X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

১০ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে প্রবাসীর লাশ এসেছে সবচেয়ে বেশি

সাদ্দিফ অভি
০৪ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:২৫আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১৬:৪৫

প্রবাসীর লাশ (ছবি: ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া) ঢাকার যাত্রাবাড়ীর সালাম দেওয়ান, নোয়াখালীর ইমাম হোসেন এবং নরসিংদীর রতন মিয়া, তিন দেশের এই তিন অভিবাসী শ্রমিক গত বছরের নভেম্বর মাসে দেশে ফিরেছেন লাশ হয়ে। তাদের মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই দেশে ফিরছে প্রবাসী শ্রমিকদের লাশ। তবে গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসীর লাশ দেশে এসেছে ২০১৮ সালে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তথ্য পর্যালোচনা করে এই হিসাব পাওয়া গেছে।
দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং ধার করে বিদেশ যাওয়ায় টাকা উপার্জনে মানসিক চাপে ভোগেন তারা। মৃত্যুর কারণ হিসেবে জানা যায়, বেশির ভাগ প্রবাসী মারা গেছেন স্ট্রোক করে। প্রবাসীদের এমন অকালমৃত্যুর কারণ নিয়ে এখনও কোনও অনুসন্ধান হয়নি। প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো মৃত্যুর এই সংখ্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত চার বছরে যত প্রবাসীর লাশ এসেছে, তাঁদের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অন্তত ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যু হয়েছে আকস্মিকভাবে।
প্রবাসী বাংলাদেশি, মৃতদের স্বজন ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হন। যে বিপুল টাকা খরচ করে বিদেশে যান, সেই টাকা তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম, দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং সব মিলিয়ে মানসিক চাপে ভোগেন তারা। তাই মানসিক চাপ কমাতে অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং প্রবাসী শ্রমিকদের মানসিক বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা তৈরি করার ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩১৫ জন, ২০১০ সালে ২ হাজার ২৯৯ জন, ২০১১ সালে ২ হাজার ২৩৫ জন, ২০১২ সালে ২ হাজার ৩৮৩ জন, ২০১৩ সালে ২ হাজার ৫৪২ জন, ২০১৪ সালে ২ হাজার ৮৭২ জন, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮৩১ জন, ২০১৬ সালে ২ হাজার ৯৮৫ জন, ২০১৭ সালে ২ হাজার ৯১৯ জন এবং ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৫৭ জনের মরদেহ দেশে ফিরেছে। অর্থাৎ গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসীর লাশ দেশে এসেছে ২০১৮ সালে।
সবচেয়ে বেশি লাশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে এসেছে ১০০৮টি, কুয়েত থেকে ২০১টি, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২২৮টি, বাহরাইন থেকে ৮৭টি, ওমান থেকে ২৭৬টি, জর্ডান থেকে ২৬টি, কাতার থেকে ১১০টি, লেবানন থেকে ৪০টিসহ মোট ৩০৫৭ টি লাশ দেশে ফিরেছে। এছাড়া মালয়েশিয়া থেকে এসেছে ৬৭২ জনের লাশ। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসীদের লাশ দেশে আনতে সহযোগিতা করে। মৃত ব্যক্তিদের পরিবার লাশ দাফনের জন্য বিমানবন্দরে ৩৫ হাজার এবং পরে ৩ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান পায়।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ জুলহাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুধু যে স্ট্রোকের কারণে প্রবাসীরা মারা যায় তা না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ দেখা যায় দুর্ঘটনা, স্ট্রোক বা হৃদরোগ। এ কারণে এখন লোকজন বিদেশ যাওয়ার সময়ই আমরা সে দেশের আবহাওয়া সম্পর্কে তাদের সচেতন করি। সে দেশের খাবার-দাবার, আইনকানুন সবকিছু সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছি যাতে তারা সচেতন হতে পারেন।’
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০টি মৃতদেহ আসছে। গত এক যুগে প্রায় ৩৬ হাজার মৃতদেহ দেশে এসেছে। এর মধ্যে ৬১ শতাংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। আমি মনে করি এই মৃত্যুর সঙ্গে অভিবাসন ব্যয় জড়িত। প্রবাসীরা অনেক টাকা খরচ করে বিদেশে যায়, সে কারণে সব সময় একটা টেনশন কাজ করে এই টাকা উপার্জনের ব্যাপারে। এজন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। এছাড়া প্রবাসী শ্রমিকদের থাকার জায়গা অস্বাস্থ্যকর, সস্তায় খাবার খায়। এসব কারণে দেখা যায়, ব্রেইন স্ট্রোক কিংবা হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যাচ্ছে। এজন্য আমি বলছি অভিবাসন ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, ৮০ শতাংশ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি মনে করি আমাদের অভিবাসী শ্রমিকদের যে কর্মপরিবেশ সেটা খুবই ক্রিটিক্যাল একটা কন্ডিশন। দ্বিতীয়ত তাদের বসবাসের জায়গা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিবাসী কর্মীরা ঋণ নিয়ে বিদেশে যায়। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পর যে বেতনের কথা তাদের বলা হয়, সেগুলা তারা পায় না। তাদের ঘাড়ে ঋণের একটা বোঝা থেকে যায়। এক্ষেত্রে যেটা হয় অনেকেই এই চাপ নিতে পারে না। এতে তাদের মধ্যে টেনশন কাজ করে, ফলে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। তাই এক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে যে তারা একটি স্ট্যান্ডার্ড কর্মপরিবেশে কাজ করছে এবং এটা সরকারকেই করতে হবে। আমি এ-ও মনে করি, অভিবাসনের যে খরচ সেটা না থাকলে তাদের মধ্যে এই টেনশন কাজ করবে না। খরচ তুলে আনার বিষয়ে যে অস্থিরতা তাদের মধ্যে কাজ করে এটা আর থাকবে না।’
বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদার বলেন, ‘যারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং অভিবাসনের প্রয়োজন রয়েছে এ রকম লোকজনকে বিদেশে পাঠানো উচিত। কারণ একজন কর্মী বিদেশ যাওয়ার সময় প্রচুর স্ট্রেস (মানসিক চাপ) নিয়ে যায়। দেখা যায় যে, শারীরিকভাবে শক্ত না এবং অনেক টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশ যাচ্ছে। এই অবস্থায় যখন উষ্ণ মরুর দেশে যায় তখন তারা একটা বড় ঝুঁকিতে থাকে। আরেকটা কারণ হলো, অভিবাসী কর্মীদের কোনও বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। একজন অভিবাসী কর্মীকে শুধু ছুটি দেওয়াই যথেষ্ট নয়। জর্ডানে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) আওতায়, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে যারা অভিবাসী শ্রমিক কাজ করেন তাদের নিয়ে পিকনিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানকার কমপ্লায়েন্স ফ্যাক্টরিগুলো দেখায় যে, কর্মীদের জন্য বিনোদনের কী ব্যবস্থা তারা করছে, যার কারণে তাদের জিএসপি পেতে সুবিধা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গার্মেন্টসের বাইরে অন্যান্য খাত যেমন কন্সট্রাকশন খাতে যারা কাজ করতে যায়, তাদের কী শুধু বেতন নিশ্চিত করেই শেষ? তাদের বিনোদনের সুযোগ কোথায়? যেখানে আমাদের কর্মী হাসি-খুশি আনন্দ নিয়ে কাজ করবে সে রকম একটা পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি বলে আমি মনে করি।’

/এসও/ওআর/
সম্পর্কিত
কানাডায় দ্বিতীয়বার ‘ডিরেক্টরস ক্লাব অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন মাহবুব ওসমানী
বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে ম্যানিলায় শিশু-কিশোরদের মিলনমেলা 
প্রেমিকের বাড়ি কিশোরগঞ্জে এলেন মালয়েশিয়ার তরুণী, হলো বিয়ে
সর্বশেষ খবর
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
প্রিয় দশ
প্রিয় দশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে