X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

হোটেল ওলিওতে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ: হামলার নির্দেশনা আসে টেলিগ্রাম চ্যানেলে

নুরুজ্জামান লাবু
১৪ আগস্ট ২০১৮, ২৩:০৮আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০১৮, ২১:১১

হোটেল ওলিওতে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের পর জাতীয় শোক দিবসে পান্থপথের ওলিও ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে বিস্ফোরণের ঘটনার একবছর পূর্ণ হচ্ছে ১৫ আগস্ট। এ ঘটনার আগেই নব্য জেএমবির এক আত্মঘাতী সদস্য বোমা নিয়ে পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের একটি কক্ষে উঠেছিল। হোটেল ওলিওতে হামলার জন্য জঙ্গিরা সক্রিয় ছিল ডার্কওয়েবে। হামলার নির্দেশনা আসে জঙ্গিদের নিজস্ব টেলিগ্রাম চ্যানেলে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে সেই বোমা বিস্ফোরণের। কিন্তু তার আগেই পুলিশের অভিযানে হোটেল কক্ষেই সেই বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মারা যায় সে। একবছর পূর্ণ হতে চলা সেই মামলার তদন্তের অগ্রগতি কী? কারা, কেন ও কী উদ্দেশ্যে এই হামলার পরিকল্পনা করেছিল?

