X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

৩২ ধারাতেও হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের আশঙ্কা

নুরুজ্জামান লাবু
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২৩:৩৮আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২৩:৪৩

 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে (আইসিটি অ্যাক্ট) দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বেশিরভাগই ছিল ৫৭ ধারার। সাংবাদিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনীতিবিদ বা অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট অনেকেই এই ৫৭ ধারায় মামলার শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি বহুল আলোচিত ও সমালোচিত এই ধারা বাতিল হয়েছে ঠিকই,তবে শঙ্কা রয়েছে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা নিয়েও। মানবাধিকারকর্মীরা ৫৭ ধারা ও ৩২ ধারাকে ‘মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’ আখ্যায়িত করেছেন। আর ভুক্তভোগীরা বলছেন, আগের মতো হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের সুযোগ থেকেই গেলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইসিটি অ্যাক্টে দায়ের হওয়া ৫৭ ধারার বেশির ভাগ মামলা হয়রানির উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। বিশেষ করে সরকারের বিপক্ষে যায় এমন বক্তব্য কেউ দিলেই তার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়েছে। অসাধু রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা এই ধারার অপব্যবহার করেছেন বেশি। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও ৫৭ ধারায় মামলা দিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে।
সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন বা স্কুল শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনেও বিতর্কিত এই ধারার অপব্যবহার করা হয়েছে বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছর আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারায় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ৭৬টি মামলা মামলা দায়ের হয়েছিল। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬২। মামলাগুলোর বেশির ভাগ এখনও তদন্তাধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাইবার আইনে মোট একহাজার ৫০টি মামলা বিচারের জন্য নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৩টি, ২০১৪ সালে ৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি, ২০১৭ সালে ৫৬৮টি এবং চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৩০টি মামলা বিচারের জন্য নথিভুক্ত হয়েছে।
সাইবার ক্রাইম ট্রাইবুন্যালের প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম জানান, মোট মামলার প্রায় ৮০ ভাগই হলো আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার মামলা। তিনি বলেন, ‘৫৭ ধারার অনেক মামলা আদালতে প্রমাণে বেগ পেতে হয়। কারণ মামলা দায়েরের পর আসামি তার ফেসবুক পেজ থেকে আলামত সরিয়ে ফেলে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে মামলা দায়ের হওয়ার পর সাক্ষী পাওয়া যায় না। এজন্য আসামিদের অনেকেই খালাস পেয়ে যায়।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট সূত্র জানায়, রাজধানীতে এ বছর আইসিটি অ্যাক্টের ৮৫টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কাছে। এর বাইরে থানা পুলিশও অল্প কয়েকটি মামলার তদন্ত করছে। সাইবার ক্রাইম ইউনিটের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আইসিটি অ্যাক্টের মামলাগুলোর বেশিরভাগই ৫৭ ধারার।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আইসিটি অ্যাক্টে দায়ের হওয়া মামলাগুলো সাধারণত ডিএমপির বিশেষায়িত ইউনিট সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা তদন্ত করে থাকেন। এসব মামলায় ফরেনসিক পরীক্ষার ওপর অনেকটা নির্ভর করতে হয়। আমরা যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আইসিটি অ্যাক্টের মামলগুলো তদন্ত করে থাকি।’
একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক মোরসালিন বাবলার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় তিনটি মামলা হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। সংবাদ প্রকাশের জের ধরে তার বিরুদ্ধে স্থানীয় যুবলগী নেতা ও জেলা জজ আদালতের সরকারী কৌঁসুলি মামলাগুলো দায়ের করেন। তবে তিনটি মামলার মধ্যে একটির চার্জ গঠনের পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে তা স্থগিত হয়ে আছে। একটি মামলার বাদী নিজেই মামলা না চালানোর জন্য আদালতে আবেদন করেছেন। আরেকটি মামলা পুলিশ সদর দফতরের মতামতের জন্য পাঠিয়েছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ।
মোরসালিন বাবলা বলেন, ‘আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো বেশিরভাগই হয়রানির উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অনিয়ম ও অনৈতিক বিষয়গুলো তুলে ধরলেই তারা ৫৭ ধারায় মামলা করে। ৫৭ ধারা কতিপয় অসাধু লোকজনের জন্য রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘বিতর্কিত এই ধারা বাতিলের জন্য সমাজের নানা শ্রেণিপেশার লোকজন আন্দোলন করে আসছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকেই সেই ধারা বাতিল করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নতুন আইনে ৫৭ ধারার বিষয়গুলো ভিন্নভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেটা কোনওভাবেই কাম্য ছিল না।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা রাশেদ খাঁনের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার অভিযোগে আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারায় মামলা করেছিলেন এক ছাত্রলীগ নেতা। ওই মামলায় গ্রেফতার হয়ে রিমান্ড শেষে মোট ৫১ দিন কারাগারে ছিলেন রাশেদ। রাশেদ বলেন, ‘ফেসবুকে আমি একটা লাইভ করেছিলাম। সেই লাইভের জের ধরে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়। কিন্তু মামলায় প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার যে অভিযোগ, তদন্তকারীরা তা পাননি। সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমার ভিডিও এডিট করে আমাকে হয়রানি করার জন্য মামলা দেওয়া হয়েছিল।’ এই মিথ্যা মামলায় তাকে এখনও হাজিরা দিতে আদালতে দৌড়াতে হচ্ছে।
২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় সাংবাদিক প্রবীর শিকদারের বিরুদ্ধে আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। তাকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।
প্রবীর শিকদার বলেন, ‘৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ করে আমার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছিল। সেই মামলা এখনও চলছে। গত ছয়-সাতটি শুনানিতে বাদী পক্ষ কোনও সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। কিন্তু আমাকে নিয়মিত আদালতে দৌড়াতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘৫৭ ধারা দিয়ে নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছিল। মানুষের ভেতরে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। এখন ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আতঙ্কটা রয়ে গেছে। নতুন আইনে ৫৭ ধারার উপাদানগুলো রয়েছে। শুধু সাজাটা কমানো হয়েছে। আবার হয়রানিকারীকে দায়মুক্তি দিয়ে হয়রানি করার দরজাটা অবারিত করে রাখা হয়েছে।’
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, “নুতন আইনের ৩২ ধারাসহ আরও দুই-তিনটি ধারায় ৫৭ ধারার উপাদানগুলি রয়েছে। আরো বড় বিষয় হচ্ছে অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। এটা ভয়াবহ একটা ঘটনা। একেবারে স্পষ্ট করে বললে বলতে হবে যে ‘পুরনো বোতলে নতুন মদ’ বা ‘যেই লাউ সেই কদু’ বা ‘মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’ বলতে পারেন। আসলে ৫৭ ধারায় যা ছিল, নতুন আইনে তা আরও ভয়াবহ আকারে এবং মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করে দিলো।”
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক এই নির্বাহী পরিচালক ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সমালোচনা করে বলেন, ‘এটার কারণে যে বিষয়গুলো দাঁড়াবে তা হলো একদিকে স্বাধীন সংবাদপত্রের ওপর হস্তক্ষেপ হবে। আর দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো তড়িঘড়ি করে এই আইনটি পাস করার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কারণ তাদের ধারণা, নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনটি পাস করা হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের গত কয়েকটি নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে তার তথ্য এবং দালিলিক প্রমাণ সোশ্যাল মিডিয়াতেই বেশি এসেছে এবং দেখা গেছে সংবাদমাধ্যমমগুলো কখনও কখনও সেসবের সহযোগিতা নিয়েছে। সেই পথগুলোই রুদ্ধ হয়ে গেলো।’
৫৭ ধারার মামলাগুলোর কী হবে
বহু আলোচনা-সমালোচনার পরও সম্প্রতি জিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পাস হয়েছে। এই আইন পাসের পরপরই আইসিটি অ্যাক্টের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ৫৭ ধারায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর কী হবে?
ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘৫৭ ধারার মামলাগুলো আগের মতোই চলবে। বিলুপ্ত হওয়ার কারণে নতুন করে মামলায় ৫৭ ধারা যোগ হবে না। কিন্তু আগে দায়ের হওয়া মামলাগুলো আগের আইন মোতাবেক চলবে।’
তিনি জানান, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ৬২ ধারায় বলা হয়েছে, আইনটি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বিলুপ্তি হবে। এছাড়াও ওই আইনের ৫৪,৫৫,৫৬ ও ৬৬ ধারাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে এই ধারাগুলোর অধীনে সাইবার ট্রাইবুন্যালে কোনও কার্যধারা বা মামলা যেকোনও পর্যায়ে বিচারাধীন থাকলে মামলাগুলো এমনভাবে চলমান থাকবে যেন ধারাগুলো বিলুপ্ত হয়নি।’

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যে কারণে ১৫ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান ছাড়তে উৎসাহী হবে
যে কারণে ১৫ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান ছাড়তে উৎসাহী হবে
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন দিবস পালিত হলো কলকাতায়
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন দিবস পালিত হলো কলকাতায়
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বেতন স্কেল ৯৩০০-২২৪৯০ টাকা
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বেতন স্কেল ৯৩০০-২২৪৯০ টাকা
মিয়ানমারে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত শহরে কোণঠাসা জান্তা
মিয়ানমারে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত শহরে কোণঠাসা জান্তা
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
তৃতীয় ধাপে যেসব উপজেলায় ভোট
তৃতীয় ধাপে যেসব উপজেলায় ভোট