X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

গর্ভকালীন কুসংস্কারকে মায়েদের ‘না’

তাসকিনা ইয়াসমিন
১৩ আগস্ট ২০১৮, ১৬:১৪আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০১৮, ১৭:৪২

সন্তান কোলে মা রোকেয়া লিটা অন্তঃসত্ত্বা নারীরা এখনও বিভিন্ন কুসংস্কারের মুখোমুখি হচ্ছেন। পাড়াপড়শি এমনকি পরিবার থেকেও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ওপরে নানান বাধা-নিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হয়। খাবার, হাঁটাচলা ও চিকিৎসা সবকিছু ঘিরেই রয়েছে এই কুসংস্কার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কুসংস্কারের কারণে অন্তঃসত্ত্বা নারী বেশির ভাগ সময়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন। ফলে মা ও সন্তান উভয়েরই ক্ষতি হয়। তবে আশার কথা, নারীদের মধ্যে যারা একটু সচেতন, তারা এ ধরনের সামাজিক কুসংস্কার ও বাধা নিষেধের বেড়াজাল থেকে দিন দিন বেরিয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছেন। মায়েরা নিজের ও সন্তানের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে কুসংস্কারের বিপক্ষে  অবস্থান নিচ্ছেন।

রাজধানীর লালবাগের বাসিন্দা সারাবান তহুরা (৪৫)।অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কুসংস্কারের শিকার হন তিনি। তার মা এবং শ্বাশুড়ির কাছ থেকেই বেশি বাধা পেতেন তহুরা। যেহেতু তিনি ঢাকায় থাকতেন আর তার মা এবং শ্বাশুড়ি গ্রামে নিজেদের বাড়িতে থাকতেন, তাই তিনি তাদের কথা মেনে চলতেন না। বাংলা ট্রিবিউনকে তহুরা জানান, ‘অনেক পরিবারে অন্তসঃত্ত্বা নারীকে দুধ খেতে নিষেধ করা হয়। আবার বোয়াল, বাইনসহ কালো রংয়ের মাছ খেতে দেয়া না। বলা হয়ে থাকে— এই মাছ খেলে শিশুর মুখ ওই মাছের মতো চিকন আর শরীর মোটা হবে। অনেকে আবার সন্তান গর্ভে আসার পর থেকে ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত মাকে আনারস খেতে দেয় না। আনারস খেলে সন্তান অকালে গর্ভপাত হয়ে যাবে বলে অজুহাত দেওয়া হয়। অনেক পরিবার গর্ভকালীন মায়েদের মাংস খেতেও বারণ করে।

তিনি জানান, সন্তান গর্ভে আসার পর থেকে অনেক মা হাতে লোহার টুকরা বেঁধে রাখেন। অনেকে লোহার কাঁটা  চুলের সঙ্গে সুতা দিয়ে বেঁধে রাখেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, শরীরে লোহা থাকলে পেঁচা-পেঁচি শিশুকে আক্রমণ করতে পারবে না। আবার যখন কোনও শিশু ধনুষ্টঙ্কারে আক্রান্ত হয়, তখন বলা হয়— মাকে চোরাচুন্নিতে ধরেছে। জ্বিন, বিভিন্ন অশরীরি আত্মার (গ্রামে প্রচলিত শব্দ চোরাচুন্নি, পেঁচা-পেঁচি) হাত থেকে সন্তানকে রক্ষা করার জন্য অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে  সন্তান বড় না হওয়া পর্যন্ত মায়েরা সব সময় পাশে লোহা রাখেন।

তিনি বলেন, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সময় অন্তঃসত্ত্বা নারীকে পুরোপুরি চিৎ করে শুইয়ে রাখা হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত এই গ্রহণ চলে মাকে কোনও কিছু খেতে দেওয়া হয় না। বলা হয়, মা নড়াচড়া করলে বা খাবার খেলে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হবে। কোনও সন্তানের মুখে জন্মদাগ থাকলে বলা হয়—  চন্দ্রগ্রহণের সময় মা টের পায়নি, তাই সন্তানের এ অবস্থা। এছাড়া, মাকে সব ধরনের শাক খেতেও বারণ করা হয়। অনেকে সন্তান পেটে থাকা পর্যন্ত মাকে কচু শাক খেতে দেয় না। বলা হয়,কচুর শাকে তেলতেলে ভাব আছে, এটি খেলে সন্তান গর্ভপাত হয়ে যাবে।

মুন্সীগঞ্জের সীমা আক্তারের বয়স এখন পয়ঁত্রিশ বছর।প্রথম সন্তান জন্মের সময় তিনি মীরপুরে স্বামীর সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকতেন। বর্তমানে থাকেন রাজধানীর লালবাগ এলাকায়। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমার বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সে। বিয়ের এক বছরের মাথায় বড় ছেলে পেটে আসে। প্রথম দুই মাসে কিছুই খেতে পারতাম না। পরে খেতে পারলেও বেশি খেতাম না। আমাকে সবাই বলতো— বেশি বেশি খেলে বাচ্চা বড় হবে। যে বাচ্চা পেটের ভেতরে বড় হয়,ভূমিষ্ঠের সে বাচ্চা বড় হলে শুকনা হয়ে যায়। তাই অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের কম খেতে হয়।’

ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক রোকেয়া লিটা সম্প্রতি মা হয়েছেন। নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ডাবের পানি খেলে মনে করা হয়, জন্মের পর সন্তানের চোখ সাদা হবে। সারাদিনে পানি খাওয়ার তো একটা লিমিট থাকে। আমি পানি খেতে পারতাম না। ডাবের পানি খেতে চাইতাম, কিন্তু বাধা পেতাম। বাসা থেকে বাইরে বের হওয়ার সময় শুকনা মরিচ, লোহার টুকরা,ম্যাচের কাঠি এগুলো রাখতে বলা হতো। এটা করলে নাকি জ্বিন পরী আসে না।’

তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বিরক্তিকর ছিল সন্তান জন্মের আগে কাপড়চোপড় বানাতে দেওয়া হয়নি। এমনকি পরিবার থেকে কাঁথাও সেলাই করতে দেয়নি। বলতো যে, আগে সন্তানের জন্ম হোক, বাঁচে কী মরে! আবার জন্মের ৪০ দিন পর নাকি ন্যাপকিনসহ পোশাক-আশাক ফেলে দিতে হয়। আমি ফেলিনি। বলা হয়, ৪০ দিন গেলেই সন্তানের চুল ফেলে দিতে হবে। আমি এটাও করিনি। ওর মাথায় মরা চামড়া জমে গিয়েছিল। আমি চুলটা ছেঁটে দিয়েছি। কিন্তু ন্যাড়া করতে দিইনি। এর জন্যও কথা শুনতে হয়েছে।’

লিটা বলেন, ‘আমার এক বান্ধবী বলেছে’ তাকে মেহেদি লাগাতে দেওয়া হতো না। ফুলের গন্ধ শুকতে দেওয়া হতো না। এগুলো করলে কী ক্ষতি হবে জানি না। তবে আমি এগুলোর কিছুই মেনে চলিনি। কেউ কেউ মনে করেন, যে এটা ওটা খেলে নাকি ত্বক ফর্সা হয়। আমার প্রতিবেশি এক নারী জানতে পেরেছেন যে, তার মেয়ে হবে। তখন থেকে তিনি স্যাফরন দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেতো। এগুলো খেলে নাকি মেয়ের রং ফর্সা হবে। আবার কমলা লেবু, ডালিম এগুলো খেলে নাকি সন্তানের গায়ের রং ফর্সা হয়। আমি বিষয়টা জানতাম যে, এটা জেনেটিক ব্যাপার। তাই এগুলো নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। সন্তান জন্মের পর আমার মাসহ অনেকেই বলেছেন— বাবুর কপালে টিপ দেওয়ার জন্য, আমি কখনও দেইনি। এমনকি ফেসবুকে ছবি আপলোড করি দেখে অনেকেই বলেছেন, ফেসবুকে বাবুর ছবি বেশি বেশি আপলোড করলে তাকে কেউ নজর দিলে, তার নাকি বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে। আমার কথা হচ্ছে— কেউ নজর দিলেই যদি ক্ষতি হয়, তাহলে কত মানুষ কতজনকে নজর দিচ্ছে, সবারই তো অনেক ক্ষতি হওয়ার কথা।’

আজিমপুরের বাসিন্দা সানজিদা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার সন্তানদের জন্মের সময় কালো রংয়ের কোনও খাবার খেতে না করতেন শ্বাশুড়ি। তিনি বলতেন, কালো রংয়ের খাবার খেলে সন্তানের গায়ের রং কালো হবে।’

