X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘মুক্তিযোদ্ধা’ কোটা নিয়ে আদালতের নির্দেশনায় যা বলা আছে

বাহাউদ্দিন ইমরান
১৫ আগস্ট ২০১৮, ২২:৩৬আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০১৮, ১২:৩৬

‘মুক্তিযোদ্ধা’ কোটা নিয়ে আদালতের নির্দেশনায় যা বলা আছে আন্দোলনের মুখে কোটা সংস্কার না করে তা পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু  আদালতের রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণ দেখিয়ে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত (৩০ শতাংশ) কোটা বাতিল সম্ভব নয় বলে সরকারের পরবর্তী সিদ্ধান্তে জানানো হয়। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সংরক্ষণে আদালতও কোনও রায় দেননি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কোটা নিয়ে আদালত যা বলেছিলেন, তা ছিল শুধুই ‘পর্যবেক্ষণ’। এসব ‘পর্যবেক্ষণ’ মেনে চলার ক্ষেত্রে সরকারের ওপর কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।     

এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের রায় পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০০৯ সালে সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ৫৯ বছর করার আদেশ জারি করে। এরপর ২০১১ সালে সাধারণ চাকরিজীবীদের চাকরির মেয়াদও দুই বছর বাড়িয়ে সমতা আনা হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা বিষয়টির অসম্মতি জানিয়ে অবসরের বয়স বাড়াতে ২০১২ সালে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। মুক্তিযোদ্ধা সরকারি চাকরিজীবীদের পক্ষে বিসিএস খাদ্য বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক মো. জামাল উদ্দিন সিকদার ওই রিট দায়ের করেন। রিট শুনানি শেষে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের অবসরের বয়স সাধারণ কর্মকর্তাদের চেয়ে একবছর বাড়িয়ে ৬০ বছর নির্ধারণের নির্দেশ দেন আদালত।

একইসঙ্গে হাইকোর্ট তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। কোনও ক্ষেত্রে যদি কোটা পূরণ করা না হয় তবে সংশ্লিষ্ট পদ শূন্য রাখতে হবে।’ পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করলে হাইকোর্টের আদেশের বেশ কিছু অংশ বাদ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ। ওই রায়ে কোটা সংক্রান্ত হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ থেকে ‘কোনও ক্ষেত্রে যদি কোটা পূরণ করা না হয় তবে সংশ্লিষ্ট পদ শূন্য রাখতে হবে’ অংশটি বাদ দেওয়া হয়। এছাড়া, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের বিরোধিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও পরিবহন সুবিধা দিতে বলা হাইকোর্টের অংশটিও বাদ দেন আপিল আদালত।

তবে রায়টি এখনও বাস্তবায়িত না হওয়ায় ২০১৩ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদারসহ আট জন সরকারি কর্মকর্তার নামে আদালত অবমাননার মামলা করা হয় বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান রিটকারী জামাল উদ্দিন সিকদার। তিনি বলেন, ‘আদালত অবমাননার মামলাটি এখনও হাইকোর্টে বিচারাধীন।’

জামাল উদ্দিন সিকদার আরও বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি রিটের মাধ্যমে হাইকোর্টে তুলে ধরেছিলাম। সরকার সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলেও তা পুরোপুরিভাবে প্রতিপালন করে না। তখন আদালত আমাদের সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া নিয়ে প্রমাণ দেখাতে বলেন। আমরা তখন কোটা নিয়ে শফিকুল ইসলাম গাজীর মামলার রায় (৪৬০৬/২০১০) আদালতে পেশ করি। ওই মামলায় শফিকুল ইসলাম গাজী খাদ্য অধিদফতরের বিরুদ্ধে রিট করে কোটা মান্য না করার অভিযোগ তুলেছিলেন। এছাড়া কোটা না মানায় হাইকোর্টের আরও কয়েকটি রিটের ও রায়ের নজির আমরা আদালতকে দেখাই। যার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট আমাদের রিটের রায়ে বলেন, কোটার আদেশ যথাযথভাবে মান্য করতে হবে এবং কোটা পূর্ণ না হলে মেধা তালিকা থেকে আসন পূর্ণ করতে হবে।’

রিটকারী জামাল উদ্দিন সিকদারের রিটের আদেশ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই রিটের রায়ে কোটা রাখার বা বাতিলের বিষয়ে আদালত কিছু বলেননি। এছাড়া কোটা রাখা বা না রাখার বিষয়ে সাংবিধানিক কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তাই সরকার যদি কোটা সংস্কার বা বাতিল ঘোষণা করে, তবে তা আদালতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না। তারপরও যদি কেউ সরকারের সিদ্ধান্তের (সংস্কার বা বাতিল) বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হন, তবে আদালতের আশ্রয় নিতে পারবেন।’

প্রসঙ্গত, দেশে সংবিধান প্রবর্তনের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে কোটা সংরক্ষণের বিষয়ে একটি আদেশ দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সংস্থাপন বিভাগের সচিব এম এম জামানের স্বাক্ষরে ওই আদেশ (ইডি/আরআই/আর-৭৩/৭২-১০৯(৫০০) জারি করা হয়। স্বাধীনতার পর দেশের সব অঞ্চলের জনগণকে সরকারি চাকরিতে অনুপ্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি এবং সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ওই আদেশ জারি করা হয়। তাই সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে জেলাভিত্তিক কোটা ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবদান ও ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা করে তাদের জনজীবনে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৩০ শতাংশ কোটা দিয়ে চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়।

কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই আদেশ কেউ চ্যালেঞ্জ (আদেশটির বৈধতা প্রশ্নে) করেননি। তাই কোটা সুবিধা এখনও বহাল রয়েছে। ১৯৭২ সালের ওই আদেশের কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটাসহ অন্যান্য কোটা বাতিল করা সম্ভব নয় বলেও মনে করেন জামাল উদ্দিন সিকদার। তিনি বলেন, ‘১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বরের আদেশের পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংবিধান গৃহীত হয় এবং সংবিধানে বলা হয়, এই সংবিধান প্রণয়নের আগে যত আইন বা আদেশ সরকার জারি করেছিল, তা যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, তবে তা বহাল থাকবে। এ কারণেই কোটা বাতিল সম্ভব নয়।’

এদিকে, চলতি বছরের ৫ মার্চ কোটা প্রথার সংস্কার চেয়ে করা এক রিট আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। দু’জন সাংবাদিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী এ রিটটি দায়ের করেছিলেন। কিন্তু রিটকারীরা সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় তাদের রিট আবেদনটি সরাসরি খারিজ করেন দেন বলে আদালত তার আদেশে উল্লেখ করেন। আদালত আরও বলেন, ‘কোটা রাখা বা সংরক্ষণ করাটা সরকারের পলিসির মধ্যে পড়ে।’

এরপর হাইকোর্টের এ খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন রিটকারী আইনজীবী এখলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এর আগের দু’টি রায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা প্রসঙ্গে কিছু পর্যবেক্ষণ এসেছে। কিন্তু সেসব পর্যবেক্ষণ মানার ক্ষেত্রে সরকারের ওপর কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। ‘পর্যবেক্ষণ’ হলো একটি রায়ের অংশমাত্র। এটি কোনও আদেশ নয়। তাই আমার রিটে পুরো কোটা পদ্ধতি সংস্কার করতে আদালতের নির্দেশনা চেয়েছি। হাইকোর্টের খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছি। আপিলের নথি-পত্রের সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও ভারতে কোটা সংস্কারের বিষয়টিও আপিল আদালতে জমা দিয়েছি। সে আবেদনটি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে।’

 

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মোংলার তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সহসা নামবে না বৃষ্টি
মোংলার তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সহসা নামবে না বৃষ্টি
‘আমি কোনও ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারি না’
‘আমি কোনও ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারি না’
তাপদাহে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের গাউন পরিধানে শিথিলতা
তাপদাহে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের গাউন পরিধানে শিথিলতা
সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা
সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া