নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে গ্রেফতার হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থী। কারামুক্ত হওয়ার পর এখনও তারাসহ পরিবার সদস্যরা রয়েছেন আতঙ্কে। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে খোলামেলা কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছেন কারাগারে তাদের অভিজ্ঞতার কথা। সেই কথোপকথনের ভিত্তিতে তিন পর্বের প্রতিবেদন ১২ দিনের কারাবাস । আজ পড়ুন প্রথম পর্ব।
‘পুলিশের বুটের আওয়াজ শুনলেই শুরু হতো আতঙ্ক। রাতে আমাদের স্বজনদের দেওয়া খাবার খেয়ে আমরা সবাই প্রস্তুত ছিলাম। ধারণা ছিল ১২টার পর হয়তো আমাদের ডাকা হতে পারে। রিমান্ডে নিয়ে আমাদের মারধর করা হবে। এই আতঙ্ক নিয়েই প্রথম রাত কেটে যায়। অপেক্ষা করতে করতে শুয়ে বসে থেকেই কে কখন ঘুমিয়েছি টের পাইনি। ঘুম ভাঙে সকালে।’
নিরাপদ সড়কের দাবিতে রিমান্ডে নেওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থীর একজনের মন্তব্য এটা। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘রিমান্ডের নেওয়ার কথা বলে প্রথম রাতটা এভাবেই পার করে দেয় পুলিশ। জেলখানার কক্ষে বসেই আমরা আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠি। কিন্তু, তারা আসেনি। ওই রাতে আসলে কিছুই ঘটেনি।’
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন থানায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতারের পর গত ৭ আগস্ট তাদের দুইদিনের রিমান্ডে নেয় বাড্ডা থানা পুলিশ। ২২ জন আটক হওয়ার পর এক থানা থেকে অন্য থানায় হস্তান্তর, মামলা দায়ের, প্রিজন ভ্যানে আদালতে হাজিরা, রিমান্ডে থাকা দুইদিন ও বাকি ১২ দিনের কারাজীবন কেমন ছিল, তা নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছেন গ্রেফতার হওয়া একাধিক শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে তাদের অভিজ্ঞতা, আতঙ্ক ও কষ্টের কথাগুলো।
রিমান্ডের প্রথম রাতের কথা দিয়েই শুরু করেছিলেন প্রথমজন। কিন্তু, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর শিক্ষার্থীর ক্ষোভ ও অভিমান আরও গোড়ায়—‘আমাদের যে ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের কেউ আন্দোলনে ছিলাম না। আমাদের কাউকে ভার্সিটির সামনে থেকে, কাউকে বাসায় ফেরার সময় রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। কোনও অপরাধ না করেও আমরা কারাভোগ করেছি।’
সেই ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বললেন সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইকতিদার হোসেন। তার ভাষ্য,‘‘৬ তারিখ (৬ আগস্ট) আমাদের ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। বনানী ক্যাম্পাসের গেটের সামনে স্যাররাও দাঁড়ানো ছিলেন। আমরা রাস্তার সামনে দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলাম। পাশে একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়ানো ছিল। আমাদেরকে গাড়ি থেকে পুলিশের এক কর্মকর্তা ডাক দেন। আমরা কিছু মনে করিনি। কারণ, আমরা কোনোভাবেই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। ফলে আমরা এগিয়ে যাই। এগিয়ে যাওয়ার পর আইডি কার্ড দেখতে চায় পুলিশ। আইডি কার্ড দেখার পর আমাদের বলে ‘গাড়িতে ওঠ্’। আমাদের গাড়িতে উঠতে বলার সময় ভার্সিটির সামনে থাকা স্যারদের হাত নেড়ে ইশারা করছি। স্যাররা গাড়ির কাছে আসার পর পুলিশ বললো, ‘আপনারা ওসি স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।’ এই বলে দুই এক মিনিটের মধ্যে আমাদের বনানী থানায় নিয়ে যায়। ওইদিন রাত ১২টার দিকে বনানী থানা থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় বাড্ডা থানায়। ওখানে আরও ৯ জন। টোটাল ( মোট) আমরা ১৪ জন।’’
থানায় সন্তান, বাইরে অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা
বিভিন্ন থানায় শিক্ষার্থীরা আটক হওয়ার পর তাদের সঙ্গে কথা বলার কোনও সুযোগ পাননি অভিভাবকরা। দুপুরে ও বিকেলে তাদের আটক করা হলেও অধিকাংশ অভিভাবক সে খবর পান সন্ধ্যার পর। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে থানার বাইরে বাড়ে অভিভাবকদের উপস্থিতি। আশায় থাকেন, ছেলের মুক্তির জন্য। মধ্যরাতে বিভিন্ন থানা থেকে আটক শিক্ষার্থীদের বাড্ডা থানায় নিয়ে আসার পর অভিভাবকরা সবাই চলে আসেন বাড্ডা থানার সামনে।
থানার সামনে অপেক্ষায় থাকা সেই সময়ে কথা স্মরণ করে একজন অভিভাবক বলেন, ‘আমার ভাইয়ের ছেলেকে আটকের খবর পাই সন্ধ্যার পর। প্রথমে বনানী থানা, পরে বাড্ডা থানায় আসি। ওদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাইনি। এমনকি পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের সাক্ষাৎ চেয়েও আমরা সেই সুযোগ পাইনি। তবে ছেলেদের জন্য খাবার পাঠাতে পেরেছিলাম। আমার মতো অনেক অভিভাবক থানার সামনে ছিলেন।’
রিমান্ডে দুইদিন
প্রথম দিন থানা হাজতে কাটানোর পর পরদিন ৭ আগস্ট আদালতে হাজির করা হয় ২২ শিক্ষার্থীকে। আদালত পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এই দুইদিন আতঙ্কে কেটেছে বলে দাবি করেন রিমান্ডে থাকা শিক্ষার্থীরা। তাদের কয়েকজন বলেন, ‘আমরা শুনেছিলাম রিমান্ডে মারধর করা হয়। প্রথমদিন রিমান্ড নিয়ে আমাদের আতঙ্ক ছিল অনেক। কারণ, আমরা কেউই এসব বিষয়ে পরিচিত ছিলাম না। আমাদের একটা ধারণা ছিল যে রিমান্ডে নিয়ে আসার পর অনেক মারধর করা হয়। আমাদেরও হয়তো তাই করা হবে। রাত বাড়লে হয়তো মারবে এই ভয়ে আমরা ছিলাম আতঙ্কিত। এছাড়া আদালতে যখন ছিলাম তখন একজন উকিল বলেছিলেন, রিমান্ডে পুলিশ যা বলে তা যেন স্বীকার করে নেই। এতে নাকি মারধর কম করা হয়। তবে রিমান্ডে আনা হলেও এদিন আমাদের মারধর দূরে থাক কোনও কিছু জিজ্ঞাসাই করা হয়নি।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, ‘পরদিন ৮ আগস্ট ছিল রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন। তবে রিমান্ড চললেও এদিন পরিবারের সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যাররা এসে দেখা করেছেন আমাদের সঙ্গে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই বলেছিলেন, পুলিশ হয়তো পোলাইটলি কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। তোমরা যা জানো তা বলো। তখন আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। কারণ, বড়ভাইরা যেহেতু বলে গেছেন, তার মানে আজকের রাতে কিছু একটা হবে।’
এরপরের ঘটনা বলেন আরেকজন। ‘রাত ১০টার দিকে ইস্ট ওয়েস্টের যে সাতজন ছিল তাদের ডেকে নিয়ে গেল। তাদের দু’জন দু’জন করে নিয়ে যায়। কিছু ছবি দেখিয়ে জানতে চাওয়া হয়, ওদের চিনি কিনা? ওরা চলে আসে কিন্তু আমাদের আর ডাকে না। আমরা অপেক্ষায় বসে থাকি। এরই মধ্যে মধ্যরাতে বলা হয়, সকাল বেলা রেডি থাকতে। আরও বলা হয়,কারও সঙ্গে কিছু থাকলে সেগুলো নিয়ে যেতে। তারপর আমরা যে কে কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি।
প্রথমজন আবার বলেন, ‘দুইদিনের রিমান্ডে আসলে কিছু ঘটেনি। পুলিশ কোনও মারধর করেনি। তবে শুধু বসিয়ে রেখে এই যে ফাঁপর সেটাও কি কম?’
দুই দিনের রিমান্ড শেষে ৯ আগস্ট ২২ শিক্ষার্থীকে আদালতে হাজির করা হয়।আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কোর্ট থেকে প্রিজন ভ্যানে করে তাদের আবারও নিয়ে যাওয়া হয় কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে।
হাতে হাতকড়া দেখে বাবা-মায়ের চোখে পানি
‘ দেখুন, দুই দিনের রিমান্ডে হয়তো পুলিশ মারধর করেনি। কিন্তু, বিনা কারণে হাতে হ্যান্ডকাফ (হাতকড়া) তো লাগিয়েছে। আর বিনা দোষে হাতকড়া পড়া অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া কতটুকু কষ্টের তা বোঝানো যাবে না’,বলেন ঘটনার আরেক শিকার সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ষষ্ঠ বর্ষের ছাত্র সীমান্ত সরকার। তিনি বলেন, ‘আমাদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে নিয়ে আসা হয়। আমরা আমাদের পরিবারের লোকদের দেখতে পাচ্ছিলাম। ওরা দেখছে আমাদের হাতে হাতকড়া পড়ানো। নিজেদের যতটা খারাপ লাগছিল, তার থেকে তাদের বেশি খারাপ লাগছিল। আমাদের এই অবস্থা দেখে আব্বু আম্মুদের কেমন লাগছিল বলেন? তাদের চোখ ভিজে যাচ্ছিল। আমাদেরও। আমরা কোনও অপরাধ না করে বাবা-মার কাছে অপরাধী, সবার কাছে অপরাধী হয়ে গেলাম এটা ভেবে অনেক খারাপ লাগছিল। এটা আসলে বলে বোঝানো যাবে না। যে এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছে সেই বলতে পারবে। সবাই কান্না করছিল। তখনকার পরিস্থিতিটা বোঝানো আসলে কঠিন।’
প্রসঙ্গত: গত ২৯ জুলাই জাবালের নূর পরিবহনের একাধিক বাস যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে একটি বাসের চাপায় বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। আহত হয় আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অপেক্ষমাণ যাত্রী। এ ঘটনার প্রতিবাদে ওইদিনই রাস্তায় নামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দুই শিক্ষার্থীকে বাসচাপায় ‘হত্যার’ বিচারসহ নিরাপদ সড়কের জন্য ৯ দফা দাবিতে চলে টানা আন্দোলন। স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে ৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সমর্থন দেয়। সেদিন সায়েন্স ল্যাব, জিগাতলা ও ধানমন্ডিতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় গুজব রটানো হয় আওয়ামী লীগ অফিসে ৪ শিক্ষার্থীকে মারধর করে হত্যা, একজনের চোখ উপড়ানো এবং আরও চার ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ গুজব শুনে শিক্ষার্থীরা আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে তেড়ে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ ঘটে। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরবর্তীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলন চলাকালে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের পক্ষে নাশকতার মামলা দায়ের করা হয়। এরপরেই ধানমণ্ডি, বনানী, বসুন্ধরা ও বনশ্রী এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে আন্দোলন চলাকালে বেশ কিছু শিক্ষার্থী পুলিশের হাতে আটক হন। আটকদের মধ্যে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে ১২ দিন কারাগারে রাখার পর ঈদের আগে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় পর্বে পড়ুন: জায়গা হলো কারাগারের ওয়ার্ডে