দুটো ওয়েবসাইট। একটি আসল, আরেকটি নকল। দেখতে একই রকম। আসল ওয়েবসাইটে যেসব কন্টেন্ট আছে, নকলটিতেও তেমন। শুধু ওয়েবসাইটের নামের শেষে ডটকমের জায়গায় ডট ওআরজি লেখা ছিল। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ- এনটিআরসিএ’র ওয়েবসাইট এভাবেই নকল করে প্রতারণা করে আসছিল একটি গ্রুপ। অংশগ্রহণ ছাড়াই শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করিয়ে তালিকাভুক্ত করার জন্য বিভিন্ন প্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিতো। তারপর নিজেরা পরীক্ষার ফলাফল তৈরি করে নকল ওয়েবসাইটে আপলোড করে সংশ্লিষ্ট সেই প্রার্থীকে দেখাতো।
এমন প্রতারণার একাধিক অভিযোগ পেয়ে সম্প্রতি বিষয়টি ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগকে জানায় এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ। পুলিশ অনুসন্ধান করে বুধবার (৭ নভেম্বর) রাজধানীর বেইলি রোড থেকে ইয়াছিন আরাফাত তানিম নামে প্রতারক চক্রের এক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের উপ-কমিশনার মো. আলিমুজ্জামান বলেন, ‘এই চক্রটিতে একাধিক সদস্য যুক্ত আছে। আমরা তানিমকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনেছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার সহযোগীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১ নভেম্বর এনটিআরসিএ’র পরিচালক (প্রশাসন-১) ফারহানা ইয়াসমিন জেনি ডিএমপি কমিশনারের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে জানান, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত স্বচ্ছতা, সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার আবেদনপত্র গ্রহণ, ফলাফল প্রকাশ, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এন্ট্রি লেভেলে শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে শূন্য পদের ই-চাহিদা গ্রহণ, শিক্ষক নিয়োগে সুপারিশ কার্যক্রম, সম্মিলিত জাতীয় মেধাতালিকা প্রণয়ন এবং নিবন্ধন সনদ যাচাইসহ বিভিন্ন ধরনের অনলাইন সেবা দিয়ে থাকে। এ কার্যক্রমে কোনও প্রকার আর্থিক লেনদেনের সুযোগ নেই। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের দাফতরিক ওয়েবসাইট হলো www.ntrca.gov.bd। এই ওয়েবসাইটটি বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের ডাটা সেন্টারে হোস্টিং করা আছে। প্রতারক চক্র অসৎ উদ্দেশ্যে www.ntrcabd.org নামে একটি ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করাসহ অবৈধ অর্থ আদায়ের মাধ্যমে এনটিআরসিএ’র ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধানের জন্য সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগকে নির্দেশ দেন ডিএমপি কমিশনার। পরবর্তীতে সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের ওয়েবসাইট অ্যান্ড ই-মেইল ক্রাইম টিম প্রযুক্তির সহায়তায় অনুসন্ধান করে জানা যায়, নকল ওয়েবসাইটটি পটুয়াখালীর বাউফলের ধূলিয়া গ্রামের আব্দুল মালেকের ছেলে ইয়াছিন আরাফাত ওরফে তানিম নামে একজন পরিচালনা করছে। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ইয়াছিন আরাফাতের অবস্থান শনাক্ত করে বুধবার দুপুরে রাজধানীর বেইলি রোড এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বুধবারই তার বিরুদ্ধে রমনা থানায় ডিজিটাল সুরক্ষা আইনে একটি মামলা (নং ১১) করা হয়েছে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইয়াছিন আরাফাত জানায়, সে খন্দকার রিফাত এম হক নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে নকল ওয়েবসাইটটির ডোমেইন এবং হোস্টিং কিনে এনটিআরসিএ’র ওয়েবসাইটের আদলে তা তৈরি করে। এরপর সে ইমতিয়াজ নাইম ওরফে শাওন নামে তার এক সহযোগীসহ শিক্ষক নিবন্ধনকারী বিভিন্ন চাকরি প্রার্থীর সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল।
সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতারণাকারী এই চক্রটির সদস্যরা অনেক চতুর। তারা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ নিয়ে শিক্ষক নিবন্ধন তালিকায় নাম যুক্ত করিয়ে দেওয়ার কথা বলতো। একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর তারা ভুক্তভোগীকে নিজেদের তৈরি করা ওয়েবসাইটে তাদের নাম দেখাতো। এর আগেই তারা নিজেদের নকল ওয়েবসাইটে অন্যান্য অনেক নামের সঙ্গে ভুক্তভোগীর নাম যুক্ত করে দিতো।
ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের ওয়েবসাইট অ্যান্ড ই-মেইল ক্রাইম বিভাগের সহকারী কমিশনার সাঈদ নাসিরুল্লাহ বলেন, ‘এই চক্রটি কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে প্রতারণা করার কথা স্বীকার করলেও অনেক কিছু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের সঙ্গে আর কারা জড়িত এবং এখন পর্যন্ত কতজনের সঙ্গে এ ধরনের প্রতারণা করেছে তা জানার চেষ্টা করছি।’
এদিকে গত ৩০ অক্টোবর এনটিআরসিএ’র পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে ভুয়া ওয়েবসাইট থেকে সবাইকে সতর্ক থাকার জন্য বলা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ভুয়া ওয়েবসাইটে যোগাযোগ না করা এবং কারও সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় বা এনটিআরসিএ সংক্রান্ত অন্য যেকোনও বিষয়ে আর্থিক লেনদেন না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করা হলো।’