X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘প্যাকেজ শেষ, আমার ভাইও শেষ’

তাসকিনা ইয়াসমিন
০১ নভেম্বর ২০১৮, ২০:৪৪আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০১৮, ০৯:১৪

মেডি এইড হাসপাতাল বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) রাজধানীর মেডি এইড হাসপাতালে মারা যান দুলাল বাহাদুর (৫০)। একটি প্যাকেজের আওতায় তার চিকিৎসা চলছিল। স্বজনরা অভিযোগ তুলেছেন প্যাকেজ শেষ হওয়ায় তার ভাইয়ের চিকিৎসাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে তার ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। বাংলা ট্রিবিউনকে দুলাল বাহাদুরের ভাই কবির বাহাদুর (৪০) বলেন, ‘আমার ভাইয়ের জন্য ৮৫ হাজার টাকার প্যাকেজ নির্ধারণ করেছিল চিকিৎসক। প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, আমার ভাইও মারা গেছে। ’

কবির বাহাদুর বলেন, ‘আমার ভাইকে গত বৃহস্পতিবার (২৫ অক্টোবর) মেডি এইড হাসপাতালে ভর্তি করি। তার আগে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মেডি এইড হাসপাতালে ভর্তির পর তিন দিন আগে ঢামেকের নিউরো সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল কবির খান তার অস্ত্রোপচার করেন। বুধবার (৩১ অক্টোবর) দুপুরে হঠাৎ করে চিকিৎসক স্যালাইন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। অক্সিজেনও খুলে নেয়। এরপর আমি চিকিৎসককে বলার পর তারা আবার অক্সিজেন ও স্যালাইন দেয়। এখানকার নার্সদের ডাকলে আসে না। কোনও কিছু দিতে বললেই বলে আপনাদের প্যাকেজে এটা নাই। দিতে হলে এক্সট্রা চার্জ লাগবে। আমার রোগী মারা যাইতাছে, আর এরা আছে হেগো টাকা লইয়া। আগে তো আমার রোগীর সেবা করবে, তা না করে হেরা টাকার চিন্তা করে।’

তার আরেক ভাই ২০১৭ সালের জুন মাসের ২৬ তারিখ রাজধানীর মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছে উল্লেখ করে কবির বাহাদুর বলেন, ‘তার ব্যাপারে আমি কোনও কমপ্লেইন করিনি। কিন্তু এখন এই ভাইয়ের ব্যাপারে কেন করছি? কারণ আমি এখানকার অবস্থা দেখেছি- এখানে শুধু টাকার কথা বলে আমার ভাইকে মেরে ফেলা হয়েছে।’

কবির বাহাদুর বলেন, ‘এখানে নার্স পাইনা, সিস্টার পাই না; ওয়ার্ড বয় পাই না।  যে চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করলো, একবারও এলো না। এটিএন বাংলার অ্যাডভাইজারের সঙ্গে আমি আছি, এই কথা যখন বলছি; তখন সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক বলছেন- রোগীর স্যালাইন-অক্সিজেন লাগাও। এটা কেন করলো? চিকিৎসক আমাকে বলছেন, আগে যে স্যালাইনে লাগানো ছিল তাতে গ্লুকোজ ছিল না। সেটা কি ছিল আমি কি করে বলবো? একজন চিকিৎসক বলে পানি খাওয়ানো যাবে, অন্যজন বলে যাবে না। আসলে আমরা কী করব?’

অস্ত্রোপচার করা চিকিৎসকের নেমপ্লেট কবির বাহাদুর বলেন,  ‘দুলাল বাহাদুর পেশায় দিনমজুর ছিলেন। মাঝে-মাঝে টমটম গাড়ি চালাতেন।  গত বৃহস্পতিবার (২৫ অক্টোবর) অ্যাকসিডেন্ট করলে তাকে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা তার নিউরো সমস্যা উল্লেখ করে ঢাকার নিউরো সাইন্স হাসপাতালে পাঠান। সেখানে সিট খালি ছিল না। সেখান থেকে আমরা ভাইকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যাই। সেখানকার ডাক্তার ম্যাডাম বলেন, আমরা আপনার রোগীকে মেডিসিনের ট্রিটমেন্ট দিতে পারবো; কিন্তু নিউরোর ট্রিটমেন্ট দিতে পারবো না।  আপনারা আপনাদের রোগীকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যান। আমরা ওই দিন ভাইকে ঢামেকের নিউরো বিভাগে ভর্তি করি।’

কবির বাহাদুর বলেন, ‘ঢামেকের ডিউটি ডাক্তার প্রথমে এমআরআই করতে বলে। তারপর বললো, আপনার রোগীর দ্রুত অস্ত্রোপচার করা লাগবে। না হলে এই রোগী যখন-তখন মারা যাবে। আর এখানে যদি করাতে চান, তো পাঁচ সপ্তাহ পর সিরিয়াল পাবেন। পরে ডাক্তার  আমাকে পিয়ন দিয়ে ভেতরে ডাকে। আমি গেলে বলে, বাইরে অপারেশন করাতে চাইলে লাখ খানেক টাকা লাগবে। আমি ভাইয়ের কথা চিন্তা করে মেডি এইডে অস্ত্রোপচার করাতে রাজি হই।’

কবির বাহাদুর বলেন, ‘অধ্যাপক শফিকুল কবিরের সঙ্গে আমাদের কোনও কথাই হয়নি। তার লোক শোয়েবের সঙ্গে কথা হয়েছে। তার মাধ্যমেই এই স্যারের আন্ডারে রোগী ভর্তি করি। অস্ত্রোপচার কক্ষে রোগী ঢোকানোর পর আমাকে বলে,  এখানে আইসিইউ নাই; কি করবেন? রোগীর তিন দিন আগে অস্ত্রোপচার হয়। তিনি ভালোই ছিলেন। বুধবার রোগীর স্যালাইন ও অক্সিজেন বন্ধ করে দেয়। রোগীর গলায় কফ জমে আছে। অনেক কষ্ট পাচ্ছে। আমাকে দিয়ে খালি সই করায়। আমি চোখ বুজে সই করে দেই। কারণ আমার রোগী ভালো করতে হবে। রোগীর অবস্থা খারাপ দেখে শোয়েব স্যাররে আমি ফোন দিছি। তিনি বলেন, শুক্রবার (২ নভেম্বর)  আপনার রোগী রিলিজ দিয়ে দেবো। আমি বললাম, কি করব এই রোগী নিয়ে গিয়ে? বলে বাড়িতে রাখবেন। ’

মারা যাওয়া দুলাল বাহাদুরের চাচাতো ভাই এম এ রাজ্জাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোগীর অবস্থা খারাপ হতে পারে, কিন্তু তারা ট্রিটমেন্ট বন্ধ করলো কেন? তারা ভেবেছে হয়ত নব্বই হাজার টাকার বেশি দেবে না, তাই তারা ওষুধ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মারা যাওয়ারও একঘণ্টা আগেই রোগীর লোকদের হাতে প্যাকেজের এই বিল ধরিয়ে দিয়েছে।’

দুলাল বাহাদুরের স্ত্রীর বড় ভাই রফিক আহমেদ বলেন, ‘ঢাকা মেডিক্যালের রোগী এখানে এনে ভর্তি করেছে, তার মানে হেরা দালালের খপ্পরে পড়েছে। কিন্তু বুঝবার পারে নাই। তাই রোগীরে হারাইতে হইল।’

দুলাল বাহাদুরের ভাগ্নে অলি আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিকিৎসায় প্যাকেজ কীভাবে সম্ভব? রোগী ভালো না খারাপ, এটা না দেখে কীভাবে অ্যাডভান্স ডিসচার্জ (ছাড়পত্র) দিয়ে দিল? ’

মৃত্যুর আগে হাসপাতাল থেকে দেওয়া বিলের কপি মেডি এইড হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাসবীর উল মোমেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোগী অ্যাকসিডেন্ট করেছিল। উনার মেরুদণ্ডের হাড্ডি (হাড়) একটা অন্যটার ওপর চেপে গিয়েছিল। এই রোগীর মৃত্যুর আসল কারণ হচ্ছে, অস্ত্রোপচার করে রিল্যাক্স করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপরও পেশেন্ট সারভাইভ করেনি। তবে, রোগীকে হাসপাতালে একদিন বেশি বাঁচিয়ে রাখলে হাসপাতাল একদিনের বেড ভাড়ার চার্জ পেতো। উনারা ভাবছেন আমরা স্যালাইন বন্ধ করে দিয়েছি, আসলে এটা বন্ধ করে চেষ্টা করা হয়, রোগী যেন খেতে পারে। আমি রোগীকে দেখার পর তাকে আবার স্যালাইন দিয়েছি। স্যালাইনটা শোয়েব স্যার বন্ধ করতে বলেছেন। একজন রোগী কতটুকু কি পাবে, তার হিসাব আমাদের কাছে লেখা থাকে। একজন চার দিন না খেয়ে থাকলেও মারা যাবে না। যে চার্জই হোক না কেন সেটা হাসপাতাল পাবে। অন্য কেউ পাবে না। আমি বেতন যা, তাই পাবো। রোগী মারা যাওয়ার পরে জীবনরক্ষাকারী ড্রাগগুলো রোগীর দেহে পুশ করি। এরপর আধ ঘণ্টা মতো অপেক্ষা করি। এরপর একটা ইসিজি করি। সেটা আমরা ফাইলে এটাচ করে রোগীকে মৃত ঘোষণা করি।’

এই বিষয়ে জানতে অস্ত্রোপচার করা চিকিৎসক ঢামেকের নিউরো সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল কবির খানকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি অপারেশনে ব্যস্ত আছি। এখন  কথা বলা যাবে না।’

মেডি এইড হাসপাতালের পরিচালক ডা. এম এ জলিল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোগী তো অধ্যাপকের অধীনে থাকেন। যে রোগী মারা গেছেন, উনি নিউরো সার্জনের অধীনে ছিলেন। উনার কাছ থেকে রোগীর অবস্থা কি রকম ছিল, মৃত্যুর কারণ জানতে পারবেন। উনারা রোগীর লোককে অবহিত করেছেন। রোগীর কি অবস্থা হতে পারে জানিয়ে ট্রিটমেন্টটা দেয় প্রফেসররা। ট্রিটমেন্টটা ওরা যেভাবে দেয়, আমাদের চিকিৎসক-নার্স সেইভাবেই সেবা দেবে। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের কোনও ক্ষমতা থাকে না রোগীর গায়ে একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেটও দিতে। প্রফেসরদের আমরা টাইম টু টাইম জানাই। উনারা তখন বলে যে এটা দাও, তখন আমরা দেই। সব হাসপাতালেই এটাই নিয়ম।’

নিজের হাসপাতালে আইসিইউ নেই উল্লেখ করে ডা. এম এ জলিল বলেন, ‘প্রফেসররা যেসব রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে না, তাদেরকে স্ক্রিনিং করেই অপারেশন করেন। যেকোনও রোগীর যদি আইসিইউ লাগে, তখন আমরা বারডেম বা ঢাকা মেডিক্যালের মতো হাসপাতালে রেফার করি।’ তিনি জানান, ৫০ শয্যার মেডি এইড হাসপাতালটি ১৯৮৫ সাল থেকে চালু রয়েছে।
আরও পড়ুন: কিডনি হারানো রওশন আরা মারা গেছেন

/এনআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা