X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাস বেশি, যোগ্য কম!

রশিদ আল রুহানী
০২ জুলাই ২০১৮, ১৩:৪২আপডেট : ০২ জুলাই ২০১৮, ২১:১১

চাকরি

বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের পেপার সেকশনের জন্য গত এপ্রিলে এক্সিকিউটিভ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ এবং ডিভিশনাল ম্যানেজার পোস্টের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। এসব পদে অন্তত ১৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। আবেদনও পড়ে অনেক। আবেদনকারীদের মধ্যে শর্টলিস্ট করে এ মাসের প্রথম সপ্তাহে সাক্ষাৎকার নেয় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু আবেদনকারীদের মধ্য থেকে কাঙ্ক্ষিত জনবল নিয়োগ দিতে পারেনি তারা। কারণ, সাক্ষাৎকার শেষে বেশিরভাগ প্রার্থীকেই অযোগ্য বলে মনে হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে আবারও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বসুন্ধরা গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার শাহীনুর রহমান শাহীন বলেন, ‘যোগ্য ও দক্ষ জনবল পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।’

এরকম আরও কয়েকটি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন হতাশাজনক তথ্য পাওয়া গেছে।

নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, কাজে দক্ষ না হলে চাকরি দেওয়া যেমন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব হয় না, তেমনি বেকারদের জন্যেও বিষয়টি হতাশার। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, যোগ্য ও দক্ষ হয়ে না ওঠার পেছনে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার গলদ রয়েছে। গলদ রয়েছে কারিকুলামে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ছিল ১০ কোটি ৯১ লাখ। এরমধ্যে বেকার ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। এই বেকারদের মধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার তরুণ-তরুণী উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেও চাকরি পাচ্ছেন না। বেকারদের ৩৯ শতাংশই এমন শিক্ষিত। অথচ নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বলছে, শিক্ষিত হলেও যোগ্য ও দক্ষ প্রার্থীর অভাব রয়েছে।

দেশের প্রথম সারির এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের সাবেক এক শিক্ষার্থী বর্তমানে চাকরি করেন স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কোয়ালিটি কন্ট্রোল সেকশনে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘পড়াশোনা করেছি বায়োকেমিস্ট্রিতে। ফলে চাকরিও করতে চেয়েছি সাবজেক্ট রিলেটেড কোনও প্রতিষ্ঠানে। সে অনুযায়ীই এই প্রতিষ্ঠানে এই পোস্টে চাকরির জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু চাকরি জীবনে প্রবেশ করে দেখি আমার পড়াশোনা বা জানাশোনার সঙ্গে চাকরির তেমন কোনও মিলই নেই। মিল রয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। বাকি ৯০ শতাংশ কাজই আমাকে এখন শিখে নিতে হচ্ছে।’

পাস করার পর বেশিরভাগ তরুণ-তরুণীই কাক্ষিত চাকরি খুঁজে পান না

তিনি বলেন, ‘অনেক সময় নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানও ভালোভাবে জানেন না কোন বিষয়ে কী পড়ানো হয়। ফলে তারা চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে যেসব বিভাগের শিক্ষার্থী চেয়ে বসে তাতে চাকরি পাওয়ার পর ওই শিক্ষার্থীকেই সমস্যায় পড়তে হয়। তখন ওই শিক্ষার্থীর দক্ষতা নিয়েও তৈরি হয় প্রশ্ন।’

হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহেন্সমেন্ট প্রজেক্ট (হেকেপ) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব চিহ্নিত করতে গত দেড় বছর ধরে একটি জরিপ পরিচালনা করছে।  এর অংশ হিসেবে দেশের ৬৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮১০ বিভাগের ওপর একটি জরিপ পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগেই ইন্সটিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসিওরেন্স সেল (আইকিউএসি) গঠন করা হয়। ওই বিভাগগুলোর শিক্ষা-গবেষণার মান নিরূপণের জন্য প্রধান ৫টি স্টেকহোল্ডার—শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অ্যালামনাই এবং তাদের নিয়োগকর্তাদের ভেতর জরিপ চালানো হচ্ছে। এই জরিপের অংশ হিসেবে সেলফ অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট তৈরির পর পুরো প্রক্রিয়া এক্সটার্নাল পিয়ার রিভিউ করার জন্য একজন বিদেশি কোয়ালিটি অ্যাসিওরেন্স বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের একটি টিম ৩ দিন ধরে বিভাগে রিভিউ পরিচালনা করে।

সেলফ অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টের ফাইন্ডিংস এবং এক্সটার্নাল পিয়ার রিভিউ টিমের প্রতিবেদনের পর ওই বিভাগের পঠন-পাঠন ও গবেষণায় প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা হবে।

নিয়মিত এ ধরনের সেলফ অ্যাসেসমেন্ট এবং পরে রিভিউ বিভাগের ডিগ্রিগুলোর গুণগত মান বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের চাকরিযোগ্যতা বৃদ্ধি করবে বলে মন্তব্য করেন হেকেপের কোয়ালিটি অ্যাসিওরেন্সের প্রধান ও কোয়ালিটি অ্যাসিওরেন্স স্পেশালিস্ট অধ্যাপক ড. সঞ্জয় কুমার অধিকারী।

তিনি বলেন, ‘এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্যই হলো শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিভাগের দুর্বলতা চিহ্নিত করা। তার আলোকে শিক্ষার্থীদের কীভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায় সেটা নিয়েই কাজ করছে হেকেপ।’

সঞ্জয় কুমার অধিকারী বলেন, ‘প্রতিবেদনের আলোকে ইউজিসিকে সুপারিশ করা হয়েছে, একটি আদর্শ কারিকুলাম টেমপ্লেট তৈরি করে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে সরবরাহ করতে, যাতে সব বিশ্ববিদ্যালয় সেই আলোকে কারিকুলাম সংস্কার করে। সেটাও হয়তো হবে, কিন্তু একটু সময় লাগছে। তবে ওই প্রজেক্টের অংশ হিসেবে কারিকুলাম সংস্কারের সুপারিশ অনুযায়ী এরই মধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগ কারিকুলাম সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। বিভাগগুলো যথাসম্ভব চেষ্টা করছে কারিকুলামটি সময়োপযোগী করার।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন পাঠিয়েছে হেকেপ কার্যালয়ে। প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে কারিকুলাম সংস্কার ও সময়োপযোগী করার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া বিভাগের ক্লাসরুম সংকট কাটিয়ে ওঠা, গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি, শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, প্রায় প্রতিমাসে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার প্লানিং সেমিনারের আয়োজন করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। সেখানকার বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাবেক শিক্ষার্থী ও ওইসব সাবেক শিক্ষার্থীদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে।

বিভাগটিতে ওই জরিপ পরিচালনার অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ আজিজুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা জরিপটি পরিচালনা করে বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছি। এরমধ্যে অন্যতম কারিকুলাম সংস্কার। এই সুপারিশের আলোকে এরই মধ্যে কারিকুলাম সংস্কারের কাজ শুরুও হয়েছে। কারিকুলামটি আরও বেশি সময়োপযোগী করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যাতে চাকরিক্ষেত্রে গিয়ে শিক্ষার্থীরা এই কারিকুলামের সঙ্গে অনেকাংশেই মিল পান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাতে-কলমে শিখে যাওয়া বিষয় যেন চাকরি জীবনে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে।’

জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাতেই গলদ রয়েছে। এ দেশে মেধা ও দক্ষতার মূল্যায়ন করা হয় না। এর জন্য অন্যতম দায়ী কারিকুলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কারিকুলামের সংস্কার প্রয়োজন। শুধু তা-ই নয়, তরুণ প্রজন্মকে সঠিকভাবে সঠিক পথে নিতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থারই আমূল সংস্কার প্রয়োজন। না হলে শিক্ষার্থীরা পাসই করবে, কিন্তু কোনও কাজের জন্য দক্ষ হয়ে উঠবে না।’

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সার্টিফিকেট অর্জনই যেন প্রধান লক্ষ্য হয়ে পড়েছে সবার। কিন্তু সার্টিফিকেট অর্জন এবং দক্ষতা এক জিনিস নয়। যেমন একজন ওয়েল্ডিং ইঞ্জিনিয়ার যদি ওয়েল্ডিংয়ের কাজ না জানে তাহলে সেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোনও মূল্য আছে? সেই ইঞ্জিনিয়ার তার প্রতিষ্ঠানের অন্যদের কী শেখাবেন অথবা সেই প্রতিষ্ঠানের কাজের মূল্যায়ন তিনি কীভাবেই বা করবেন? ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়েল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্টে পড়া আর ওয়েল্ডিং করা এক জিনিস নয়। এখন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম এমনই রয়েছে বাস্তবধর্মী, প্র্যাক্টিক্যাল কোনও কিছু নেই, শুধু থিওরি পড়িয়ে সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের এই ধরনের টেন্ডেন্সি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শিক্ষার সংস্কার করে বাস্তবমুখী, হাতে-কলমে, টেকনিক্যাল শিক্ষার দিকে নজর দিতে হবে।’

/এইচআই/ আপ-টিএন/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক