শুক্রবার (৪ জানুয়ারি) রাতেই চিকিৎসার জন্য হাঙ্গেরির উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ছে মাথায় জোড়া লাগানো শিশু রাবেয়া ও রোকাইয়া। সঙ্গে যাচ্ছেন তাদের মা-বাবাও। মা তাসলিমা খাতুন আর বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দেশবাসীর কাছে মেয়ে দুটোর জন্য দোয়া চাই। ওরা যেন সুস্থ হয়ে ওঠে।’
শুক্রবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের ৬০৫ নম্বর কেবিনে বসে কথা হয় এই দম্পতির সঙ্গে।
‘এবারের অস্ত্রোপচারটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে। এবার ওদের পা,পিঠ আর মাথার পেছনে ইনজেকশন দেওয়া হবে। ইনজেকশন করে করে চিকিৎসক ওই জায়গাগুলোকে বেলুনের মতো ফোলাবে। তারপর দেশে ফিরে এলে ওদের মূল চিকিৎসা শুরু হবে।’ চিকিৎসকের বরাত দিয়ে এ কথাগুলো বললেন জোড়া শিশু রাবেয়া-রোকাইয়ার মা তাসলিমা খাতুন।
তিনি জানান, রাতেই তারা সপরিবারে হাঙ্গেরি যাচ্ছেন। সেখানে রাবেয়া-রোকাইয়ার তৃতীয় অস্ত্রোপচার হবে। সেখানকার হাসপাতালে চিকিৎসকরা তাদের অস্ত্রোপচার করবেন। এটি হতে কমপক্ষে তিন মাস সময় লাগবে। তাদের সঙ্গে যাচ্ছেন ঢামেক বার্ন অ্যান্ড প্ল্যাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হোসাইন ইমাম। হাঙ্গেরিতে তাদের সহযোগিতা করবে ফর বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন।
তাসলিমা খাতুন বলেন,‘চিকিৎসকরা বলেছেন, এর আগে যে দু’বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে তখন ওরা তেমন ব্যথা পায়নি। এবার ওরা বেশ ব্যথা পাবে। পা ও পিঠের ব্যথাটা তাড়াতাড়ি সারলেও মাথার পেছনের ব্যথাটা খুব সহজে সারবে না।’
সন্তানদের ভবিষ্যত এবং শঙ্কার কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে তার। কিছুক্ষণ থেমে বলেন, ‘এছাড়া তো এখন আর কোনও উপায়ও নেই। ওরা ধীরে ধীরে বড় হয়ে যাচ্ছে। এরপর তো আর কিছু করাও যাবে না।’
শুক্রবার সন্ধ্যার পরই এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওয়ানা হবেন তাছলিমা খাতুন, তার স্বামী রফিকুল ইসলাম এবং তাদের তিন মেয়ে তাসনিম ও রাবেয়া-রোকাইয়া।
রাবেয়া-রোকাইয়ার বাবা রফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের তো আর কোনও উপায় নেই। মেয়ে দুইটা বড় হচ্ছে। ওদের তো এভাবে থাকা সম্ভব না। ওদের আলাদা করাই লাগবে। এটা আমাদের জন্য শান্তির খবর যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি সবকিছুর দেখাশোনা করছেন। তিনি সঙ্গে আছেন দেখে, আমরা মানসিক শান্তি পাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘আপনাদের (গণমাধ্যম) মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে মেয়ে দুটোর জন্য দোয়া চাই। ওরা যেন সুস্থ হয়ে ওঠে।’
শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই শিশুদের বাবা-মা রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ সারাদেশের অনেক চিকিৎসকের কাছেই গেছেন। তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েও গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে পাবনার এমপি মকবুল হোসেন তাদের চিকিৎসার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লিখিত চিঠি দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী তাদের চিকিৎসার উদ্যোগ নেন।’
ডা. সেন বলেন, ‘তৃতীয় অস্ত্রোপচারটি হাঙ্গেরিতে হবে। এরপর এই শিশুদের দেশে আনা হবে। তাদের সর্বশেষ অস্ত্রোপচার শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে হবে। এটি হতে কমপক্ষে ছয় মাস পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
এই শিশু দুটির জন্মের সময়ের কথা জানাতে গিয়ে তাদের মা স্কুলশিক্ষক তাসলিমা খাতুন বলেন, ‘ওদের জন্ম ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই। বিকাল চারটায় অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার পর আমাকে পুরো অজ্ঞান না করে শুধু কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত অবশ করা হয়। ফলে আমি সবকিছিই দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু পেট কাটার পর বাচ্চা যখন বের করতে পারছিল না, তখন চিকিৎসক পেটের আরও অংশ কেটে বাচ্চা বের করেন। সেখানে থাকা নার্স ও চিকিৎসকদের মুখ দেখে বুঝতে পারি, কিছু একটা হয়েছে। পরে যখন ট্রেতে রাখা হয়, তখন দেখি— সেখানে একটি নয়, দু’টি বাচ্চা। আর তাদের মাথা জোড়া লাগানো।’
পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার অমৃতকুণ্ডু গ্রামে রাবেয়া-রোকাইয়ার বাড়ি। তাদের মা-বাবা দুজনেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। সন্তানদের নিয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য স্কুল থেকে তিন মাসের ছুটি নিয়েছেন এই দম্পতি।