X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

এখনও বন্ধ হয়নি জাল স্বাক্ষরে নেওয়া খাটাল

রাফসান জানি ও আনোয়ার হোসেন
১৮ জুলাই ২০১৮, ০৭:৪৫আপডেট : ১৮ জুলাই ২০১৮, ১৩:৪০







খাটাল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর বিওপি সংলগ্ন খাটালটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিবের সই জাল করে পরিচালিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও সেটি চলছে কোনও বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই। চলছে চোরাই গরু-মহিষের রমরমা বাণিজ্য। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থও। এক হিসাবে, গত দুই মাসেই হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে সাত কোটির বেশি টাকা।



স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব হারুন অর রশিদ বিশ্বাসের সই জাল করে খাটালটি চালাচ্ছেন স্থানীয় কেনাল আলী। তাকে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। গত ৮ জুলাই বাংলা ট্রিবিউনে ‘খাটাল চলছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিবের জাল স্বাক্ষরে’ শীর্ষক শিরোনামে খবর প্রকাশে পর থেকে পলাতক রয়েছেন কেনাল আলী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব মো. হারুন অর রশিদ বিশ্বাসের সই করা একটি চিঠি ব্যবহার করে খাটাল পরিচালনা শুরু করেন তিনি। ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারিতে ইস্যু করা চিঠিটিতে স্মারক নম্বর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ০২৮.১২৮.০০০০.১৬৭-২৩। খাটালটি অনুমোদনের কাগজে গত জানুয়ারির কথা উল্লেখ থাকলেও গত মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এতে গরু-মহিষ আসা শুরু হয়।
গত ১৯ জুন বিষয়টি উল্লেখ করে স্থানীয় একটি পক্ষ বিষয়টি তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলে সই জালের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। পরে ২৬ জুন সই জাল করে খাটাল অনুমোদনের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেফতারসহ আইননানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আলমগীর হোসেন। নির্দেশনাটি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক, চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও একই জেলার পুলিশ সুপারকে পাঠানো হয়।
এখনও অবৈধভাবে চলছে খাটাল
সরেজমিনে দেখা গেছে, অবৈধ খাটালটিতে গরু-মহিষের জন্য জোড়া প্রতি ১২ হাজার ৪০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। গরু ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকারি নিয়ম উপেক্ষা করে কয়েকশ’ গুণ বেশি অর্থ আদায় করা হচ্ছে।
গত শুক্রবার (১৩ জুলাই) চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর বিওপি সংলগ্ন খাটালটি গিয়ে দেখা যায়, ভারতীয় চোরাই গরু-মহিষ বাবদ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোড়া প্রতি নেওয়া হচ্ছে ১২ হাজার ৪০০ টাকা করে। কেন অতিরিক্ত অর্থ দিচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে গরু ব্যবসায়ী এনামুল জানান, ‘বিট-খাটাল মালিকরা জোরপূর্বক এই অর্থ নিচ্ছেন। না দিয়ে কোনও উপায়ও নেই। বিভিন্ন খাতের কথা বলে এই টাকা নেন তারা। এতে আমাদের কোনও লাভই থাকছে না। লাভের টাকার বড় অংশই চলে যাচ্ছে খাটাল মালিকদের পকেটে। অথচ জীবন বাজি রেখে আমরা ভারত থেকে গরু নিয়ে আসি।’
আরেকজন ব্যবসায়ী মো. শাহীন বলেন, ‘খাটালে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া ছাড়াও রাস্তা খরচের কারণে গরুর মাংসের দাম কমছে না।’ খাটাল এলাকায় আরও অনেক ব্যবসায়ী অতিরিক্ত টাকা নেওয়া বন্ধের জোর দাবি জানান প্রশাসনের কাছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে দীর্ঘদিন ধরে গরুর ব্যবসা করা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বাসিন্দা শরিফুল ইসমলাম জানান, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী জোড়া প্রতি কাষ্টমস বাবদ এক হাজার টাকা এবং খাটাল বাবদ জোড়ায় ১০০ টাকা সবমিলিয়ে এক হাজার ১০০ টাকা করে নিলে আমাদের সুবিধা হয়। আর একজোড়া গরুর জন্য নেওয়া হচ্ছে ১২ হাজার ৪০০ টাকা। অথচ অতিরিক্ত টাকা নেওয়া ঠেকাতে কোনও ব্যবস্থাই নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন। উল্টো তাদের সহযোগিতা করছে।


সংবাদ সংগ্রহে বাধা
ফতেপুর বিওপি সংলগ্ন এই খাটালে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলার সময় বাংলা ট্রিবিউনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধিসহ অন্যান্যদের বাধাও দেন খাটালের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা। এনিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ ও বিনিময়ে কিছু অর্থ দেওয়ারও চেষ্টা করেন তারা।
দুই মাসে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ৭ কোটি
সরকারি হিসাব অনুযায়ী খাটালে প্রতিটি গবাদি পশুর জন্য ২০ টাকা ও অতিরিক্ত প্রতিদিনের জন্য ৩০ টাকা হারে ফি আদায়ের নিয়ম রয়েছে। অথচ এরই মধ্যে এই চক্রটি অবৈধভাবে সাত কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন গরু ব্যবসায়ীরা। যদিও বাড়তি টাকা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন খাটাল সংশ্লিষ্টরা।
শিবগঞ্জের কানসাট করিডোর সূত্রে জানা গেছে, গত দুই মাসে প্রায় ১২ হাজার ৪৭৯টি গরু-মহিষ করিডোর পার হয়েছে। যা থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ৬২ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা। আর বিট খাটাল মালিকরা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন সাত কোটি পাঁচ লাখ ছয় হাজার ৩৫০ টাকা।
তবে খাটাল মালিকদের প্রতিনিধি মুক্তার হোসেন অতিরিক্ত টাকা আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘ফতেপুর খাটাল থেকে কোনও ধরনের বাড়তি অর্থ আদায় করা হচ্ছে না। একটি মহল ঈর্ষান্বিত হয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।’
প্রশাসনের বক্তব্য
অবৈধভাবে খাটাল চালানো ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের চিঠির বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘কেনাল আলী বিট বা খাটালটি পাওয়ার বিষয়ে কোনও আবেদনই করেনি জেলা প্রশাসনের কাছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাওয়া চিঠির পর সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। আর ওই বিট খাটালে নিয়মের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব বিজিবির। সেখানে কোনও কিছু করার সুযোগ জেলা প্রশাসেনর নেই।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৫৩ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্ণেল সাজ্জাদ সরোয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি স্থানীয় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পাওয়ার পর এ বিষয়ে একটি যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই চলছে।’
সই জাল বলা হলেও খাটালটি চালাতে কোনও বাধা নেই বলে জানান লে. কর্ণেল সাজ্জাদ সরোয়ার। তিনি বলেন, ‘বিটটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনুমোদন হয়েই আসছে। তাই আইনগতভাবে এটি চালাতে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।’
অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিষয়ে বিজিবির কিছু করার নেই উল্লেখ করে ৫৩ বিজিবির অধিনায়ক বলেন, ‘আমরা শুধু কাস্টমসের বিষয়টি দেখি যে গরু প্রতি ৫০০ টাকা সরকারি রাজস্ব খাতে জমা পড়ছে কিনা।’
গেজেট অনুযায়ী, খাটাল অনুমোদন দেওয়ার পর তা তদারকি করার দায়িত্ব উপজেলা কমিটির। আর এই কমিটির প্রধান (সভাপতি) হবেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। সদস্য হিসেবে থাকবেন বিজিবির প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জ, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্য সচিব হিসেবে থাকবেন কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা।
এছাড়া জেলা টাস্কফোর্স কমিটির প্রতিনিধি প্রতিমাসে কমপক্ষে একবার খাটালের কার্যক্রম পরিদর্শন করবেন। স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে মাঝে মাঝে খাটাল পরিদর্শন করবেন।

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনের উপায় কী
অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনের উপায় কী
সর্বাধিক পঠিত
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন
চুরি ও ভেজাল প্রতিরোধে ট্যাংক লরিতে নতুন ব্যবস্থা আসছে
চুরি ও ভেজাল প্রতিরোধে ট্যাংক লরিতে নতুন ব্যবস্থা আসছে
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়