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)  এর প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাবেরা খাতুন বলেন,  ‘মায়েদের মনে যেসব কুসংস্কার থাকে, সেগুলো আমরা বাদ দিতে বলি। যেমন – বলা হয় বেশি খাবেনা ।আমরা মায়েদের বেশি খেতে বলি। মায়েদের বোঝাই— এইসময় বেশি খাওয়া দরকার, পুষ্টির দরকার। দুধ, ফলমুল, শাকসব্জী বেশি করে খেতে বলি। অন্তঃসত্ত্বা মায়ের যে বিপজ্জনক সাইন আছে, সেগুলো সম্পর্কে মায়েদের সচেতন করি। হাঁটাচলার ক্ষেত্রে আমরা কিছু পরামর্শ দেই। বেশি হাঁটলে পায়ে পানি আসে। তাই কম হাঁটতে বলি। মানসিকভাবে মা ফ্রি থাকবে, ভালো থাকবে।’

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আফরোজা খানম রুমু বলেন, ‘গর্ভাবস্থায় কোনও রকম  কুসংস্কার থাকা যাবে না। কিন্তু আমি যদি এটি বলি কেউ মানবে না। তাই কুসংস্কার দূর করতে শিক্ষার লেভেল পরিবর্তন করতে হবে এবং মানসিকতা বদলাতে হবে। এরজন্য চিকিৎসককে কাউন্সেলিং করতে হবে। রোগীকেও চিকিৎসকের কথা শুনে চলতে হবে।’

বিএসএমএমইউ-এর  প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, ‘কিছু কিছু ডিসপুটেড ফল আছে (আনারস, পেঁপে, কামরাঙা) এগুলো খেলে কারও কারও এলার্জি হতে পারে। যেকোনও এলার্জিক রিয়াকশনেই গর্ভপাত হতে পারে। হয়তো লাখে একজনের ক্ষেত্রে এমনটি হতে পারে। এগুলো আসলে সত্য নয়। কেউ কেউ বলে যে, কলা খেলে সন্তান খুব ফর্সা হবে, কালো জিনিস খেলে কালো হবে, কফি, চা খেলে কালো হবে — এগুলো সব ভুল ধারণা। সন্তান তার মা-বাবার গায়ের রং পাবে। এটা জেনেটিক ফ্যাক্টর। কে কতটুকু লম্বা হবে, গায়ের রং, আচরণ এগুলো মা-বাবার সঙ্গেই মিল থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘কুসংস্কারগুলোর বৈজ্ঞানিক কোনও ব্যাখ্যা নেই। আমরা রোগীদের বলি যে, আশেপাশের মানুষ অনেক কথা বলবে, কিন্তু এগুলোর কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।’

আজিমপুর নগরস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাউন্সেলর হাবিবা সুলতানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘ আমাদের সমাজে এখনও অনেক রকমের কুসংস্কার আছে। বলা হয়— সন্তান পেটে আসার তিন মাসের মধ্যে মাকে কোনও ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। ওষুধ খাওয়ালে পেটের শিশু বড় হয়ে যাবে। আবার হাসপাতালে গেলেই পেট কেটে ফেলবে (সিজারিয়ান)।অন্তসঃসত্ত্বা মায়েদের আনারস ও পেঁপে খেতে নিষেধ করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা রোগীদের সব ধরনের কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকার জন্য বলি। আমরা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মায়েদের সব ধরনের খাবার খেতে বলি। বেশি বেশি খাবার খেতে বলি। তিন বেলার জায়গায় মাকে চারবেলা খেতে বলি। আয়রন, ভিটামিন জাতীয় সব ধরনের খাবার খেতে বলি। মায়েদের বোঝাই যে, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়  পুষ্টিকর উপাদান ঠিকমতো খেলে মায়ের গর্ভে সন্তান ঠিকমতো বেড়ে উঠবে।’

হাবিবা সুলতানা  বলেন, ‘এখন সিজারিয়ানের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মায়েরা মনে করেন যে, হাসপাতালে যাওয়া মানেই সিজারিয়ান। আমরা এই বিষয়টা মায়েদের কাউন্সেলিং করি। ডেলিভারি মানেই সিজার না। আমরা ৯০ ভাগই চেষ্টা করি স্বাভাবিক ডেলিভারি করার জন্য। মাকে নিয়মিত খাবার খেতে বলি। ঘরের কাজগুলো ঠিকমতো করতে বলি এবং বলি যে, গর্ভের সন্তানের পজিশন ঠিক থাকলে আর সিজারিয়ান করতে হবে না।’

 

/টিওয়াই/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী