X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নারী নির্যাতন রোধে সচেতনতায় আমরা অনেক পিছিয়ে, অভিমত বিশিষ্টজনদের

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
১৭ জানুয়ারি ২০১৯, ২২:২৪আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০১৯, ২২:৩০

বৃহস্পতিবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের হল রুমে অ্যাকশন এইডের গবেষণা প্রবন্ধ উন্মোচন অনুষ্ঠানে বক্তারা   আমাদের শিক্ষার হার বাড়লেও সামাজিক ব্যাধিগুলো সম্পর্কে আমরা মানুষকে সচেতন করতে পারছি না। ২০০৯ সালে কর্ম ও শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষ অবগত নয়। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সচেতনতা একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা।

বৃহস্পতিবার (১৭ জানুয়ারি) দুপুরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের হল রুমে অ্যাকশন এইডের গবেষণা প্রবন্ধ উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন বক্তারা।  

এ সময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘২০০৯ সালে এ বিষয়ে দিক নির্দেশনা আকারে যে রায়টি এসেছে আমাদের কাছে মনে হয়েছে তাতে সবকিছুই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাতে যৌন হয়রানির ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে আমাদের কী করণীয়, সবই রয়েছে। যৌন হয়রানির ঘটনা সারা পৃথিবীতেই ঘটছে, কিন্তু আমরা তা ঘটতে দিতে পারি না। জাতি হিসেবে আমাদের একটি গৌরবময় ইতিহাস আছে। আমাদের সংবিধানে খুব পরিষ্কার করে লেখা আছে, “পুরুষ এবং নারী সমান অধিকার ভোগ করবে।” তারপরও আমরা দেখছি, প্রতিনিয়ত নারীরা এ ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে, যা আমরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। কিন্তু যে হারে বাড়ছে, তাতে আমাদের সামাজিক ব্যাধিগুলো সম্পর্কে আমরা মানুষকে সচেতন করতে পারছি কি?  আমার তো মনে হয়, আমরা পারিনি। আমাদের এখানে এখন অনেক কাজ করা বাকি আছে।’      

দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন, ‘আমি শিশুদের যৌন হয়রানি নিয়ে অনেক বছর ধরে কাজ করছি। পাঠ্যবই নিয়ে কিন্তু আমরা কাজ করেছি। আমরা দীর্ঘদিন কাজ করে “সেক্স” শব্দটি বাদ দেওয়ার মতো কিছু জিনিস দাঁড় করিয়েছি। আমাদের স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে। যখন অভিযোগগুলো আসে তখন জানতে পারি, উপজেলা চেয়ারম্যানরা মেয়েদের পক্ষই নেয় না। এটা তো আমাদের একটা ধারা। এই কাজগুলো শিক্ষার মাধ্যমে কিংবা সরকার করবে, সেটা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ২০০৯ থেকে একটি দিক নির্দেশনা এসেছে, আমাদের অর্থনৈতিক দিকগুলোর উন্নতি করতে হবে। কিছু মানুষ এতো দরিদ্র যে তাদের মামলা পর্যন্ত নেওয়া হয় না। তারা পুলিশের কাছে কেন যাবে?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে আসা রিপোর্টে দেখা যায়, শিশুদের যৌন হয়রানির ঘটনাগুলোর সবই বাড়ির ভেতরে হয়। শুধু যৌন নির্যাতন নয়, মানসিক নির্যাতনও। অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ও এগিয়ে থাকা উভয় পরিবারেই নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। বাল্যবিবাহ শুধু মেয়েদের হয় না, ছেলেরাও কিন্তু ১৮ বছর বয়সে বিয়ে করে ফেলে। এই জায়গাগুলোতে সচেতনতা তৈরি করার আগে আমাদের জনসংখ্যা নিয়েও ভাবতে হবে। যে দিক নির্দেশনা ২০০৯ সালে এসেছে, সে সম্পর্কে মানুষের ধারণা নেই। মানুষকে এ ব্যাপারে জানাতে হবে।’

গণমাধ্যমে নারী নির্যাতন বিষয়ক প্রতিবেদন পরিবেশনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে উল্লেখ করে বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদ বলেন, ‘এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটলে আমরা (গণমাধ্যম) তা সবার আগে তুলে ধরি। ধর্ষণের ঘটনাকে আমরা কীভাবে ব্যাখা করবো সে ব্যাপারে আমাদের নিজস্ব নীতিমালা রয়েছে। আগে “গণধর্ষণ” শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হতো। এর পরিবর্তে আমরা এখন ব্যবহার করি “সংঘবদ্ধ ধর্ষণ”। কারণ “গণধর্ষণ” একটি ভিন্ন মেসেজ দেয়। সংবাদমাধ্যমগুলো এসব পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আমরা এখন সংবাদমাধ্যমে বলি না– “ধর্ষিতা”, আমরা বলি– “ধর্ষণের শিকার”। “ধর্ষিতা” শব্দটি শুনলে মনে হয় যেন তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন,  ‘বিকৃত মানসিকতা থেকেই মানুষ যৌন হয়রানি করে থাকে। যৌন হয়রানি নিয়ে আলোচনা করেও সে আনন্দ পায়– যেন এটি একটি আনন্দের বিষয়! এই জায়গাগুলোতে কিন্তু সংবাদমাধ্যম এখন সামলে উঠছে। অর্থাৎ এই ঘটনাগুলোর বর্ণনায় আমরা এমন কিছু করার চেষ্টা করি না, যাতে ওই ঘটনা থেকে আরেকজন বিকৃত আনন্দ করার সুযোগ পেয়ে যায়। আমরা এমনভাবে ঘটনাটি বর্ণনা করি যাতে যিনি পড়বেন তিনি যেন ওই ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তির বিচার দাবি করেন। আজকে আমরা যেটি ঠিক নয় ভাবছি, সেটি হয়তো ৫০ বছর আগে প্রগতিশীলতা ছিল।’

সাক্ষ্য আইনে একটি সমস্যা আছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘ধরুন আমি খুন হয়েছি। অমুক আমাকে কোপ মেরেছেন, আরেকজন পেছন থেকে লাইট ধরেছেন, আরেকজন দড়ি এনেছেন– এগুলো প্রমাণ করতে হয়। আমাদের আইনি জটিলতার কারণে সেই নারী অভিযোগকারীকেই প্রমাণ করতে হবে অপরাধীর অপরাধ। কিন্তু উল্টো ব্যবস্থাও আছে, যেখানে অপরাধীকেই প্রমাণ করতে হবে যে সে নিরপরাধ।’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিয়া হক বলেন, ‘আইন থাকলেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যায়। আমরা বেশ কিছু উদাহরণ পেয়েছি যে, সচেতনতা থাকা সত্ত্বেও কিছু করা যাচ্ছে না। আইনের সঙ্গে যদি গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য সমন্বয় করা হয়, তাহলে সেটা খুব ভালো উদ্যোগ হবে। এর বাইরে সচেতনতার তো একটি বড় ভূমিকা থেকেই যায়।’ 

ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের উপ-কমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমি এ বছর ব্যক্তিগতভাবে ১৩০টি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলাম। সবগুলো ক্রিটিক্যাল মামলা আমার হাত দিয়েই হয়। আমি এবার ৬১টি পরিবারকে মেডিটেশন করে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছি। যেসব ধর্ষণ বাইরে হয়, যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, পুলিশের কাছে রেকর্ড হয়– আমরা এমন সাড়ে পাঁচশ’ ভিকটিমকে সাপোর্ট দিয়েছি। কিন্তু এর বাইরে কত ঘটনা অজানা থাকে আপনারা জানেন? ভিকটিমরা আমাদের কাছে আসে, আমাদেরকে কাউন্সেলিং করতে হয়। আমরা অনেক রিকোয়েস্ট করে হয়তো ৫০ জন আসলে ১০টি মামলা রেকর্ড করাতে পারি। অভিভাবকরা যখন সম্মানের কথা চিন্তা করেন আমরা তাদের আশ্বস্ত করি সবরকম গোপনীয়তার।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি গত বছর ৭৮ জন আসামি ঢাকার বাইরে থেকে নিয়ে এসেছি। তাদের কতজন এখনও হাজতে আছে? বেশির ভাগই জামিনে বেরিয়ে গেছে। জামিন অযোগ্য আইনে আছে, তারপরও গেল কীভাবে? আমার খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি একটা মামলা দাঁড় করাতে গিয়ে সরকারের অনেক শ্রম, অর্থ ও সময় নষ্ট হয়। তারপর একটা মামলা দাঁড় করাতে দুই বছর লেগে যায়– এটা আপনারাই বলেন। কিছু কিছু স্পর্শকাতর মামলা আমরা নিজেরাই মনিটরিং করি। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির ব্যাপারে বলবো, সারা বিশ্বব্যাপী হচ্ছে “হ্যাশট্যাগ মি টু”। আমাদের দেশের কয়জন মুখ খুলতে পেরেছে? কেন পারলো না? আমাদের সেই স্বাধীনতা কি আছে? আজকে একটা রিপোর্ট করলে সে চাকরি করতে পারবে কিনা নিজেই জানে না। স্বামীকে গিয়ে যদি বলে, “সহকর্মীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছি”, স্বামী বলবে, “চাকরি করার দরকার নেই।” তাকে নিরাপত্তা কে দেবে? আশ্রয় কে দেবে?’

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল করিম এ সময় নারী নির্যাতন রোধে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। 

 

/এসও/এমএএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
সর্বাধিক পঠিত
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা