X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কে শৃঙ্খলা: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার বাস্তবায়ন নেই

শাহেদ শফিক
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১০:১৩আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:৪৬

পুরনো বাসে রং করে ফের রাস্তায় নামানো হচ্ছে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য আগস্ট মাসে বেশ কিছু নির্দেশনা দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট। নির্দেশনাগুলোর মধ্যে ছিল— চলাচলের সময় সব গণপরিবহনের দরজা বন্ধ রাখা, নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠানামা বন্ধ করা, বাসের ভেতর চালক ও হেলপারের বৃত্তান্ত প্রদর্শন, চালক ও যাত্রীদের সিট বেল্টের ব্যবস্থা রাখা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সংক্রিয় ও রিমোট কন্ট্রোলড অটোমেটিক বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালুর মতো পদক্ষেপ নেওয়া অন্যতম। কিন্তু সেসব নির্দেশনার কোনটিই শতভাগ বাস্তবায়ন করেনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। এ নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থী মারা যায়। এর প্রতিবাদে সারা দেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। ওই আন্দোলনের পর ১৬ আগস্ট ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক সভায় অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও গণপরিবহন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরাতে অন্তত ডজন খানেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে দাবি, এরই মধ্যে গণপরিবহন ব্যবস্থাপনায় চারটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় দুটি সংস্থা। এগুলো হচ্ছে— শহরে চলাচলের সময় সব গণপরিবহনের দরজা বন্ধ রাখতে হবে। নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠানামা করা যাবে না। গণপরিবহনের দৃশ্যমান দু’টি স্থানে চালক ও হেলপারের ছবিসহ নাম এবং চালকের লাইসেন্স ও মোবাইল নম্বর প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। সব মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীকে বাধ্যতামূলক হেলমেট পরিধানের পাশাপাশি সিগন্যালসহ আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। মহাসড়ক বা দূর পাল্লার বাসে চালক এবং যাত্রীদের জন্য সিট বেল্ট স্থাপন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ২০ আগস্টের মধ্যে এই সিদ্ধান্তগুলো বিআরটিএ এবং বাংলাদেশ পুলিশের যৌথভাবে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। সরেজমিনে দেখা গেছে, এসবের কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। গণপরিবহনে ফেরেনি শৃঙ্খলা, সবকিছু চলছে আগের মতোই।

দৃষ্ট নন্দন করতে বিআরটিসির বাসে চলছে ঘষামাজা

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিসির কিছু পরিবহনে চালকদের জীবন বৃত্তান্ত লাগানো হলেও বেসরকারি কোম্পানির পরিবহনে এই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। নির্ধারিত স্থানে বাস দাঁড়ায় না। যত্রতত্রভাবে যাত্রী তোলা হচ্ছে। দূর পাল্লার বাসেও নেই যাত্রীদের সিট বেল্ট।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের (বিআরটিসি) সচিব নূর-ই-আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের পরিবহনে চালকের ছবিসহ জীবন বৃত্তান্ত লাগানো হয়েছে। পুরনো গাড়িগুলোকে উপযোগী করার কাজ চলমান রয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ  বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনাগুলো সব পরিবহন মালিকদের জানিয়ে দিয়েছি, যারা এই নির্দেশনা মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে ভিজিল্যান্স টিমের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ওই বৈঠকে সড়ক ব্যবস্থাপনায়ও ৯টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে— রাজধানীর যেসব স্থানে ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাস রয়েছে, তার উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি যারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাস ব্যবহার করবেন, তাদের ‘ধন্যবাদ’ কিংবা ‘প্রশংসাসূচক’ সম্বোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া, ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাসে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। লাগাতে হবে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা। ২০ আগস্টের মধ্যে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়। ৩০ আগস্টের মধ্যে আন্ডারপাস ও ফুটওভার ব্রিজের বাইরে আয়নার ব্যবস্থা করতে বলা হয়। ১৮ আগস্টের মধ্যে শহরের সব সড়কে জেব্রা ক্রসিং ও রোড সাইন দৃশ্যমান করে ফুটপাত দখলমুক্ত, অবৈধ পার্কিং এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং সড়কের নাম ফলক দৃশ্যমান স্থানে সংযোজনের জন্য দুই সিটি করপোরেশন ও ডিএমপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু নির্দেশনাগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র জেব্রা-ক্রসিং ও কিছু সিগন্যাল সাইন লাগানো হলেও বাকি কাজগুলো এখনও শুরু করতে পারেনি ডিএমপি ও সিটি করপোরেশন। পরবর্তীতে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বাড়ানো হলেও সে সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠান দুটি।

ডিএসসিসি’র প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সংস্থাটির আওতায় গুলিস্তানে একটি আন্ডারপাস রয়েছে। নতুন করে নির্দেশনা পেয়ে গত ২০ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আন্ডারপাসটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মো. বিলাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। প্রতিটি কাজের মনিটরিং চলছে। আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। কিছু কাজ বাকি রয়েছে। সেগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।’

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা ছিল— সিটি করপোরেশন সড়কে স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক সিগনাল ব্যবস্থাপনা স্থাপন করে তা পুলিশকে হস্তান্তর করবে। এছাড়া, রাজধানীতে রিমোট কন্ট্রোল অটোমেটিক বৈদ্যুতিক সিগনালিং চালু করতে হবে। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে একাজ সম্পন্ন করতে ডিএনসিসি ও ডিএমপিকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়। সরেজমিন দেখা গেছে, এখনও আগের মতোই হাতের ইশারায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সিগনাল বাতিগুলো পুলিশকে এখনও  হস্তান্তর করতে পারেনি ডিএসসিসি।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে এই প্রকল্পের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতিটি ইন্টারসেকশন ঘুরে দেখেছি। এখন সিগন্যালগুলোর সময় নিয়ন্ত্রণের জন্য রিমোর্ট প্রয়োজন। আমরা সেগুলো আমদানি করেছি। রিমোর্টগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। শিগগিরই হস্তান্তর করা হবে।’ তিনি বলেন,‘রিমোর্টগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশের পর্যাপ্ত জনবল নেই। তারা জনপ্রশাসনে তালিকা পাঠিয়েছে। আমাদের কাছ থেকে রিমোর্টগুলো নেওয়ার জন্য তারা এখনও প্রস্তুত নয়।’

ওই সভায় স্কুল ছুটি বা শুরু হওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের রাস্তা পারাপারে সহযোগিতার জন্য অপেক্ষাকৃত বয়ঃজ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী, স্কাউট এবং বিএনসিসির সহযোগিতায় রাস্তা পারাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নগরীর কিছু এলাকায় বিষয়টির বাস্তবায়ন দেখা গেলেও বেশির ভাগ সড়কে একনও আগের মতোই যত্রতত্র পারাপার হচ্ছে পথচারীরা।

সড়কে বাসের প্রতিযোগিতা থেমে নেই

ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্স বিষয়েও বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে অবৈধ পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, ফিটনেস সনদ দেওয়ার আগে পরিবহন সরেজমিনে দেখার ব্যবস্থা, রুটপারমিট বা ফিটনেসবিহীন যানবাহনগুলোকে দ্রুত ধ্বংস ও লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়া তরান্বিত করা। এসব কাজের মধ্যে বিআরটিএ কিছু কাজ শুরু করলেও ফিটনেস ও অবৈধ লাইসেন্সবিহীন যানবহন অহরহ চলছে। মাঝে মধ্যে পরিবহন মালিক সমিতির অভিযানে কিছু গাড়ি আটক করা হলেও ছাড়া পেয়ে ফের সেসব পরিবহন রাস্তায় নামছে।

সোমবার (২৪ সেপ্টেম্বর) নগরীর শাহবাগ, রূপসি বাংলা মোড় ও বাংলামটরসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, যত্রতত্রভাবেই সাধারণ মানুষ রাস্তা পারাপার হচ্ছে। বাসগুলোতে যেখান-সেখান থেকে যাত্রী তোলা হচ্ছে। অনেক স্থানে জেব্রা ক্রসিংয়ের রঙ উঠে গেছে।

জানতে চাইলে শিখর পরিবহনের চালক আরাফাত উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বলা হয়েছে বাস দাঁড়ানোর জন্য নির্ধারিত স্থান করে দেওয়া হবে। কিন্তু সেগুলো কোথায়? আমরা কোথা থেকে যাত্রী নেবো। আগে স্থান ঠিক করে দেওয়া হোক। তারপর আমরা সেখান থেকে যাত্রী উঠাবো।’

বাংলামটর এলাকায় দেখা গেলো, স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে শিশু বাচ্চাকে নিয়ে রাস্তা পার হলেন মা মুরশিদা বেগম। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর অনেক সিদ্ধান্তের কথা শুনেছি। কিন্তু কিছুরই বাস্তবায়ন দেখছি না। জেব্রা ক্রসিং আছে। সেখানে যানবাহন দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে মানুষ পারাপর হবে কিভাবে। এমন ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে মানুষের পদাচরণা নেই। উঠতেও অনেক কষ্ট। এগুলো ঠিক করতে হবে।’

জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন অনেক কাজই পরিকল্পতিভাবে করে না। যেসব নির্দেশনা রয়েছে সেগুলো খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে হয়তো কিছুটা পরিবর্তন আসবে।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা বলেন, ‘আমরা ফুট ওভারব্রিজগুলো ব্যবহার উপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছি। অনেক স্থানে জেব্রা ক্রসিং, রোড মার্কিং স্থাপন করেছি। যেসব কাজ বাকি রয়েছে, সেগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হবে।’

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া