রাজধানীর খিলক্ষেতের একটি যাত্রাবাহী মিনিবাসে দুই পুলিশ সদস্য থাকা অবস্থাতেই এক যাত্রীকে ডিবি পুলিশ পরিচয় তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ওই যাত্রীর কাছ থেকে ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে তাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। ঘটনার প্রায় দেড় মাস পর ভুয়া এই ডিবি টিমকে গ্রেফতার করেছে পিবিআই ঢাকা মেট্রো।
মঙ্গলবার (২০ নভেম্বর) সকালে ধানমন্ডিতে পিবিআই’র সদর দফতরে এই তদন্ত সংস্থার প্রধান বনজ কুমার মজুমদার এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান।
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘গত ২৫ অক্টোবর বিমানবন্দর সড়কের খিলক্ষেত এলাকা থেকে সুপ্রভাত নামে একটি মিনিবাস থেকে মোস্তাফিজুর রহামন (২৫) নামে এক যাত্রীকে ডিবি পরিচয় তুলে নেওয়া হয়। এসময় ওই বাসের ভেতরে ডিএমপির একটি থানার দুজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। তাদের ভুয়া ডিবি সদস্যরা ধমক দিয়ে ওই যাত্রীকে তুলে নিয়ে যায়। প্রবাসী মোস্তাফিজুর রহমানের ব্যাগে ১৩ লাখ টাকা ছিল, ওই টাকা হাতিয়ে নিতেই চক্রটি তাকে ইয়াবা ব্যবসায়ী বলে বাস থেকে নামিয়ে নেয়।’
তিনি জানান, এরপর ওই ঘটনায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলা করেন মোস্তাফিজুর রহমান। মামলাটি তদন্ত করে পিবিআই ঢাকা মেট্রো। এই তদন্ত সংস্থা সোমবার (১৯ নভেম্বর) সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের ভিকটোরিয়া পার্কের সামনে থেকে তাদের গ্রেফতার করে।
গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলো এ কে এম রানা (৩৮), দেলোয়ার হোসেন (৫০), সোহাগ খন্দকার (৩১), জাবেদ আহমেদ ওরফে বাবু (৩৭), বুলবুল আহমেদ (৩২), নাজমুল হোসেন (২৪), আসাদুজ্জামান (৩৫) ও হারুন ওরফে হিরা (৩২)।
বনজ কুমার মজুমদার জানান, এদের মধ্যে এ কে এম রানা নিজেকে ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) পরিচয় দিতো। ভুয়া ডিবি দলটির নেতৃত্ব দেয় সে। ডিবির টিমের আদলে সাজানো এই ভুয়া ডিবি টিম। ডিবি টিমে যেমন পুলিশের পদবী থাকে, এই টিমেও সেভাবে বিভিন্ন পদবীর লোক কাজ করতো। তাদের টিমে দুজন ভুয়া পরিদর্শক, দুজন ভুয়া উপপরিদর্শক এবং তিনজন ভুয়া কনস্টেবল রয়েছে। পিবিআই’র হাতে গ্রেফতারের পর ভুয়া ডিবি টিমের সদস্যরা এই স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তারা ডিবি পরিচয়ে অপরাধ করার কথাও স্বীকার করেছে।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত ২৫ অক্টোবর বিকাল ৩টার দিকে প্রবাসী মোস্তাফিজুর রহমান সুপ্রভাত বাসে করে রাজধানীর পল্টন থেকে তার খিলক্ষেতের বাসায় যাচ্ছিলেন। এসময় তার সঙ্গে পলাশ (২৫) নামে এক বন্ধু ছিলেন। মোস্তাফিজের হাতে থাকা একটি ব্যাগে ১৩ লাখ টাকা ছিল। নর্দ্দার পর বাসটির সামনে দুটি মোটর সাইকেল দিয়ে কয়েকজন ব্যক্তি গতিরোধ করে। তারা মোটর সাইকেল থেকে নেমে বাসের ভেতরে ঢোকে। পলাশের কাছে ইয়াবা আছে বলে তাকে তল্লাশি করে। কিন্তু তার কাছে কিছু পায়নি বলে তাকে ছেড়ে দেয়। এরপর মোস্তাফিজুরের ব্যাগে ইয়াবা আছে বলে তাকে তুলে নিয়ে যায়। মোস্তাফিজুরকে তুলে নেওয়ার সময় ওই বাসের ভেতর ডিএমপির দুজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। ভুয়া ডিবির টিমটি তাদের দুজনকে ধমক দেয়। দুই পুলিশ সদস্যকে তারা বলে, ‘তোমরা ডিউটি ফাঁকি দিচ্ছো, ঠিকমতো ডিউটি করো না।’ তখন ওই দুই পুলিশ সদস্য সিটে বসে পড়েন।
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘মোস্তাফিজুরকে তুলে নেওয়ার সময় একটি মজার ঘটনা ঘটেছে। ওই বাসের ভেতরে দুজন পুলিশ কনস্টেবল ছিলেন, যারা নকল ডিবি টিমকে চিনতে পারেননি। নকল ডিবি তাদের দুজনকে ধমক দেয়, হয়তো তারাও ঠিকমতো ডিউটি করেননি, তাই তারাও দুজন কাচুমাচু করে বসে যান। এমনকি এসি পরিচয় দেওয়ায় তারা দুজনে ওই নকল ডিবি টিমকে স্যালুট দেয়।’
পিবিআই’র প্রধান জানান, মোস্তাফিজুরকে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে গুলশান, বাড্ডা ও রামপুরায় ঘুরতে থাকে তারা। তখন মোস্তাফিজ তাদের কাছে জানতে চায়, ‘আমাকে কোথায় নেওয়া হচ্ছে?’ তখন ওয়ার্লেস হাতে থাকা ভুয়া ডিবির এক সদস্য বলে, ‘তোকে থানায় নিয়ে মামলা দেওয়া হবে।’ কিন্তু তাকে কোনও থানায় নেওয়া হচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর মোস্তাফিজ আবার প্রশ্ন করে, ‘আমাকে কোন থানায় নিয়ে যাবেন?’ তখন তারা বলে, ‘এই তো সামনে।’ ২৫ অক্টোবর বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিটে তেজগাঁওয়ের বিএসটিআই মোড়ের একটি ফাঁকা জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে মোটরসাইকেল থেকে তাকে নামানো হয়। মোস্তাফিজুরের হাতে থাকা ১৩ লাখ টাকা ভর্তি ব্যাগটি নিতে চায় নকল ডিবি। তারা ব্যাগ ধরে টানাটানি করে।
বনজ কুমার বলেন, ‘মোস্তাফিজুরের ব্যাগটি যখন টানাটানি করে, তখন তার সন্দেহ হয়, এরা আসল ডিবি নয়। এসময় মোস্তাফিজুর চিৎকার শুরু করে। তখন ভুয়া ডিবি তাকে মারতে থাকে। একজন গলায় চাকু ধরে। এসময় মোস্তাফিজুর চিৎকার দেয়। তখন আশেপাশের মানুষ দৌড়ে আসে। মানুষ দেখে ভুয়া ডিবি মোটরসাইকেল চালিয়ে পালিয়ে যায়। তাদের মধ্যে একজনকে ধরে ফেলে পথচারীরা।’
তিনি জানান, এরপর ওই ভুয়া ডিবিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ওইদিনই মোস্তাফিজুর রহমান একটি মামলা করেন। মামলাটি পিবিআই ঢাকা মেট্রো তদন্ত করছে। পিবিআই তদন্ত করে চক্রের এই আটজনকে গ্রেফতার করেছে। তারা ডিবি পরিচয়ে মানুষকে অপহরণ করে এবং ডাকাতি করে।
বনজ কুমার বলেন, ‘চক্রটি মূলত পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে। তাদের সোর্স টার্গেট ঠিক করে দেয়। এরপর সুবিধামতো জায়গায় তাদের অপহরণ করে ভুয়া ডিবি পরিচয় দিয়ে। টাকাপয়সা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়। এই চক্রটি সম্প্রতি একজনের কাছ থেকে ২৫ হাজার, আরেকজনের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা এভাবে নিয়েছে। এভাবে হাতিয়ে নেওয়া টাকার ৪০ শতাংশ তারা সোর্সকে দিয়ে দেয়। কারণ, সোর্সরা তাদের টাকাওয়ালাদের চিহ্নিত করিয়ে দেয়।’
তবে এই চক্রটি যে এলাকায় থাকে সেখানে কোনও অপরাধ করে না বলে জানান বনজ কুমার। তারা এলাকার বাইরে গিয়ে অপহরণ করে। ঢাকা মহানগরীতে এরকম সাতটি ভুয়া ডিবি টিম আছে বলেও জানিয়েছে পিবিআই।
পিবিআই জানায়, এসি (সহকারী কমিশনার) পরিচয় দেওয়া এ কে এম রানা সচ্ছ্বল পরিবারের সন্তান। তবে সে হিন্দি সিনেমা দেখে এই কাজে উৎসাহী হয়েছে। ‘বস’ সিনেমা দেখে সে এই কাজ শিখেছে। সে নিজেকে এসি পরিচয় দিতে অহঙ্কার বোধ করে। এই টিমের দুজনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। কয়েকজন পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে। চক্রটির একটি মাইক্রোবাস আছে, সেটিও জব্দ করার চেষ্টা চলছে বলে জানায় পিবিআই।