X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা (প্রথম পর্ব)

মাসে বেতন ১৭৯ টাকা!

এস এম আববাস
১০ আগস্ট ২০১৮, ০০:২২আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৮:১২

শিক্ষামন্ত্রণালয়

 

দেশে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে। বেড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও। এর মধ্যেও এক শ্রেণির শিক্ষকের দুঃখ ঘুচছে না কিছুতেই। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, এক শ্রেণির কলেজ শিক্ষকের মাসিক বেতন এখনও মাত্র ১৭৯ টাকা ৪০ পয়সা। গত ৪১ বছরে মাত্র ২৯ টাকা ৯০ পয়সা বেড়ে বেতনের পরিমাণ এ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। বছরে পর বছর ধরে এই বেতন বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন সংস্কৃত ও পালি ভাষার শিক্ষকরা। আন্দোলন না করলেও আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে বেতন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

মৌলভীবাজারের নিত্যানন্দ সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ বরুণ ভট্টাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণী বিজ্ঞানে অনার্স এবং ফিসারিজ থেকে মাস্টার্স শেষ করে ব্যাকরণ ও কাব্যতীর্থ নিয়ে পড়াশোনা করেন। লেখাপড়া শেষ করে নিত্যানন্দ সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন ২০১২ সালে। তিনি জানান, চাকরিতে যোগ দিয়ে প্রথম বেতন পান ১৪৯ টাকা ৫০ পয়সা। ২০১৫ সালে জাতীয় বেতন স্কেল নির্ধারণের সময় সরকার তার বেতন ২৯ টাকা ৯০ পয়সা বাড়িয়ে নির্ধারণ করে ১৭৯ টাকা ৪০ পয়সা। সেই বেতন নিয়ে সংস্কৃত ভাষা সংরক্ষণে নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন শিক্ষকতার মহান পেশায়। এখন তিনি কলেজটির অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন।

বরুণ ভট্টাচার্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংস্কৃত ও পালি ভাষা দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এটিকে ধরে রাখতে শিক্ষকতা শুরু করি। বেতন না পেয়ে চলতে কষ্ট হয়। তারপরেও ভাষা ও পুরনো সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে শিক্ষকতা করছি। শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাবো।’

রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার বিনাপানী সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক তপন কুমার সাহার অবস্থাও একই। তিনি জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দিনাজুরের একটি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। কাব্য ও ব্যকরণতীর্থ, স্মৃতি, বেদান্ত এবং পৌরহিত্য বিষয় নিয়ে লেখাপড়া শেষ করে বিনাপানী সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

তপন কুমার সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি ১৫ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি। কাব্যতীর্থ, ব্যকরণতীর্থ, স্মৃতি বিষয়ে  ছাত্রদের পড়াই। আগে বেতন পেতাম ১৪৯ টাকা ৫০ পয়সা, এখন বেতন পাই ১৭৯ টাকা ৪০ পয়সা। তবে বেতন মুখ্য বিষয় না ভেবে বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃত ও পালিভাষাসহ সনাতন ঐতিহ্য ধরে রাখতে শিক্ষককতা করে যাচ্ছি। বর্তমানে কলেজটির অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছি।’

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা জানান, এসএসসি পাসের পর তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন শিক্ষার্থীরা। তাদের পড়ানো হয়— কাব্যতীর্থ, ব্যাকারণতীর্থ, আয়ুর্বেদতীর্থ, পুরাণ, জ্যোতিঃশাস্ত্র, স্মৃতি, বেদ ও বেদান্ত বিষয়ে। এই কলেজ থেকে পাস করে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সনাতন ধর্মের শিক্ষক হিসেবেই বেশি যোগদান করে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান জানান, সংস্কৃত ও পালি কলেজ থেকে কাব্যতীর্থ বা ব্যাকরণতীর্থ পাস করলেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেন। তবে বেদ, বেদান্ত, স্মৃতিসহ অন্যান্য বিষয়ে যারা পড়েন, তারা বেশি গুরুত্ব পান। পুরাণ বিষয়ে পাস করা শিক্ষার্থীরা বিয়ের নিবন্ধন করার যোগ্যতা অর্জন করেন। জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে যারা পাস করবেন, তারা জ্যোতির্বিদ হতে পারেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশ স্বাধীনের পর এসব শিক্ষককরা বেতন পেতেন ১১৫ টাকা। ১৯৭৭ সালে নতুন বেতন স্কেল নির্ধারণের সময় স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের বেতন স্কেল নির্ধারিত হলেও তাদের হয়নি। ওই সময় ৩০ শতাংশ মহার্ঘভাতাসহ ১৪৯ টাকা ৫০ পয়সা আর কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন ৩০ শতাংশ মহার্ঘভাতাসহ ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ৪২ বছর পর গত ২০১৫ সালে বেতন বাড়িয়ে সরকার নির্ধারণ করে ১৭৮ টাকা ৪০ পয়সা। আর কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭৮ টাকা। অর্থাৎ ৪২ বছরে শিক্ষকের বেতন বেড়েছে ২৯ টাকা ৯০ পয়সা এবং কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে ১৮ টাকা।

স্বাধীনতার পর যখন এসব শিক্ষকদের ১৪৯ টাকা ৫০ বেতন নির্ধারণ করা হয়, ওই সময় সরকারি কলেজের প্রভাষকদের বেতন ছিল ৪৫০ টাকা। আর বেসরকারি পর্যায়ে একজন প্রভাষকের বেতন ছিল ৩৭৫ টাকা। এখন সরকারি ও বেসরকারি কলেজের প্রভাষকদের মাসিক বেতন স্কেল ২২ হাজার টাকা। কিন্তু সংস্কৃত ও পালি শিক্ষকদের বেতন-ভাতার কোনও পরিবর্তন হয়নি।

মাউশি সূত্রে জানা গেছে, এই শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এসব শিক্ষকদের বেতন-কাঠামোর আওতায় আনতে মাউশির মহাপরিচালকের কাছে বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড একটি প্রস্তাব পাঠায়। ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা বোর্ডের সচিব অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী সনাতন পদ্ধতির সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের জাতীয় বেতন স্কেলের আওতায় নিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানান। এর আগেও বিভিন্ন সময় কয়েক দফা শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন স্কেলের আওতায় নিতে প্রস্তাব করা হয়। ওই প্রস্তাবে বলা হয়, জাতীয় বেতন স্কেল নির্ধারণ হওয়ার আগে কলেজের অধ্যক্ষদের পাঁচ হাজার টাকা, অধ্যাপকদের চার হাজার টাকা এবং কর্মচারীদের দুই হাজার টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয় সরকারের কাছে।

এর পর গত বছরের ১০ অক্টোবর মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে একটি বেতন কাঠামো তৈরি করে বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানান। এর প্রায় একবছর পর গত ৭ আগস্ট এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়।

মাউশির পরিচালক অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নানের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রস্তাবিত কাঠামোতে অধ্যক্ষের মাসিক বেতন ধরা হয়েছে ২৯ হাজার টাকা,আর অধ্যাপকদের বেতন ধরা হয়েছে ১৬ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব সালমা জাহান বলেন, ‘আমরা শিক্ষা বোর্ডকে দেশের সংস্কৃত ও পালি কলেজগুলোর কাছে যাবতীয় তথ্য চাইবো। এ তথ্য পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার।’

মাউশির পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমরা দেখবো কলেজগুলোতে স্ট্যান্ডার্ড মান বজায় রাখা হয় কিনা। পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি ঠিক রয়েছে কিনা, সব প্রতিষ্ঠানে ঠিকমতো ছাত্র রয়েছে কিনা। এসব যাচাই করার পর যদি মান ঠিক থাকে, তাহলে বেতন কাঠামো নির্ধারণ করবে সরকার। তবে দীর্ঘ দিনেও এ সমস্যার সমাধান হয়নি। যদিও এটা ঠিক হয়নি। শিক্ষকদের জন্য এটি অসম্মানজক এবং অমানবিক।’

উল্লেখ্য, সারা দেশে এমন কলেজ রয়েছে ২২৭টি। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৬১৪ জন শিক্ষক  ও ২২৭ জন কর্মচারীসহ মোট ৮৪১ জন কর্মরত আছেন।

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্মরণে কাল নাগরিক সভা
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্মরণে কাল নাগরিক সভা
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?