জানতে চাইলে এই মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, মামলার তদন্ত প্রায় শেষপর্যায়ে। এই হামলার সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে যারা জড়িত ছিল, প্রধান পরিকল্পনাকারীসহ তাদের প্রায় সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে দশ জন ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এখন এই মামলার অভিযোগপত্র তৈরির কাজ করছেন। শিগগিরই আদালতে জমা দিয়ে দেবেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া মঙ্গলবার (১৪ আগস্ট) সকালে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এই মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে এই ঘটনায় ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরমধ্যে ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের পরিকল্পনা ছিল ৩২ নম্বরে হামলা করে আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের ফোকাস করা। আমরা তা নস্যাৎ করতে পেরেছি। দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিচার শেষে সর্বোচ্চ সাজা হবে এই প্রত্যাশা করছি।’
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সূত্র জানায়, নব্য জেএমবির সর্বশেষ আমির আকরাম হোসেন নিলয় ছিল এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। তার পরিকল্পনায় সাইফুল ইসলাম নামে এক আত্মঘাতী জঙ্গি সদস্য হোটেল ওলিতে অবস্থান করে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। সাইফুলের পরিকল্পনা ছিল যেকোনও উপায়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কাছাকাছি গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো। ঘটনার একদিন আগে মামুন নামে এক জঙ্গি সদস্য উত্তরার আব্দুল্লাহপুর এলাকায় বোমাসহ একটি ব্যাগ সাইফুলের কাছে পৌঁছে দেয়। ওই বোমা নিয়ে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে অবস্থান করে সাইফুল। কিন্তু পুলিশের অভিযানের কারণে নিজের বোমা নিজেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হয় সে।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, শোক দিবসের হামলার মূল পরিকল্পনা করেছিল আকরাম হোসেন নিলয়। এই বছরের ২১ মার্চ বগুড়ায় থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর বিভিন্ন অভিযানে শীর্ষ জঙ্গি নেতারা নিহত হলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া নিলয় নব্য জেএমবির হাল ধরে। এরপর নতুন করে আবার আলোচনায় আসার জন্যই মূলত সে শোক দিবসের হামলার পরিকল্পনা করেছিল। সে নিজেই আত্মঘাতী সদস্য সাইফুলকে নির্বাচন করে হামলার জন্য। অবশ্য সাইফুলও আত্মঘাতী হামলায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল বলে জানিয়েছেন সিটিটিসির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। নিলয়কে গ্রেফতারের পর হামলার পরিকল্পনার পুরো এই চিত্র পাওয়া যায় টেলিগ্রাম অ্যাপসে জঙ্গিদের নিজস্ব চ্যানেলে। টেলিগ্রাম চ্যানেলের মাধ্যমেই নিলয়ের কাছে হামলার নির্দেশনা আসে। ডার্কওয়েবে সক্রিয় থাকা জঙ্গিরা টেলিগ্রাম চ্যানেলের সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে।
সিটিটিসি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর পুলিশের জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম জোরদার হয়। ধারাবাহিক অভিযানে কোনঠাসা নব্য জেএমবি আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বড় হামলার প্রস্তুতি নেয়। এজন্য তারা ১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবসকে বেছে নিয়েছিল। তাদের টার্গেট ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন শ্রদ্ধা জানাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যাবেন, ওই সময় বিস্ফোরণ ঘটানো। শেখ হাসিনার কাছাকাছি পৌঁছাতে না পারলে মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের কাছাকাছি গিয়ে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সাইফুলকে। যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ভিআইপি অর্থাৎ মন্ত্রী-এমপিসহ অনেক লোককে হত্যা করা যায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জঙ্গিদের ধারণা ছিল, নেতাকর্মীদের ভিড়ের কারণে বিস্ফোরণের পর হুড়োহুড়ি বা পায়ের তলায় পিষ্ট হয়েও কিছু লোক মারা যাবে। সাফল্যের সঙ্গে এটি সম্পন্ন করতে পারলে তাদের নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শনের পাশাপাশি জঙ্গি দলে আরও বেশি লোকজনকে রিক্রুট করা সম্ভব হতো।
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এই মামলার তদন্ত অনেকটাই গুছিয়ে এনেছি। হামলায় যারা বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ছিল, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। শিগগিরই আদালতে জমা দেওয়া হবে।’ সিটিটিসির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘জঙ্গিরা কী উদ্দেশ্যে হামলার জন্য শোক দিবসকে বেছে নিয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য ও এর কারণও জানা গেছে। যারা এই হামলার জন্য অর্থ সরবরাহ করেছিল, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নিলয়ের পুরো পরিকল্পনার বিষয়টি তার বাবা, মা ও বোন সবাই জানতো। নিলয় ভারতে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তার নির্দেশনায় তার বাবা আবু তোরাব, মা সাদিয়া হোসনা লাকি ও বোন তাজরীন খানম শুভ্র হামলার জন্য অর্থ সরবরাহসহ অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করেছে। নিলয়ের জঙ্গিবাদী কাজে মদদ দেওয়া, অর্থের জোগান দেওয়া এবং শোক দিবসে হামলার পরিকল্পনার কথা জেনেও পুলিশকে না জানানোর অভিযোগে গত বছরের ১১ নভেম্বর গুলশান এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া, অর্থ সরবরাহকারী হিসেবে নিলয়ের বন্ধু তানভির ইয়াসিন করিমকে গত বছরের ২০ নভেম্বর ও তার স্ত্রী হুমায়ারা ওরফে নাবিলাকে এই বছরের ৫ এপ্রিল গ্রেফতার করা হয়। তানভীর নব্য জেএমবিকে নতুন করে সংগঠিত করতে নিলয়কে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিল বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
সিটিটিসির এককজন কর্মকর্তা বলেন, নব্য জেএমবির সর্বশেস আমির নিলয়ের সহযোগী, যারা পান্থপথের ওই বিস্ফোরণের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত, তাদেরও বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই হামলায় মোট ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শোক দিবসে হামলার জন্য যে বোমাটি আনা হয়েছিল, সেটি তৈরি করেছিল নব্য জেএমবির বোমা তৈরির কারিগর মামুন। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর উত্তরা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। মামুনকে বোমা তৈরির উপকরণ সরবরাহ এবং আশ্রয় দিয়েছিল আইচান কবিরাজ ওরফে রফিক এবং লুলু সরদার নামে দুই জঙ্গি। গত বছরের ১৬ নভেম্বর নওগাঁ থেকে আইচান কবিরাজ ও লুলু সর্দারসহ পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছিল স্থানীয় পুলিশ। মামুনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আইচান কবিরাজ ও লুলু সর্দারকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এছাড়া, গত বছরের ২২ অক্টোবর শেরপুরের নকলা থেকে আবুল কাশেম ওরফে আবু মুসাব নামে আরেক জঙ্গিকে স্থানীয় থানা পুলিশ গ্রেফতার করে। ওই বছরেরই ৫ অক্টোবর নকলার চন্দ্রকোণা বাজার থেকে ১৮ ড্রাম তরল কেমিক্যাল উদ্ধার করেছিল পুলিশ, যা মামুনের নির্দেশনায় আবু মুসবা ঘর ভাড়া করে রেখে দিয়েছিল।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই হামলার বোমা তৈরির কারিগর মামুনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ কামরুল ইসলাম ওরফে শাকিল ওরফে রোবট ওরফে তানজীম ওরফে হারিকেনকে দুই সহযোগীসহ এই বছরের ২৭ এপ্রিল ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়ক এলাকা থেকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। পরে শাকিল ওরফে হারিকেনকে পান্থপথের ওলিও হোটেলে বিস্ফোরণ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এছাড়া চলতি বছরের ১৬ মার্চ মোহাম্মদ তাজুল ওরফে ছোটন নামে এক জঙ্গিকে ১৬ মার্চ গ্রেফতার করা হয়। এর বাইরে সিটিটিসির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা নও মুসলিম আব্দুল্লাহ এবং আদনান নামে দুই জঙ্গিকে এই মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়েছেন।
সিটিটিসির ওই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতার হওয়া ১৪ জনের মধ্যে মামুন, তানভীর, আইচান কবিরাজ, ছোটন, আবু মুসাব, সাদিয়া হোসনা লাকি, তাজরীন খানম শুভ্র, আদনান, নও মুসলিম আব্দুল্লাহ, শাকিল ওরফে হারিকেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বাকি চার জন আকরাম হোসেন নিলয়, হুমায়ারা ওরফে নাবিলা, আবু তোরাব ও লুলু সর্দার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়নি। এর মধ্যে হুমায়ারা ওরফে নাবিলা বর্তমানে জামিন নিয়ে কারাগারের বাইরে রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট সকালে হামলার আগেই সিটিটিসি’র অভিযানে পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের একটি কক্ষে নিজেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হয় জঙ্গি সাইফুল। ওই ঘটনায় রাজধানীর কলাবাগান থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে। ঘটনার দিন ১৫ আগস্ট সকালে রাজধানীর পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে আত্মঘাতী এক জঙ্গি অবস্থান করছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে হোটেলটি ঘেরাও করে রাখে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সিটিটিসি। পরে সিটিটিসি’র সোয়াট টিমের সদস্যরা অভিযান চালাতে গেলে আত্মঘাতী জঙ্গি দলের সদস্য সাইফুল ইসলাম নিজের কাছে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। সিটিটিসি তাদের এই অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন আগস্ট বাইট’।

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইসরায়েলি হামলায় হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতার মৃত্যু: যুক্তরাষ্ট্র
ইসরায়েলি হামলায় হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতার মৃত্যু: যুক্তরাষ্ট্র
ম্যারেজ কাউন্সেলিং সম্পর্কে যা কিছু জানা জরুরি
ম্যারেজ কাউন্সেলিং সম্পর্কে যা কিছু জানা জরুরি
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
সর্বাধিক পঠিত
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
পদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
একীভূত হলো দুই ব্যাংকপদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই