X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সোনা আসে ‘ভুল’ ঠিকানায়

দীপু সারোয়ার
১৮ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:৫১আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০১৮, ২০:১৬

বাংলাদেশে সোনা চোরাচালান (পর্ব-৪)

চ্যান কক ওয়েই ও চেন সিম শ্যাপ। চীনা বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ান। প্রথম জন বয়সে তরুণ, বয়স ২৪। দ্বিতীয় জন বয়সে প্রবীণ, বয়স ৫৮। ঘন ঘন যাতায়াতের সূত্রে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা তাদের বেশ পরিচিত। তবে পর্যটক হিসেবে নয়, চোরাচালানের সোনার বাহক হিসেবেই ঢাকা আসতেন তারা। ২০১৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাতে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর কাস্টমস কর্মকর্তাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তারা। তাদের শরীর তল্লাশি হয়। বিশেষভাবে তৈরি কোমরের বেল্ট থেকে উদ্ধার হয় ৬ কেজি ওজনের ছয়টি সোনার বার। সে সময়ের বাজার দর অনুযায়ী উদ্ধার হওয়া ওই সোনার মূল্য ৩ কোটি টাকা।

বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধান :

দুই বিদেশিকে গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে কাস্টমস কর্মকর্তারা মালয়েশিয়ায় সোনা কেনার একটি রশিদ উদ্ধার করেন। বাংলা ট্রিবিউনের হাতে আসা ওই রশিদ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চ্যান কক ওয়েই এর নামে কেনা সোনার গন্তব্য ছিল বায়তুল মোকাররম সুপার মার্কেটের আমীন জুয়েলার্স। রশিদে উল্লেখ করা শোরুমের নম্বর হলো ৫২-৫৬। বায়তুল মোকাররম সুপার মার্কেট ঘুরে দেখা যায় দেখা যায়, সেখানে আমীন জুয়েলার্সের দু’টি শোরুম রয়েছে। তবে দোকান নম্বর হলো যথাক্রমে ৭৩ ও ৭৭।

কিন্তু, জব্দ তালিকা, মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্রে আসামিদের কাছ থেকে পাওয়া মালয়েশিয়ায় সোনা কেনার রশিদটির তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। ফলে মামলার তদন্ত প্রক্রিয়ায় আমীন জুয়েলার্সের মালিক কাজী সিরাজুল ইসলাম বা জুয়েলার্সটির কোনও কর্মচারীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। সোনা চোরাচালান সংক্রান্ত পাঁচ শতাধিক মামলা পর্যালোচনায়ও একই ধরনের ত্রুটি চোখে পড়ে।

সোনা চোরাচালানের দায়ে গ্রেফতার হন তিন গডফাদার মোহাম্মদ আলী, রিয়াজ উদ্দিন ও শামসুল হুদা। কিন্তু সবাই উচ্চ আদালতে জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছেন দেশের বাইরে।

গ্রেফতার হওয়ার চারমাস আগেই গোয়েন্দাদের নজরে পরে দুই বিদেশি :

অনুসন্ধানে জানা যায়, গ্রেফতার হওয়ার প্রায় ৪ আগে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে চ্যান কক ওয়েই ও চেন সিম শ্যাপ শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত কাস্টমস কর্মকর্তাদের নজরে পড়ে। সেবার ঢাকায় এসে তারা বায়তুল মোকাররম মার্কেটে যায় এবং আমীন জুয়েলার্সেও শোরুমে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটায়। কিন্তু সেবার হাতেনাতে গ্রেফতার করতে না পরলেও ২০১৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর সোনাসহ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেফতার করা হয় তাদের।

মালয়েশিয়ায় সোনা কেনার সেই রশিদ যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে আমীন জুয়েলার্সের নাম

সোনা কেনার রশিদের তথ্য নেই কেন, তার জবাব নেই:

চ্যান কক ওয়েই ও চেন সিম শ্যাপকে গ্রেফতারের পর জব্দ তালিকা করেন ঢাকা কাস্টম হাউজের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আহমেদ নেওয়াজ। জব্দ তালিকায় ৬টি সোনার বার ছাড়াও, মালয়েশিয়ার দুই নাগরিকের পাসপোর্ট, মালয়েশিয়ার জাতীয় পরিচয়পত্র জব্দ করার তথ্য উল্লেখ আছে। তবে জব্দ তালিকায় আমীন জুয়েলার্সের নামে মালয়েশিয়ায় সোনা কেনার রশিদটির তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। জব্দ তালিকায় সাক্ষী হিসাবে দু’জনের নাম রয়েছে। তারা হলেন : চলতি দায়িত্বের রাজস্ব কমকর্তা শুভাশীষ রায় ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ইয়াকুব জাহিদ। এ বিষয়ে যোগাযোগ করেও আহমেদ নেওয়াজ, শুভাশীষ রায় ও ইয়াকুব জাহিদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এজাহার ও অভিযোগপত্রেও সোনা চোরাচালানের রশিদের উল্লেখ নেই :

চ্যান কক ওয়েই ও চেন সিম শ্যাপকে চোরাচালানি উল্লেখ করে বিমানবন্দর থানায় দায়ের করা মামলার বাদী হলেন ঢাকা কাস্টম হাউজের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আহমেদ নেওয়াজ। মামলা নম্বর-২৮। মামলার তারিখ: ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫। বিমানবন্দর থানা এই মামলার তদন্ত করে। থানা পুলিশ অভিযোগপত্রে সোনা কেনার রশিদের তথ্য উল্লেখ করেনি।

সোনা আটকের পর বিমানবন্দর থানায় দায়ের করা এজাহার। এতে সেই রশিদের বিষয়টির উল্লেখ নেই

বিচার প্রক্রিয়া:

মামলার বিচার শুরু হয়েছে প্রায় ছয় মাস আগে। তবে এখনও সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, সাক্ষী হাজির করা বড় সমস্যা। এ জন্য তারিখের পর তারিখ পরিবর্তন হয়। সাক্ষীরা যেহেতু কর্মজীবী সেহেতু কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ততার অজুহাতে সময় চেয়ে আবেদন করেন। ফলে মামলা কার্যক্রম পিছিয়ে যাচ্ছে বারবার।

এজাহারের দ্বিতীয় পাতা

দুই বিদেশির আইনজীবীর বক্তব্য :

সোনা চোরাচালানি হিসেবে গ্রেফতার হওয়া দুই বিদেশির আইনজীবী হচ্ছেন অ্যাডভোকেট এইচ এম মাসুম। এই দুই বিদেশির বরাত দিয়ে তিনি বলেন, আসামিদের দাবি আমীন জুয়েলার্সের জন্যই মালয়েশিয়া থেকে সোনা আনা হয়। দোকানের নম্বরে হেরফের আছে জিজ্ঞাসা করলে আইনজীবী বলেন, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর ও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা বারবার বলেছে উদ্ধার হওয়া সোনার মালিক আমীন জুয়েলার্স।

এইচ এম মাসুম বলেন, চ্যান কক ওয়েই ও চেন সিম শ্যাপ নামের দুই আসামিই কাশিমপুর কারাগারে বন্দি আছে। দেশে ফিরে যেতে চায় তারা। তাদের মধ্যে চেন সিম শ্যাপ বয়সে প্রবীণ এবং অসুস্থ। কারা হাসপাতালে চিকিৎসাও হয়েছে তার।

আমীন জুয়েলার্সের মালিক কাজী সিরাজের বক্তব্য মেলেনি :

এ বিষয়ে আমীন জুয়েলার্সের মালিক কাজী সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। দফায় দফায় ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি তিনি। মুঠোফোনে বার্তা পাঠানো হলেও তার জবাবও দেননি।

সোনা উদ্ধারের পর মামলার জব্দ তালিকা। এখানেও মালয়েশিয়ায় সোনা কেনার সেই রশিদটির কথা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে আমীন জুয়েলার্সের মালিককে বাঁচাতে

বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধান :

ছয় কেজি সোনা চোরাচালান মামলার মতো সোনা চোরাচালানের অন্য বেশিরভাগ মামলাতেও মূলহোতা চিহ্নিত হয়নি। নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, চোরাচালানের সোনা উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর টালবাহানা। জব্দ তালিকা ও মামলার এজাহারেই বাদ পড়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলামত। ফলে তদন্তে মূলহোতাদের নাম আসে না। অভিযোগপত্রে বাহক (এদের বেশির ভাগই প্রবাসী শ্রমিক, বিদেশি পর্যটক ও লাগেজ ব্যবসায়ী), কমিশনভোগী, সোনা বহনকারী গাড়ির চালকের নাম আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তারা মূলহোতার পরিচয় জানে না। আবার, চোরাচালান হয়ে আসা সোনা ল্যাবে পরীক্ষার পর নিশ্চিত করা হয়। এতে সময়ক্ষেপণ হয়। আসামিরা নিম্ন আদালতে জামিন না পেলেও উচ্চ আদালতে জামিন পায়। জামিন নিয়ে উধাও হয়ে যায় আসামিরা। মামলার বিচার শুরু হলে সাক্ষীদের হাজির করা যায় না-এসব কারণে বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটে।

৩৩ বছরে গ্রেফতার মাত্র ৩ মূলহোতা :

২০১৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টনে আলী সুইটসের মালিক মোহাম্মদ আলীর দু’টি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে পাঁচ বস্তা টাকা, বিদেশি মুদ্রা এবং দেড় মণ সোনা উদ্ধার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির সূত্র ধরে গ্রেফতার হন সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন। সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের এই নেতা এখন জামিনে আছেন। বাংলাদেশের ৩৩ বছরের স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় ‘গডফাদার’ হিসেবে মাত্র ৩ জন গ্রেফতার হয়। তাদেরই দু’জন হলেন রিয়াজ উদ্দিন ও মোহাম্মদ আলী। আরেক ‘গডফাদার’ গ্রেফতার হয় চলতি বছরের ৪ মার্চ। তার নাম এইচ এম শামসুল হুদা। ছেলেসহ থাইল্যান্ডে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৮৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চোরাচালান মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ৪৯৫ জন। এদের মধ্যে ৪৯২ জনই বাহক।

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