X
বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪
২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বাংলাদেশে মিটু আন্দোলন: যৌন হয়রানির ঘটনা তদন্ত করছে ডেইলি স্টার

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
১৫ নভেম্বর ২০১৮, ২২:১৮আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০১৮, ২৩:১৯

হ্যাশট্যাগে মিটু আন্দোলন (ছবি: ইন্টারনেট থেকে)

নারীর প্রতি যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে দুনিয়াজুড়ে ‘মিটু’ আন্দোলনের ছোঁয়া এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন নারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মিটু হ্যাশট্যাগ দিয়ে নিজের যৌন হয়রানির কথা উল্লেখ করে পোস্ট দিয়েছেন। এ নিয়ে গত বেশ কয়েকদিন ধরেই চলছে আলোচনা-সমালোচনা। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার থেকে শুরু করে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বা সাংবাদিকসহ সুপরিচিত আবৃত্তিশিল্পীর বিরুদ্ধেও উঠেছে যৌন হয়রানির অভিযোগ। পশ্চিমা দুনিয়ায় শুরু হওয়া এই আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে পাশের দেশ ভারতে। মিটু আন্দোলনের সেই ছোঁয়া বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা যৌন হয়রানির শিকার হয়েও চুপ করে থাকার যে প্রবণতা,তাতে কতটা সাড়া ফেলবে তা জানতে আগ্রহী অনেকেই। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এরইমধ্যে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে দ্য ডেইলি স্টার। এই সংবাদপত্রটির এক কর্মীর বিরুদ্ধে আরেক সাবেক সহকর্মীর দেওয়া যৌন হয়রানির অভিযোগ এরই মধ্যে তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের কূটনৈতিক প্রতিবেদক রেজাউল করিম লোটাসের বিরুদ্ধে হ্যাশট্যাগ মিটুতে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন তারই এক সময়ের সহকর্মী সাংবাদিক আলফা আরজু। এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে রেজাউল করিম লোটাসের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

যৌন হয়রানির ঘটনা তদন্তে ডেইলি স্টারের ওয়েবসাইটে ১৫ নভেম্বর দেওয়া নোটিশ

তবে বৃহস্পতিবার (১৫ নভেম্বর) রাতে ডেইলি স্টারের ওয়েবসাইটে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, একজন সহকর্মীর বিরুদ্ধে আরেকজন সাবেক সহকর্মীর দেওয়া যৌন হয়রানির অভিযোগটিকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হবে।  

গত ১৫ দিনে বাংলাদেশে মিটু হ্যাশট্যাগ দিয়ে যৌন হয়রানির সাতটি ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যার শুরুটা হয়েছিল গত মাসের ৩০ অক্টোবর। এদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রথম যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন মডেল ও সাবেক মিস আয়্যারল্যান্ড মাকসুদা আকতার প্রিয়তি। গত ৩০ অক্টোবর প্রিয়তি তার ফেসবুকে মিটু হ্যাশট্যাগ দিয়ে রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের দ্বারা যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। ২০১৫ সালের মে মাসের কোনও একদিনের কথা উল্লেখ করে প্রিয়তি তার ফেসবুক পেজে জানান, রফিকুল ইসলামের কার্যালয়ে একটি বিজ্ঞাপনের পারিশ্রমিক আনতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হন তিনি। যোগাযোগ করা হলে প্রিয়তি ঘটনার সত্যতা উল্লেখ করে জানান, যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা প্রকাশ করে নিজের জীবন নিয়ে তিনি হুমকির মুখে পড়েছেন। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আসা নিয়েও শঙ্কিত থাকার কথা জানান।

হ্যাশট্যাগ মিটু

অভিযোগের বিষয়ে জানতে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যক্তিগত সহকারী বুধবার বিকেলে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু বিকেলের পর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। যদিও এর আগে বিবিসি বাংলাসহ একাধিক গণমাধ্যমে যৌন হয়রানি করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি।

প্রিয়তির এই যৌন হয়রানির ঘটনায় শোরগোল হওয়ার মধ্যেই সুচমিতা সীমন্তি নামে ইউরোপ প্রবাসী এক তরুণী ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের একজন জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। প্রথমে অভিযুক্ত ব্যক্তির নামের প্রথমাক্ষর ব্যবহার করা হলেও পরবর্তীতে ওই ব্যক্তি বর্তমানে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসির সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত প্রণব সাহা বলে প্রকাশিত হয়। সীমন্তি নিজেও পরবর্তীতে তার ফেসবুক পোস্টে সরাসরি প্রণব সাহা নামটি উল্লেখ করেন। ১১ বছর আগের যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা জানিয়ে সীমন্তি তার ফেসবুক পেইজে বলেন, তার বয়স সেসময় ১৬ ছিল। পারিবারিক বন্ধু হিসেবে প্রণব সাহা তাদের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। এই সুযোগে প্রণব সাহা অযাচিতভাবে তার শরীর স্পর্শ করে।

হ্যাশট্যাগ মিটুতে এক বাংলাদেশি নারীর যৌন হয়রানির বর্ণনা

সীমন্তির এই অভিযোগের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। বাংলাদেশের শীর্ষ নারী অধিকারকর্মীদের একটি দল প্রণব সাহার কর্মক্ষেত্র ডিবিসি টেলিভিশনের কার্যালয়ে গিয়ে বিষয়টি তদন্তের দাবি জানান। সীমন্তিও প্রবাস থেকে মেইলের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে একটি অভিযোগ দেন।

তবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে প্রণব সাহা গত ৬ নভেম্বর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে যৌন হয়রানির অভিযোগটি অস্বীকার করেন। যোগাযোগ করা হলে প্রণব সাহা বলেন, ‘ফেসবুক স্ট্যাটাসে আমি যা বলেছি, এর বাইরে আমার কোনও ভাষ্য নেই।’ ফেসবুক স্ট্যাটাসে এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে প্রণব সাহা বলেন,‘...অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। শ্রদ্ধেয় সুলতানা কামাল, খুশি কবির এবং নাসিমুন আরা হক মিনু আপাই কমিটি গঠন করে দেবেন।... আমার আবেদন সেই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে সামাজিকভাবে অপদস্থ করা, দোষী সাব্যস্ত করা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের জেরে আমার বর্তমান প্রতিষ্ঠানকে হেয় করা থেকে সবাই বিরত থাকবেন।’

বাংলাদেশে ধীরে ধীরে মিটু আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার ধারাবাহিকতায় তৃতীয় নারী হিসেবে আসমাউল হুসনা নামে এক তরুণী বাংলাদেশ বেতারের সংবাদ পাঠক, উপস্থাপক ও যাত্রী ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তা জামিল আহমেদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। গত ৮ নভেম্বর নিজের ফেসবুক পোস্টে আসমাউল হুসনা নামে এক তরুণী জামিল আহমেদের দ্বারা যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। ২০১৩ সালের একটি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমিতে আড্ডা শেষে পাশের নির্জন সড়কে কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। হঠাৎই জামিল আহমেদ তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খান এবং শরীরে অযাচিত স্পর্শ করেন।

অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য জানতে জামিল আহমেদের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ এবং খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

হ্যাশট্যাগ মিটুতে যৌন হয়রানির শিকার আরেক বাংলাদেশি নারীর বর্ণনা

গত ১০ নভেম্বর তাসনুভা আনান নামে এক অভিনেত্রী যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান পাঠক সমাবেশ-এর কর্ণধার শহীদুল ইসলাম বিজুর বিরুদ্ধে। তাসনুভা তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস বলেন, পাঠক সমাবেশ-এর গুলশান ব্রাঞ্চে চাকরি দেওয়ার কথা বলে একদিন শহীদুল ইসলাম বিজু তার অফিস কক্ষে দরজা বন্ধ করে জোর করে চুমু খাওয়ার পাশাপাশি গোপনাঙ্গ প্রদর্শন করেন। পরবর্তীতে চিৎকার করতে চাইলে শহীদুল ইসলাম বিজু দরজা খুলে দেন এবং তাসনুভা সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে শহীদুল ইসলাম বিজু বলেন, ‘এগুলোর সত্যতা কিছুই নেই। আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। এনিয়ে আর কোনও কিছু...আরও কিছু লোকজন শেয়ার-টেয়ার দিচ্ছে, কিছু করতেছে, এগুলো তো মিথ্যা জিনিস, আমরা আইনের আশ্রয় নিচ্ছি। প্রচলিত আইনে, আমাদের সাইবার ক্রাইম যে আইন আছে, আইনের মধ্যেই যাচ্ছি। অতএব এটা নিয়ে কোনও কিছু...’। মামলা দায়ের করেছেন কি না জানতে চাইলে পাঠক সমাবেশের এই কর্ণধার বলেন, ‘মামলার প্রস্তুতি চলছে। দেখা যাক।’

হ্যাশট্যাগ মিটুতে যৌন হয়রানির শিকার আরেক বাংলাদেশি নারীর বর্ণনা

একদিন পর ১১ নভেম্বর বিকেল ৪টার দিকে জাকিয়া সুলতানা মুক্তা নামে এক তরুণী তার ফেসবুক পেজে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন আবৃত্তিকার মাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। মাহিদুল ইসলামের আবৃত্তি সংগঠন সংবৃতায় যুক্ত হওয়ার পর একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে কবিতা আবৃত্তি অনুশীলন করা কালীন মাহিদুল ইসলাম তাকে জোর করে চুমু খান এবং জড়িয়ে ধরেন। কিছুক্ষণ পর অন্য সহপাঠীরা দরজায় করাঘাত করলে সে যাত্রায় নিস্তার পান তিনি।

এদিকে জাকিয়া সুলতানা মুক্তার এই অভিযোগ অস্বীকার করে মাহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান। তিনি বলেন, আমার যা মনে হচ্ছে, ১৩ বছর আগের ঘটনার অবতারণা করেছে। ১৩ বছর আগে আমি ওই সংগঠনের লিডার ছিলাম। আমি ওই সংগঠনটি ছেড়ে আসছি। কমিটি করা নিয়ে একটা ঝামেলা হয়েছে। এখন তার (অভিযোগকারী) পক্ষে দাঁড়ায়ে গেছে কিছু লোক, যারা আবৃত্তিতে সফল হতে পারে নাই, ব্যর্থ। যারা আমার ছাত্র ছিল আগে, যারা মনে করে আমি তাদের সুযোগ দেইনি, তারা ওইসব কমেন্টস-টমেন্স লিখতেছে। ১৩ বছর পর কী লিখল আমি বুঝলাম না। এটাকে একটা ষড়যন্ত্রই মনে হচ্ছে আমার কাছে।’

মাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এখন তো আইনি সহায়তা নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। আমি আইনি সহায়তা নিচ্ছি। আসলে ওর (অভিযোগকারী) অভিযোগের কোনও ভিত্তি নেই। এখানে আসলে ওর (অভিযোগকারী) পক্ষে যারা কমেন্টস লিখছে, ওরা সবাই আবৃত্তিতে ব্যর্থ মানুষ। ওদের কাউকে চিনবেন না। ওরাই ষড়যন্ত্র করে এটা করছে।’

‘মুখ খোলাটা খুবই প্রয়োজন’

যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে বাংলাদেশে মিটু আন্দোলন দিন দিন দানা বাঁধছে। একজন দুজন করে অভিযোগের সংখ্যাও বাড়ছে। এমনকি মিটু আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে এর প্রতি নৈতিক সমর্থন জানাতে ফেসবুকে একটি ইভেন্ট খোলা হয়েছে। আগামীকাল শুক্রবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদকর্মীরা মিলিত হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এদিকে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম এবং বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। অভিযোগকারীরাও বলছেন, তারা এতদিন সাহস করে যৌন হয়রানি হওয়ার দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথাগুলো বলতে পারেননি। তারা নিজেদের ওপর ঘটে যাওয়া দুঃসহ অভিজ্ঞতাটা শেয়ার করছেন, যাতে নতুন করে কেউ যৌন হয়রানি করতে গিয়ে দু-একবার ভাববে।

কিন্তু বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে ‘মিটু’ কতটা সাড়া ফেলবে? যৌন হয়রানির শিকার হয়ে মুখ বন্ধ করে রাখার যে প্রবণতা বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা কতটুকু? নারী অধিকারকর্মী খুশি কবির বলেন, ‘বাংলাদেশে এটি সাড়া ফেলবে না একারণে যে অনেক ব্যক্তি আছে যারা, বা এটা অন্য দেশেও হয়, অন্য দেশে অবশ্য সাপোর্ট সিস্টেম রয়েছে, আমাদের এখানে সাহস করে যদি কোনও মেয়ে বলে, তার বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি কুৎসা রটনা শুরু হয়। আর যারা যৌন হয়রানি করে তাকে বাঁচানোর জন্য সবাই অস্থির হয়ে যায়।’

খুশি কবির বলেন, ‘মিটু আন্দোলনের মূল বিষয়টা ছিল মেয়েরা যেন সাহস করে বলতে পারে। মানুষের চেহারা উন্মুক্ত করে। এবং এই পুরুষরাই যারা মনে করে একজন নিরীহ মেয়ের ওপর তারা ইচ্ছামতো যা ইচ্ছা করতে পারে, কেউ কিছু কথা বলবে না। সে যেন পার পেয়ে যায়। মিটু আন্দোলন শুরু হয়েছে যে এগুলো উন্মোচন করা এবং পরবর্তীতে সেই পুরুষরা এগুলো করার আগে দুইবার-তিনবার চিন্তা করবে।’

‘বাংলাদেশে এটা শুরু হওয়ার পরে যারা অভিযোগ তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে যে বক্তব্য শুরু হয়েছে, সেই বক্তব্য শুরু হওয়ার কারণে অনেকেই ভয় পেয়ে যাবে। ‘আমি কি এটা সহ্য করতে পারবো কীনা যে আমার বিরুদ্ধে যে কুৎসা রটানো হচ্ছে’- অনেকে মেয়ে এরকম মনে করতে পারে। আমি মনে করি নিশ্চয়ই বাংলাদেশে প্রগতিশীল মানুষ আছে, যারা সাহস করে এসব লিখছে তারা এদের পাশে দাঁড়াবে। মিটু আন্দোলন আমাদের দেশে হোক এটা আমি চাই। যেন সবাই মুখ খুলতে শুরু করে। আগের মতো চুপচাপ করে বসে থাকবে, মুখ খুলবে না সেটা না করে মুখ খুলতে শুরু করেছে। মেয়েদের যেন বস্তু বা পণ্য হিসেবে গণ্য না করে মানুষ হিসেবে গণ্য করে।’ বলছিলেন খুশি কবির, যিনি নারী অধিকারকর্মী হিসেবে বাংলাদেশের একজন পরিচিত মুখ। ‘মুখ খোলাটা খুবই প্রয়োজন’- বলছিলেন তিনি।

আবৃত্তিকার মাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা তুলে ধরা জাকিয়া সুলতানা মুক্তা বলেন, ‘বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থাটা এমন যে, কেউ এসব বিষয়ে মুখ খুললে তাকেই সবাই দোষারোপ করে। তারপরেও আমি মনে করেছি আমার যে অবস্থান রয়েছে আমি যদি এসব বিষয়ে মুখ না খুলি তাহলে নিপীড়িতরা অনেকেই মুখ খুলবে না। আমি নিপীড়িত মেয়েদের পক্ষে একটা ভয়েস রেইজ করতে চেয়েছি। যেন মেয়েরা আর চুপ করে না থাকে। সবাই যেন মুখ খোলে।’

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত জাকিয়া সুলতানা মুক্তা বলেন, ‘আমি চাই সামাজিকভাবে এই মানুষগুলো বয়কট হোক, সামাজিকভাবে বিচার হোক। একেকটি ঘটনার পর একটি মেয়ে যেরকম মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সময় পার করে, ঠিক তেমনই নিপীড়কদের মুখোশ উন্মোচন করে তাদেরও একটি মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ফেলতে হবে।’

আসমাউল হুসনা বলেন, ‘আমার নিজের ঘটনা শেয়ার করার কারণটা ছিল সোশ্যাল অ্যাওয়ারনেস করবার জন্য। মিটু একটা আন্দোলনের জায়গা, কথা বলার একটা প্ল্যাটফর্ম। আমি যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি, যে আমাকে অ্যাবিউজ করেছে সে ধারণা করেছিল তার বিরুদ্ধে কেউ ভয়েস রেইজ করতে পারবে না। পাঁচ বছর পর আমার যে অবস্থান হয়েছে, আমি মনে করেছি আমার ভয়েস রেইজ করা প্রয়োজন। আমি যদি এসব কথা না বলি, এ ধরণের একটা ঘটনা না বা একজন জামিল আহমেদ না, হাজার হাজার জামিল আহমেদ রয়েছে যারা দিনের পর দিন নারীদের যৌন হয়রানি করে যাচ্ছে। আমি বিবেকের তাড়না থেকেই সোশ্যাল অ্যাওয়ারনেসের জন্য বলেছি, আমি চাই বাকিরাও তাদের কথা বলুক। সবাই তাদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতার কথা বলুক।’

মিটু: আইন কি বলে?

যদিও মিটু হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে নিজের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতার উদ্দেশ্য হলো সেই নিপীড়ক হিসেবে সেই ব্যক্তির মুখোশ উন্মোচন করে দেওয়া। যাতে ভবিষ্যতে সেই ব্যক্তিসহ অন্যান্যরাও কোনও নারীর প্রতি যৌন হয়রানি করতে সাহস না পায়। কিন্তু এ বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগও রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। বিশেষ করে মিটু হ্যাশটাগের মাধ্যমে প্রকাশিত যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেও বিচার হওয়া সম্ভব। বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেও এসব বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘আমাদের যে প্রচলিত আইন রয়েছে, সেসব আইনেও যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে অনেক সময় যেটা হয়, অনেক দিন আগের ঘটনা হলে আসামিপক্ষ বা অভিযুক্ত যারা তারা এভিডেন্স প্রুভড না থাকার সুযোগ নিতে পারে।’

সালমা আলী বলেন, ‘এক্ষেত্রেও অনেক আর্গুমেন্টের সুযোগ রয়েছে। যেমন ভিক্টিম আগে সেকেন্ড টাইম ভিক্টিমাইজ হওয়ার ভয়ে সাহস করেনি। এখন যেহেতু বিশ্বব্যাপী বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ হচ্ছে, সেই সূত্র ধরে ভিক্টিম আইনগত প্রতিকার চাইতে পারে।’

কিন্তু ইতোমধ্যে যারা নিজের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন, তারা কি আইনি প্রতিকার চান? বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যে ছয় জন নারী মিটু আন্দোলনের অংশ হিসেবে নিজের যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন তাদের একজন, আসমাউল হুসনা বলেন, ‘আমি আসলে সোশ্যাল অ্যাওয়ারনেসের জন্য বলেছি। আইনিভাবে আমার চাওয়ার কিছু নেই। আমি চেয়েছি সোশ্যাল অ্যাওয়ারনেস এবং যে নিপীড়ক তার মুখোশটা উন্মোচন করতে। আমি মনে করি এসব প্রকাশ করলে দুই ধরনের অ্যাওয়ারনেস হবে। একটা হলো, নারীরা তাদের অ্যাবিউজ হওয়ার কথা বললে যে নিপীড়ক সেও সতর্ক হবে। সে কিন্তু একটা মেসেজ পেলো। যারা নিপীড়ক তাদের মধ্যেও একটা ভয় হবে। আর যারা কথা বলছে তাদের দেখে অন্যরাও চুপ করে না থেকে প্রতিবাদ করবে।’

জানতে চাইলে পুলিশের একজন কর্মকর্তা, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ‘যে কোনও যৌন হয়রানির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে পুলিশ তা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে থাকে। এক্ষেত্রে ভিকটিম বা তার পক্ষে কাউকে না কাউকে থানায় লিখিত অভিযোগ করতে হয়। তাহলে পুলিশ তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।’

এদিকে অভিযুক্তদের অনেকেই অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যে কেউ নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ভিকটিম মনে করলে আইনের দ্বারস্থ হতে পারেন। পুরো বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।

যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে হ্যাশট্যাগ মিটু’ নামের এই আন্দোলনের শুরু হয় মূলত ২০০৬ সালে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘মাইস্পেস’-এ আফ্রিকান-আমেরিকান সমাজকর্মী তারানা বুর্ক তের বছর বয়সে যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে শুরু করেন এই আন্দোলন। তার বার্তা ছিল তুমি একা নও, আমিও আছি। মিটু নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণও করেছিলেন তিনি। ২০০৬ সালের সেই আন্দোলনে হাওয়া লাগে ২০১৭ সালে, মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালেইনা জেইন মিলানোর হাত ধরে। তারপর থেকে একে একে যোগ হয়েছে অনেক নাম। অভিনয় ও বিনোদন জগত থেকে করপোরেট, রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড়, পাইলট থেকে সাধারণ নারীরা এই আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। মিটু হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন নিজের যৌন হয়রানি হওয়ার দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা।

/এনএল/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এবারের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র
এবারের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র
বনানীতে ট্রেন থেকে পড়ে কিশোরের মৃত্যু
বনানীতে ট্রেন থেকে পড়ে কিশোরের মৃত্যু
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি কারাগারে
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি কারাগারে
বাড্ডায় কারখানার আগুনে পুড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
বাড্ডায় কারখানার আগুনে পুড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের প্রিলির ফল প্রকাশ
১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের প্রিলির ফল প্রকাশ
শিক্ষার্থী ভর্তির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ
শিক্ষার্থী ভর্তির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ
রণক্ষেত্রে রুশ অগ্রগতি পাল্টে দিতে পারে ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথ
উদ্বিগ্ন হোয়াইট হাউজরণক্ষেত্রে রুশ অগ্রগতি পাল্টে দিতে পারে ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথ
বাবার নির্বাচনি প্রচারণায় নামা মেয়ের গাড়ির ধাক্কায় শিশু নিহত
বাবার নির্বাচনি প্রচারণায় নামা মেয়ের গাড়ির ধাক্কায় শিশু নিহত
সৌরবিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় সরকার
সৌরবিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় সরকার