বাস্থ্যের কোনও উন্নতি হচ্ছে না।’
ওয়ার্ডের বারান্দায় নিলুফা বেগম (৩২) নামে আরও এক নারী ৯ দিন ধরে ভর্তি রয়েছেন। বেডের পাশেই বসে আছেন তার স্বামী মো. খোকন । তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তিন দিন ধরে চিকিৎসক আসেন না। নার্সরাই ভরসা। তারা দেখেন।’ নিলুফার ব্রেইন টিউমারে ভুগছেন।
মেডিসিনের বিশেষায়িত এই ওয়ার্ডটি নারীদের জন্য। ঈদের দিন (শনিবার) সেখানে রোগী ছিল ৫২ জন। তাদের সেবায় নার্স রয়েছেন চারজন।তবে শনিবার বিকালে দুজন নার্সকে দেখা গেছে। চিকিৎসক না আসায় রোগী ও তাদের স্বজনদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এই ওয়ার্ডে কর্তব্যরত নার্স (সেবিকা) কনিকা সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে নতুন রোস্টার করা হয়েছে। রোস্টার অনুযায়ী চিকিৎসকরা ডিউটি করেন। এছাড়া, জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসক থাকেন। রোগীর কোনও সমস্যা হলে তারা দেখেন।’
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ৫ নম্বর ওয়ার্ডটি সার্জারির পুরুষের জন্য। সেখানে কিডনি জটিলতা নিয়ে ভর্তি আছেন আবুল খায়ের (৫৫)। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ এলাকা থেকে এসেছেন তিনি। গত মঙ্গলবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
আবুল খায়ের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঈদের দিন ও পরের দিন কোনও চিকিৎসক আসেননি। সমস্যা হলে আমরা ফাইল নিয়ে জরুরি বিভাগে যাই। সেখান থেকেই চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন। এই দুদিন কোনও চিকিৎসক আমাকে দেখেননি। তবে মোবাইল নম্বর আছে চিকিৎসকের, ঈদের দিন আমি ফোনে তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। সমস্যা হলে আবার ফোন দেবো।’
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের একাধিক ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের আগের দিন শুক্রবার ও ঈদের দিন শনিবার ওয়ার্ডে কোনও চিকিৎসক আসেননি। পরামর্শের জন্য রোগীর স্বজনদের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকদের কাছেই যেতে হয়।
হাসপাতালটির ২ নম্বর ওয়ার্ডটি অর্থোপেডিক্স ট্রমা সার্জারি বিভাগ। নাঈম ইসলাম নামে এক রোগী অতিরিক্ত ২ নম্বর বেডে ভর্তি আছেন। তিনি প্রায় একমাস ধরে পায়ের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
নাঈম ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডাক্তাররা ছুটিতে আছেন। ঈদের ছুটির কারণে শুক্রবার ও শনিবার তারা ওয়ার্ডে আসেননি।’
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মোট ১২টি ওয়ার্ড রয়েছে। এছাড়া, তিনটি অপারেশন থিয়েটার (ওটি), আইসিইউ, পোস্ট আইসিইউ রয়েছে দুটি করে। ঈদে মুসলিম চিকিৎসক ও নার্সদের ছুটি দেওয়া হয় সাধারণত। এবারও তাই হয়েছে। বর্তমানে অন্যান্য ধর্মের ও মুসলিম মিলিয়ে মোট ১৫ জন চিকিৎসক হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে শনিবার কেবল জরুরি বিভাগে দুই নারী ও এক পুরুষ চিকিৎসককে দেখা গেছে। বিকালে ওয়ার্ডে কোনও চিকিৎসককে ভিজিট করতে দেখা যায়নি।
শনিবার বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ৩১৭ জন নারী-পুরুষ রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি ছিলেন। তাদের সেবায় ১২০ জন নার্স বিভিন্ন ওয়ার্ড ও ওটিতে দায়িত্ব পালন করছেন।


শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. এএইচএম ফিরোজ স্বাক্ষরিত এক সেন্ট্রাল রোস্টারে চিকিৎসকদের দুই শিফটে ১৫ জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এবং রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত আরেক দল চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া, পাঁচজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রফেসর ‘অন সেল’ বা ‘মোবাইল ফোনে’ পরামর্শ দেবেন। রোস্টারে তাদেরও নাম রয়েছে।
ঈদের কারণে গত ১৫ জুন থেকে এই সেন্ট্রাল রোস্টার চালু হয়েছে। চলবে ১৯ জুন পর্যন্ত।
হাসপাতালটির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রফেসর ড. মাজহারুল হক চৌধুরী ঈদে মোবাইল ফোনে দায়িত্ব পালন করছেন। রোগী ও স্বজনদের অভিযোগের বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘ঈদের মধ্যে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারপরও পরিচালক প্রয়োজন অনুযায়ী রোস্টার বা তালিকা করে দিয়েছেন কারা দায়িত্ব পালন করবেন। আমাদের জরুরি বিভাগে সব সময় চিকিৎসক থাকেন।’
তিনি বলেন, ‘কোনও সমস্যা হলে ওয়ার্ডের নার্স কর্তব্যরত চিকিৎসকদের জানাবেন। ঈদে কর্তব্যরত সব চিকিৎসকের মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে।’
রোগীরা সবসময় সর্বোচ্চ চিকিৎসা চান, তবে চিকিৎসক প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে থাকেন বলেও জানান তিনি।


 

 

/এআরআর/এপিএইচ/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
উপজেলা নির্বাচনদলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে আছেন মন্ত্রী-এমপির যেসব স্বজন
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক